৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়াবহ তাণ্ডব নেমে এসেছিল, তার ধারাবাহিকতায় ৪ নভেম্বর আবারও একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন তারা। ৩০ অক্টোবরের ঘটনায় বেশ কয়েকটি মন্দির ভাংচুর করা হয়েছিল, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শতাধিক ঘরবাড়িতে হামলা ও লুট হয়েছিল, এমনকি শ’খানেক সম্পূর্ণ নিরপরাধ মানুষকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। শুক্রবার ভোরে আবারও আগুন দেয়া হয়েছে পাঁচটি হিন্দু বাড়িতে। প্রথম ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল ফেসবুকে একটি পোস্ট দেয়াকে কেন্দ্র করে। আপত্তিকর পোস্টটি যিনি দিয়েছিলেন, তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে সেটি করেননি, আপত্তিকর ছবিটি সরিয়ে বিষয়টির জন্য সবার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। উপরন্তু, স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে পুলিশে দিয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে আটক করার পর পুরো বিষয়টির সেখানেই নিষ্পত্তি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের কর্মী-সমর্থকরা উপজেলা সদর ও থানার সামনে বিক্ষোভ করে, অন্যদিকে তাওহিদি জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়া হয় এবং ওই সমাবেশ থেকে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে উন্মত্ত জনতা মন্দিরে মন্দিরে হামলা ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুট করতে থাকে। রামুর সেই বিভীষিকাময় ঘটনার পর নাসিরনগরে প্রায় একইরকম ঘটনা প্রত্যক্ষ করে দেশবাসী আবারও বিস্মিত হয়েছে এবং শেষোক্ত ঘটনার জন্য প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। একইসঙ্গে কিছু প্রশ্নও দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। প্রথম প্রশ্ন, এই যে সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ একের পর এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছে, প্রশাসন তথা আইনশৃংখলা বাহিনী করছেটা কী? এই দু’য়ের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্নটাও উঠেছে জোরালোভাবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই রাষ্ট্রকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খোদ সরকারের আন্তরিকতা কতটা? কারণ ‘ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে’ এই মর্মে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও প্রক্রিয়ায় ইন্ধন দিয়েছে এমন অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। এমনকি তারা কখনও কখনও সশরীরেও অংশগ্রহণ করেছেন। তৃতীয় প্রশ্ন, নাসিরনগরের ঘটনার প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা দূরের কথা, তারা এখনও সঠিকভাবে চিহ্নিত হতে পারছে না কেন?
আমরা এটাও দেখলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ তাণ্ডবে উসকানি দেয়ার অভিযোগে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের তিন ঘনিষ্ঠ সহযোগী নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে। ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে যাতে আন্দোলন না হয়, সেজন্য মন্ত্রীর অনুসারীরা হিন্দু সম্প্রদায়কে হুমকি দিচ্ছে এমন অভিযোগে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। তার মানে কী? খোদ সরকারি দলের ভেতরেই রয়েছে ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে বিভক্তি। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে খ্যাত আওয়ামী লীগে এ বিভক্তি অনভিপ্রেত।
আমরা লক্ষ্য করছি, ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে- এই জিকির তুলে স্বার্থান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাঝে মাঝেই ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষকে এমনভাবে উত্তেজিত করছে যে, তারাও হয়ে পড়ছে উন্মত্ত। সত্যি সত্যি ধর্মের অবমাননা হচ্ছ কি-না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না অথবা হলেও প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে টার্গেট হয়ে পড়ছে সামগ্রিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এ প্রবণতা বিপজ্জনক। খোদ সরকারই যদি এই আগুন নিয়ে খেলতে চায়, তাহলে মারা পড়ব আমরা সবাই। নাসিরনগরের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত দোষীদের রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে আইনের আওতায় আনতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.