এক : ২৫ বছর বয়সের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিউলী (ছদ্মনাম)। ধনী পরিবারের মেয়ে। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে তিনি সুপারশপে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে গেলেন। পরে সেখানে ঘটল যতো বিপত্তি। তিনি সুপারশপ থেকে দামি পারফিউম ও চকলেট চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লেন। এতো ধনী পরিবারের মেয়ে হয়ে পারফিউম ও চকলেট চুরি করার দরকার কী? এ ঘটনায় তার বন্ধুদের চোখ তো ছানাবড়া। যাক পরে ‘অমনস্ক হয়েই এমন হয়ে গেছে’, আন্তরিকভাবে দুঃখিত’ বলে কোনরকম এ বিব্রতকর অবস্থা থেকে রেহাই পেলেন। দুই : শরিফা (ছদ্মনাম) বয়স ১৬। বাবা-মার সঙ্গে বিদেশ যাচ্ছেন। এয়ারপোর্টে ডিউটি ফ্রি দোকানে ঢুকে বের হওয়ার সময় ওই দোকানের বিক্রয়কর্মী দাবি করলেন, তাদের দোকান থেকে কিছু একটা না বলে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে শরিফা। বিষয়টা শুনে তো শরিফার বাবা-মা রেগে গেলেন এবং প্রতিবাদও করলেন। পরে শরিফার ব্যাগ চেক করে পাওয়া গেল অল্প দামের একটা লিপস্টিক। শরিফা সত্যিই ওই দোকান থেকে সেটা নিয়েছিল। বাবা-মা তো লজ্জায় একাকার। শরিফার বক্তব্য, সে এমনিই সেটা তুলে নিয়েছিল! কিছু ভেবে সে এটা করেনি, এসময় সে নিজেকে সংবরণ করতে পারছিল না। পরে নিয়মকানুনের বালাই শেষে তারা ফ্লাইট ধরেন।
শরিফা ও শিউলী ক্লিপটোম্যানিয়া বা চুরি রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্তরা কারণে-অকারণে হরহামেশাই চুরি করে থাকেন। চুরি করার পরে ব্যক্তি প্রচণ্ড মানসিক চাপ থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পায়।
ক্লিপটোম্যানিয়া বা চুরি রোগ : এটা একটা মানসিক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে শত চেষ্টা করেও কোনও ব্যক্তি চুরি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না- অথচ এ ইচ্ছার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বা আর্থিক লাভের কোনও সম্পর্ক নেই।
অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসওর্ডার (ওসিডি)- অনাকাংখিত নিয়ন্ত্রণহীন চিন্তা যখন আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে- অর্থাৎ ব্যক্তি সচেতন ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার অবচেতন মনের অনাকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়।
সাধারণভাবে ক্লিপটোম্যানিয়া মানসিক সমস্যা- মনমেজাজের ভারসাম্যহীনতা, হতাশা, দুশ্চিন্তা, অবচেতন মন, মানসিক রোগ যেমন- বুলিমিয়া নার্ভোসার ও অ্যালকোহলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ।
মানসিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে এ রকম আচরণ ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত। আবার বলা যায় এগুলো করার জন্য ব্যক্তি নিজের মধ্যে একধরনের অপ্রতিরোধ্য ইচ্ছা অনুভব করেন বা চুরি করতে বাধ্য হন। কখনো এটি ইম্পালসিভ (তাড়নাগত) আবার কখনো হয়ে ওঠে কম্পালসিভ (বাধ্যতাধর্মী)।
লুকিয়ে নিয়ে আসা জিনিসটি তিনি কখনো ফেলে দেন বা লুকিয়ে রাখেন বা অগোচরে সেটি জায়গামতো ফিরিয়েও দিয়ে আসেন। পুরুষদের চেয়ে নারীদের এই সমস্যা বেশি, আর প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে প্রায় ছয়জনের এই সমস্যা রয়েছে বলে গবেষকেরা মনে করেন।
ক্লিপটোম্যানিয়ার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে- মস্তিষ্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার সেরাটোনিনের কম নিঃসরণই এ আচরণের জন্য দায়ী। কারণ সেরাটোনিনই আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হতাশা, দীর্ঘদিন ধরে বয়ে বেড়ানো মানসিক চাপ বা আঘাত ও সমস্যা, ব্যক্তিগত সমস্যার পারিপার্শ্বিকতায় এ রোগ হতে পারে।
* মস্তিষ্কের একটি নিউরোট্রান্সমিটার সেরোটোনিনের কম নিঃসরণই এ আচরণের জন্য দায়ী। কারণ সেরোটনিন ডোটামিন কমবেশি হলে এ রোগের প্রবণতা দেখা দেয়।
* প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে বয়ঃসন্ধিকালে ও তরুণ বয়সেই এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়।
* নারীদের মধ্যে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণ যেমন : হতাশা ও আবেগজনিত সমস্যার জন্য তুলনামূলক এ রোগ বেশি হয়।
ক্লিপটোম্যানিয়া বা চুরি রোগে চিকিৎসার পাশাপাশি যা করা যায় :
* যেসব পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন, সেই পরিস্থিতিগুলো এড়িয়ে চলুন ও নিকটজনের কাছাকাছি থাকুন।
* স্বজন বা বন্ধুদের কাছে বিষয়টি ব্যাখ্যা করুন। ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে তারা আপনাকে বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
* নিজের তাড়নাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে চিন্তাকে অন্যদিকে সরানোর লক্ষ্যে থট ডাইভারশন জাতীয় বিহেভিয়ার থেরাপি যেমন হাতে রাবার ব্যান্ড লাগিয়ে আস্তে আস্তে তা বারবার টানা, উল্টোদিক থেকে সংখ্যা গণনা করে দেখতে পারেন। আপনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে চুরি করার উটকো চিন্তা মাথায় আসবে না।
* প্রিয়জনের এ ধরনের সমস্যা থাকলে রাগারাগি না করে সহানুভূতির সঙ্গে নিন।
চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়-সাইকোথেরাপি, বিশেষ করে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ও কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। তাই কারও যদি এ ধরনের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে সচেতন হয়ে যান। এ রোগের লক্ষণ দেখলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডা. সাইফুন নাহার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট শেরেবাংলা নগর, ঢাকা
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.