প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০২:৪২:৫৯ | অাপডেট: ২৬ অক্টোবর, ২০১৬ ০২:৪৫:১৩
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) গত কয়েক বছরে জাল সনদে নিয়োগ পাওয়া ১২ শতাধিক শিক্ষক চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে শুধু ১৯ মাসেই চিহ্নিত হয়েছেন ৫ শতাধিক। এই হিসাব থেকে ডিআইএর কর্মকর্তারা আশংকা করছেন, সারা দেশের ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে আরও ১০ হাজারের বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হতে পারে।
এদিকে নিবন্ধন সনদের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ডিআইএ থেকে চিঠি দেয়ার পর বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) জবাব দিচ্ছে। তাদের জবাব থেকেই ১০৫ জনের মধ্যে ৯৩ শিক্ষকের সনদ জালের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা শতকরার হিসাবে ৮৯ ভাগ।
এ প্রসঙ্গে ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক আহাম্মেদ সাজ্জাদ রশীদ বলেন, ‘আমরা দু’ভাবে জাল সনদ ধরে থাকি। আমাদের টিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে গিয়ে সন্দেহভাজন সনদ চিহ্নিত করে। পরে এনটিআরসিএ তা নিশ্চিত করে। এছাড়া সচেতন অনেক নাগরিকের চিঠির সূত্র ধরে জাল নিশ্চিত করা হয়। প্রতিদিনই এমন অনেক চিঠি আমরা পেয়ে থাকি।’ তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে এমন সন্দেহজনক ১০৫টি সনদ যাচাই করে আমরা ৯৩টিই জাল পেয়েছি। এখন সংশ্লিষ্ট জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।’
বেসরকারি স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিবন্ধন সনদ অর্জন করতে হয়। এজন্য এনটিআরসিএ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন করে। এতে উত্তীর্ণরাই শুধু নিয়োগের যোগ্যতা অর্জন করেন। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের সনদ দেয়ার পর তাদের নিয়ে তালিকা তৈরি হয়। এই তালিকা থেকে বেসরকারি স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে এই সনদ বাধ্যতামূলক করার পর থেকেই সনদ জাল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকেই জাল সনদে চাকরি নেয়া শুরু করেন। এ পর্যন্ত সাড়ে আট হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে দেখা গেছে, এক হাজার দু’শর বেশি জাল সনদধারী শিক্ষক বিভিন্ন বয়সী ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করছেন।
অনুসন্ধানে তিন ধরনের জাল সনদ পাওয়া গেছে। উত্তীর্ণ অন্য কোনো ব্যক্তির নামের সঙ্গে মিলিয়ে সনদ ইস্যু করা হয়। এ ধরনের জালিয়াতরা হয়তো পরীক্ষায় বসে কিন্তু পাস করে না। সম্প্রতি চিহ্নিত ৯৩টি জাল সনদের মধ্যে ৫০টিই এ ধরনের। দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে, খাঁটি জাল। প্রার্থী পরীক্ষায় আবেদন করে, পাস না করলেও জাল সনদ পেয়ে যায়। উল্লিখিত ৯৩টি জাল সনদের মধ্যে এ ধরনের কেস আছে ৩৩টি। এছাড়া পরীক্ষার্থী আসল কিন্তু তিনি অকৃতকার্য- এমন ব্যক্তিও জাল সনদে চাকরি নিয়েছেন। ৯৩টির মধ্যে এ ধরনের ৬টি কেস পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, এই জাল সনদধারীদের প্রায় সবাই সরকারি বেতনভাতা বা এমপিও পেয়েছেন। নিয়োগ থেকে শুরু করে এমপিও গ্রহণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তির কাগজপত্র অন্তত ১০ ধাপে নিরীক্ষা হওয়ার কথা। এগুলো হচ্ছে নিয়োগ কমিটি, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও সভাপতি, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ডিলিং কর্মকর্তা, শিক্ষা কর্মকর্তা, সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক এবং মহাপরিচালক। পরিচালক এবং মহাপরিচালক বাদ দিলেও অন্তত ৮ ধাপে ম্যানেজ না করে পার পাওয়া কঠিন বলে মনে করেন ডিআইএ কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে ডিআইএর যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, এতগুলো পথ পাড়ি দিয়ে একজন জাল সনদধারীর নিয়োগ ও এমপিও পাওয়ার ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর।
