আজ ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে এ দেশের রাজনীতিতে ঘটেছিল এক বড় পটপরিবর্তন। বস্তুত এই পরিবর্তন দেশের রাজনীতির মোড়ই পাল্টে দিয়েছিল। সেদিক থেকে দিবসটি ছিল আমাদের দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের বাঁক। দিবসটিকে রাজনৈতিক পক্ষগুলো ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করে থাকে। আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের দৃষ্টিতে দিবসটি সৈনিক হত্যা দিবস, বিএনপি ও সমমনারা বলছে এটি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস, অন্যদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের দৃষ্টিতে ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস। শুধু ৭ নভেম্বর নয়, এদেশের বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দেখা যায় না। কখনও কখনও ঐতিহাসিক সত্যকে আড়ালও করা হয়। মিথ্যা দ্বারা সত্য প্রতিস্থাপিত হয়। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার রাজনীতিই এর প্রধান কারণ। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক এবং আগামী প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করা অথবা বিভ্রান্ত করার নামান্তর মাত্র। আমরা মনে করি, ৭ নভেম্বরসহ যেসব দিবস অথবা ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। ৭ নভেম্বর প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, সেসব ঘটনার পেছনের কারণই বা কী অথবা ঘটনার নায়কদের উদ্দেশ্য কী ছিল, তার একটি নির্মোহ মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন। এটা এমন কোনো কঠিন কাজ নয়, শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লাভালাভের চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারাটাই এজন্য যথেষ্ট। ১৯৭৫ খুব বেশি দূর-অতীত নয়, অর্থাৎ আমরা সবাই এখনও নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি। এ অবস্থায় নির্মোহ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তাছাড়া যে কোনো ইতিহাসেই ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু না কিছু প্রতিফলন থাকে। এদিকটা বিবেচনায় নিয়ে ৭ নভেম্বরকে বুঝতে হলে আমাদের হয়তো আরও অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে, হতে পারে তা ৫০ কী ১০০ বছর। মোহের আবেশ কেটে গেলে যোগ্য ইতিহাসবিদ পেতে তখন আর বেগ পেতে হবে না।
তবে একটা কথা বোধহয় নিশ্চিন্তেই বলা যায় যে, ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের কুশীলব যারা ছিলেন, তারা প্রধানত সেনাবাহিনীর সদস্য। অথচ রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা রাজনীতিকদের দ্বারাই। এটা হয়তো আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই ব্যর্থতা যে, কখনও কখনও তাদের পরিবর্তে সেনাবাহিনী চলে আসে অথবা আসতে বাধ্য হয় রাজনীতির মঞ্চে। আমরা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে একটি দক্ষ, পেশাদার ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখতে চাই, এর বেশি বা কম কিছু নয়।
১৫ আগস্ট, ৩ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনায় আমরা বঙ্গবন্ধুসহ অনেককেই হারিয়েছি। অনাকাক্সিক্ষত রক্তপাত অনেক হয়েছে এদেশে। আমরা আর রক্তপাত দেখতে চাই না। আমরা চাই, এ দেশের রাজনীতির চালিকাশক্তি হোন শুধু রাজনীতিকরাই। ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন যে মূল্যায়ন বা অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে, আমরা নিরঙ্কুশভাবে কোনোটারই সঙ্গে সহমত পোষণ করি না, প্রকৃত ঘটনা ও তার ভিত্তিতে নির্মোহ মূল্যায়ন চাই শুধু। এ লক্ষ্যে যদি অপেক্ষা করতে হয় সেটাতেও আমরা রাজি আছি, এমনকি শতাব্দীকালও। এবার ৭ নভেম্বর উদযাপন উপলক্ষে হাল্কা উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ উত্তেজনা আর না বেড়ে প্রশমিত হবে, এটাই কাম্য। সরকার ও বিরোধী দল সব ক্ষেত্রেই শুভবুদ্ধির পরিচয় দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.