সুরাইয়াকে হত্যা করার আগে দু’বার দক্ষিণখানের মোল্লারটেকের বাড়িটি রেকি করেছিলো কিলার। তৃতীয়বার ওই বাড়িতে পৌঁছে কিলিং মিশন সম্পন্ন করে। নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সুরাইয়া বেগমকে। চারতলা বাড়ির কেউ টের পাননি। হত্যা শেষে বীরদর্পে চলে যায় সে। গতকাল রোববার মোল্লারটেক তেতুলতলার ইয়াছিন রোডের ৪০ নম্বর বাড়িতে গেলে কথা হয় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। কিলারকে দেখেছেন সুরাইয়ার স্বামী ইউনুছ মিয়া। তিনি জানান, যে লোকটি বাসা ভাড়া নিতে এসেছিলো সেই-ই সুরাইয়াকে হত্যা করেছে। কিলারের বয়স প্রায় ৩৫ বছর হবে। দেখতে ভদ্রলোক। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে একজন কিলার। দুইবার ওই বাড়ি রেকি করেছে সে। প্রথমবার এসেছিলো বাসা ভাড়া হবে কি-না জানার জন্য। নিচতলায় থাকতেন ইউনুছ মিয়ার বোন সাথী বেগম। সাথী বেগমের সঙ্গে প্রথম কথা হয়। তখন শুধু ফ্ল্যাটের রুম, ভাড়া এসব বিষয়ে জেনে চলে যায় সে। দ্বিতীয়বার এসেছিলো আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে। তখন বিকাল বেলা। সুরাইয়ার স্বামী ইউনুছ মিয়া জানান, দ্বিতীয় তলা থেকে সুরাইয়াকে ডেকে নিয়ে যায় তৃতীয় তলায়। বাইরে থেকেই ফ্ল্যাট দেখে চলে যায় কিলার। তখন ওই ফ্ল্যাটে ভাড়াটে ছিলেন বিধান ও তার পরিবার। সেদিন আর বাসার ভেতরে যায়নি কিলার। বাইরে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, ‘বাসা পছন্দ হয়েছে। ২১শে আগস্ট ভাড়ার অগ্রিম টাকা দিয়ে যাবো।’ কিলার জানিয়েছিলো, সে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। তার স্ত্রীকে নিয়ে এই বাসায় থাকবে। ইউনুছ মিয়া ও শাওন জানান, হত্যাকাণ্ডের আগে যে দু’বারই ওই কিলার বাসায় এসেছিলো, প্রতিবারই বাড়ির অন্য বাসিন্দারা বারান্দায় ছিলেন। এমনকি যে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে এসেছিলো ওই ফ্ল্যাটেও ভাড়াটে ছিল। লোকটি যে ২১শে আগস্ট ভাড়ার অগ্রিম টাকা জমা দেবে তা শাওনকে জানিয়েছিলেন তার মা সুরাইয়া বেগমই। কিন্তু সেদিন জমা দিতে আসেনি। এসেছিলো যম হয়ে। সেদিনই আমার মায়ের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সে। হত্যাকাণ্ডের দিনটি ছিল অন্যরকম। তখন দুপুর। শাওন তখন কর্মস্থলে। ইউনুছ মিয়া পাশের দোকানে। নিচ তলায় সাথী থাকলেও তাকে ডাকেনি কিলার। বাসায় একা ছিলেন সুরাইয়া। নিশ্চয়ই খোলা গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে দরজায় নক করেছিলো। সুরাইয়া বেগম দরজা খুলে বের হয়ে এসেছিলেন। সেদিন ভাড়াটে থাকায় ভেতরে ঢুকে বাসা দেখা হয়নি। তাই আবার ফ্ল্যাট দেখার অজুহাতে তৃতীয় তলায় নিয়ে যায় সুরাইয়াকে। সেখানেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে তাকে। এমনটিই মনে করেন ইউনুছ মিয়া ও তার ছেলে শাওন। কিন্তু কিলিং মিশনের সেই নৃশংস দৃশ্য কেউ দেখেনি। এমনকি ঘটনার দিন কিলারকেও কেউ দেখেনি। এ বিষয়ে নিহতের ছেলে শাওন জানান, বেলা ১টার পর থেকে তার মা সুরাইয়া বেগমকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না তার বাবা ইউনুছ মিয়া ও ফুফু সাথী বেগম। দেড়টার দিকে তৃতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখতে পান পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রমেজা পারভিন। কাছে যেতেই আকাশ ভেঙে পড়ে। সুরাইয়ার রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে গেছে তার থ্রিপিস, পুরো মেঝে। ‘খুন খুন’ বলে চিৎকার করেন রমেজা। মুহূর্তের মধ্যেই আশপাশের সবাই ছুটে যান। খবর পেয়ে দক্ষিণখান থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সরু গলির মধ্যখানে দাঁড়ানো লাল রঙের ওই বাড়িটি স্থানীয়দের কাছে ‘মার্ডার বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। বাড়ির নম্বর জানেন না কিন্তু লাল রঙের বাড়িতে এক নারীকে হত্যা করা হয়েছে তা সকলের জানা। গতকাল এই বাড়িতে ঢুকতেই তালাবদ্ধ কেচিগেইটের ভেতর থেকে প্রহরী জানতে চান, কে, কার কাছে যাবো। পরিচয় দিয়ে বিস্তারিত বলার পর গেইট খুলে দেন। ভেতরে যাওয়ার গেইটে তালা দিয়ে তিনি নিজেই দোতলায় নিয়ে যান। হত্যাকাণ্ডের আগে এরকম কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না এই বাড়িতে। এমনকি কোনো প্রহরী ছিল না এখানে। কর্তব্যরত প্রহরী মোল্লা বক্স জানান, ২রা অক্টোবর কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি। দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক ইউনুছ মিয়া। বৃদ্ধ ইউনুছ মিয়ার দু’চোখে অন্ধকার। স্ট্রোক করেছিলেন বেশ আগে। রোগাক্রান্ত এই লোকটি কথা বলতে পারেন না ঠিকমতো। স্ত্রী সুরাইয়াকে হারানোর পর একমাত্র সন্তান নাজমুল হুদা শাওনকে নিয়ে এই বাড়িতে আছেন তিনি। নিজের দেখাশোনার জন্য বোনকে নিয়ে এসেছেন বাড়ি থেকে। ইউনুছ মিয়া বলেন, সুরাইয়াকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তাকে হারানোর পর থেকে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই পুরো বাড়িটি দেখাশোনা করতো সে। তাকে ছাড়া পুরো বাড়িটা শূন্য মনে হয়। তাকে যেভাবে কুপিয়ে মেরেছে এভাবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে না। বলতে বলতে থেমে যান ইউনুছ মিয়া। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কথাগুলো আটকে যাচ্ছে মুখের মধ্যে। বললেন, অনেক বড় বড় জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। অথচ একটা লোক বারবার হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারছে না। এটা মেনে নেয়া যায় না। বেঁচে থাকতেই স্ত্রী হত্যাকারীর শাস্তি দেখে যেতে চান তিনি। দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ রোকনুজ্জামান বলেন, তাকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে। ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রাপ্ত ছবি দেখে কিলারকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.