জানা গেছে, শুধু নিবন্ধনই নয়, সারা দেশে প্রায় ৩০ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে জাল শিক্ষাগত সনদেও চাকরিরত আছেন অনেকে। ডিআইএর তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত বিএড-এমএড, শারীরিক শিক্ষা, কম্পিউটার শিক্ষা, ডিগ্রি পাস, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিগ্রির জাল সনদও পাওয়া গেছে। ডিআইএর উপপরিচালক সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। তাতে দেখা যায়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ডিআইএ ৮৬৯৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন, নিরীক্ষা ও তদন্ত শেষে প্রতিবেদন তৈরি করে। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ২২৫টি প্রতিবেদন নিষ্পত্তি করে মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানে জাল সনদে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৬৩ শিক্ষক। জাল প্রমাণের পরও মন্ত্রণালয় জালিয়াতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ডিআইএ কর্মকর্তারা বলছেন, নিয়ম হচ্ছে তাদের প্রতিবেদন ত্রিপক্ষীয় সভার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তা করা হয় না।
ডিআইএর যুগ্ম-পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, আমরা সম্প্রতি যে ৩৬৩টি জাল সনদ ধরেছি তারা সবাই রহস্যজনকভাবে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এসব শিক্ষক সরকারি বেতনের অংশ হিসেবে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৫ টাকা তুলে নিয়েছেন। ডিআইএর শুধু রাজশাহী অঞ্চলের ১০৫টি সনদ যাচাইয়ে এনটিআরসিতে পাঠানো চিঠির সূত্র থেকে দেখা যায়, বারবার তাগিদ দেয়ার পরও রহস্যজনক কারণে সনদের সত্যাসত্য সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছিল না। এর মধ্যে অন্তত ৬০টি সনদের তথ্য চেয়ে সর্বনিু ৩ বার এবং সর্বোচ্চ ১০ বার তাগিদপত্র পাঠানো হয়। এ অবস্থায় ডিআইএ কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করে। এরপর ১৬ অক্টোবর এনটিআরসিএ তথ্য পাঠায় যে, ১০৫টি সনদের মধ্যে ৯৩টিই জাল।
এনটিআরসিএর সনদ সম্পর্কিত এই দেখা যায়, নাটোরের সিংড়ার একটি বেসরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকের সনদ জাল। তিনি ৮০০০৪৩৯২/২০০৮ রেজি. নম্বরের সনদে চাকরি নেন। এনটিআরসিএ বলছে, এই রেজিস্ট্রেশন নম্বরধারী ব্যক্তি অন্য একজন। নাটোরের এক কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের এক প্রভাষকের সনদও জাল। সনদের রেজি. নং-৬৪০৮৭৯৬/২০০৬। এ সনদের মূল ব্যক্তি ওই বছর নিবন্ধন পরীক্ষায় পাসই করেনি। এ দুটি সনদ যাচাইয়ে যথাক্রমে ৮ ও ৭ বার তাগিদ দিতে হয়েছিল। পাবনার একটি স্কুলের শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করতে পারেননি। তিনি সনদ সংগ্রহ করে চাকরি নিয়েছেন। দু’বার তাগিদ দেয়ার পর এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ সনদটি সত্যায়ন প্রতিবেদন দেয়। এভাবে নাটোর, নওগাঁ, পঞ্চগড়, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষকদের সনদ জাল বলে নিশ্চিত করেছে এনটিআরসিএ।
জাল সনদ তৈরির সিন্ডিকেটের এক সদস্য মিজানের সঙ্গে কথা হয়। তার দাবি, বাইরের দালালের সঙ্গে মাউশির প্রধান ও আঞ্চলিক কার্যালয়ের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এনটিআরসিএর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। সম্প্রতি মাউশির তদন্তে চিহ্নিত এমপিও জালিয়াত চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিলেই প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান এএমএম আজহার।
মিজানের এই দাবির সত্যতাও মিলেছে। ১৯ এপ্রিল ময়মনসিংহের একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষকের সনদ যাচাইয়ে পাঠায় ডিআইএ। ৮ জুন এনটিআরসিএর নামে একটি চিঠি আসে, যেখানে সনদটি সঠিক দাবি করা হয়। ডিআইএর উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, এই চিঠিই জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি তিনি প্রশ্ন রাখেন, ডিআইএ থেকে এনটিআরসিএতে চিঠি পাঠানোর এই তথ্যটি কে ফাঁস করল, তা অনুসন্ধানেই সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব উদঘাটিত হবে।
আলাদা ঘটনায় দেখা যায়, গত বছরের ১১ মে ফরিদপুরের একটি কলেজে তদন্ত করে ডিআইএ। সেখানে দুই প্রভাষকের শিক্ষক নিবন্ধন সনদ জাল পাওয়া গেছে। ডিসেম্বরে এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয় মন্ত্রণালয়ে। এর ৩ মাস পর ২১ মার্চ এক প্রভাষক ডিআইএতে ২০০৫ সালে নিবন্ধন পাসের অন্য একটি সনদসহ দরখাস্ত করেন। ওই প্রভাষকের দাবি, তার পরের সনদটি সঠিক। এর আগে পরিদর্শনকালে ডিআইএ’র তদন্ত দল এই প্রভাষকের যে জাল সনদটি পেয়েছিল তা ২০০৮ সালের। দরখাস্তে ২০০৮ সালের সনদটি জাল বলে স্বীকার করেন। এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, পরের সনদটি যাচাইয়ে পাঠানো হয়েছে। অনেক দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত এনটিআরসিএ এ সংক্রান্ত তথ্য দেয়নি। রাশেদুজ্জামান আরও বলেন, ‘তবে এই সনদ সঠিক হলেও নিয়োগটা বৈধ নয়। কেননা তিনি ২০১২ সালের ৩১ জানুয়ারি যোগ দেন। আর ২০০৫ সালে পাস করে থাকলে এই সনদের মেয়াদ ২০১০ সালেই শেষ হয়ে গেছে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.