নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই যুবকটি বলেছিল, ‘যে জন্য এলাম, কোনো লাভ হলো না।’ তখন হতাশার ছাপ ছিল তার চোখে-মুখে। বাড়ির মালিকের স্ত্রী মধ্যবয়সী নারী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি বললেন, কি লাভ হলো না। যুবকটি মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নেয়। সতর্কতার সঙ্গে বলে, না, বাসাতো দেখলাম কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ফ্ল্যাটটি তার পছন্দ হয়নি জানিয়েই চলে যায় সে। ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনার দুখু মেম্বার সড়কের পঞ্চম তলা বাড়িতে ঘটে এ ঘটনা। বাসা ভাড়ার অজুহাতে একের পর এক নারীদের ওপর হামলা ও কিলিং মিশন যে ঘটাচ্ছে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ওই বাড়ির সিসি টিভির ফুটেজ থেকেই। ফুটেজে যে ব্যক্তিকে দেখা গেছে তাকেই কিলার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই দিনে গাওয়াইর দক্ষিণপাড়ার ৭১৫নং বাসায় ফ্ল্যাট ভাড়ার অজুহাতে হত্যা করা হয় ওয়াহিদা আক্তার সীমাকে। ভাড়ার অজুহাতে যাওয়া ওই ব্যক্তিকে দেখেছিলেন সীমার মেয়ে শারমিন। ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছেন তিনি। পুলিশ জানিয়েছে, একই ব্যক্তি একের পর এক হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফুটেজে তাকে দেখা গেলেও এখনও তার পরিচয় ও অবস্থান শনাক্ত করতে পারেননি তারা। দুখু মেম্বার রোডের ওই বাড়িতে একই উদ্দেশ্যে গিয়েছিল কিলার। দিনটি ছিল ৭ই সেপ্টেম্বর। সময় তখন প্রায় ৩টা। সেদিনও প্যান্ট, ইন করা শার্ট ও কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো ছিল তার। বাড়ির মালিকের স্ত্রী তখন সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিলেন পাশের একটি বাড়িতে যাবেন বলে। ঠিক তখনই ভদ্রবেশী ওই কিলার তার সামনে দাঁড়ায়। জানতে চেয়েছিল, ‘আপনি কি এই বাড়ির মালিক?’ ওই নারী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছিলেন। তার পরই কিলার বলেছিল, ‘আমি বাসা ভাড়া নেবো।’ ওই নারী জানান, অল্প সময় কথা হয়েছে তার সঙ্গে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কি করেন, বাসায় কে কে থাকবেন। কিলার বলেছিল, ‘মা ও আমি থাকবো। আমি একটি প্রাইভেট জব করি।’ তার পরই সে জানতে চেয়েছিল, ‘ফ্ল্যাটটি দেখা যাবে কি-না।’ একথা বলার পরই ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যান তাকে। পঞ্চম তলার ওই বাসায় তখনও ভাড়াটে ছিল। সেখানে গিয়ে ভেতরে ঢুকে তাকে বাসা দেখতে বলেন ওই নারী। কিন্তু থেমে যায় কিলার। দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই মাথার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল, ‘আমি আর দেখবো না’। বারান্দায়ও ছিলেন তখন বাড়ির বাসিন্দাদের কেউ কেউ। এই মুখরিত পরিবেশ যেন কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কিলার বলেছিল, ‘যে জন্য এলাম কোনো লাভ হলো না।’ নারী জানতে চান, কি লাভ হলো না? প্রতিউত্তরে বলেছিল, ‘না, বাসাতো দেখলাম কিন্তু কোনো কাজ হলো না।’ তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যায় সে। বাড়ির মালিকের ছেলে হারুন অর রশীদ জানান, পঞ্চম তলার ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটেদের বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা বাসা ছাড়েননি। কিলার যেদিন এসেছিল সেদিন ওই ফ্ল্যাটের লোকজনসহ বাড়িতে অনেকে ছিলেন। বাসা খালি হবে জানার পরপরই টু-লেট টানানো হয়েছিলা ওই টু-লেট দেখেই ফ্ল্যাটটি দেখতে গিয়েছিল কিলার। হারুন অর রশীদ বলেন, সাধারণত ফোনে কল দিয়েই লোকজন বাসা দেখতে যায়। কিন্তু ওই কিলার ফোনে কল দেয়নি। ওই বাসায় সিসি টিভির দুটি ক্যামেরা রয়েছে। একটি নিচতলায়, অপরটি দ্বিতীয় তলায়। নিচতলার ক্যামেরাটি সেদিন নষ্ট ছিল। দ্বিতীয় তলার ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। মানবজমিনের সংগ্রহে থাকা ওই ফুটেজে দেখা গেছে, ৩টা ৩ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডে একটি মোবাইলফোন হাতে নিচে নামেন বাড়ির মালিকের স্ত্রী। নিচেই প্রথম কথা হয় কিলারের সঙ্গে। পরে বাড়ির পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট দেখাতে উপের নিয়ে যান তাকে। দ্বিতীয় তলা দিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখা গেছে ৩টা ৫ মিনিট ১৫ সেকেন্ডে। এছাড়াও ফুটেজে বাড়ির মালিক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে দেখা গেছে নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় ঢুকতে। এছাড়াও একজন গৃহপরিচারিকা ও একজন ভিক্ষুক মহিলাকে ওই ফুটেজে দেখা গেছে। তারপর বাড়ির মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে ওপরে উঠে কিলার। ফ্ল্যাট দেখা শেষে ৩টা ১১ মিনিটে কিলারের নিচে নামার দৃশ্য দেখা গেছে ফুটেজে। এই ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে আছেন এই পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির মালিকের ছেলে হারুন অর রশীদ বলেন, ওই লোকটি যদি সিরিয়াল কিলার হয়ে থাকে তাহলে ২৪ ঘণ্টা আমাদের নিরাপত্তা দেবে কে। যেহেতু তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি সে আবার যে হামলা করবে না এটা বলা যাবে না। এই ঘটনার পর থেকে মা’সহ সবাই আতঙ্কে আছি। নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি অনুরোধ করেন, তার মায়ের নামটি যেন পত্রিকায় ছাপা না হয়। দক্ষিণখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তপন কুমার সাহা বলেন, থানা পুলিশ থেকে শুরু করে ডিবি, কাউন্টার টেরোরিজম, র্যাব সবাই সিরিয়াল কিলারকে গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। নতুন করে যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য এলাকার লোকজনকে বৈঠক করে সচেতন করা হয়েছে। পুরো এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.