বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা যেকোনো দেশে আইনের শাসন বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সত্য উপলব্ধি করেই আজ থেকে ৯ বছর আগে নির্বাহী বিভাগ থেকে দেশের বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু আইনি জটিলতা থাকায় ও প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক উদ্যোগের অভাবে বিচার বিভাগের সেই স্বাধীনতা বাস্তবে ধরা দিচ্ছে না বলেই মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। বিচার বিভাগ পৃথক্করণের নবম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেওয়া প্রধান বিচারপতির বাণীতেও উঠে এসেছে একই আক্ষেপের সুর। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগে এখনো দ্বৈতশাসন চলছে। ফলে বিচার বিভাগের কাজে বিঘ্ন ঘটছে। এ দেশের কোনো সচেতন নাগরিকই এমনটি চান না, চাইতে পারেন না।
বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, বিচার বিলম্বিত হওয়া, বিচার না পাওয়ারই শামিল। অথচ বাংলাদেশে মামলার জট বাড়তে বাড়তে পাহাড় সমান হয়েছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৭ সালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ১৫ লাখের মতো, বর্তমানে তা ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। এমন অবস্থায় অনেক বিচারপ্রার্থী তাঁদের জীবদ্দশায় সুবিচার পাবেন কি না তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মামলাজটের অন্যতম কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারা। বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি কোনো ক্ষেত্রেই বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ফলে বিচার বিভাগ পৃথক্করণেরও কোনো সুফল মিলছে না। প্রধান বিচারপতি তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেছেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর বিচার বিভাগের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা। ফলে এক ধরনের দ্বৈতশাসনের সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিচারকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে, মামলাজট বাড়ছে এবং বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এ কারণে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটির পুনঃপ্রবর্তন হওয়া এখন সময়ের দাবি। তবে আইনমন্ত্রী গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্য স্ববিরোধী। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বর্তমান সংবিধানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বাহাত্তরের সংবিধানে ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত থাকবে। পরবর্তীকালে এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, এই নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। এই সংশোধনের সুযোগ নিয়ে বর্তমানে এই দায়িত্ব পালন করে নির্বাহী বিভাগ বা আইন মন্ত্রণালয়। এতে বিচার বিভাগে প্রকৃত অর্থেই দ্বৈতশাসন চলছে। বিচার বিভাগের কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নও থমকে আছে।
বিচার বিভাগে দ্বৈতশাসন রেখে কিংবা স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমরা কথায় কথায় দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলি। কিন্তু বিচার বিভাগের হাত-পা বেঁধে দিয়ে তা তৈরি করা যাবে না। আমরা আশা করি, দ্বৈতশাসন দূর করে স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতার পরিচয় দেবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.