মোট ইলেকটোরাল ভোট ৫৩৮
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৯০
হিলারি ক্লিনটন ২২৮
সর্বশেষ ফলাফল
যুক্তরাষ্ট্র তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। তবে তাঁর নাম হিলারি ক্লিনটন নয়। সব ধরনের জনমত জরিপ ও পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ধনকুবের ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার সকালেও বলা হচ্ছিল, হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৮৫ শতাংশ। কিন্তু ২৯০টি ইলেকটোরাল ভোট অর্জন করে ট্রাম্প সেই হিসাব উল্টে দিলেন। চূড়ান্ত ভোট গণনার পর এই সংখ্যা ২৯৯তে উন্নীত হতে পারে। বাংলাদেশ সময় গতকাল বুধবার রাত ২টা পর্যন্ত ভোট গণনার যে হিসাব মিলেছে, তাতে ট্রাম্প ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং হিলারি ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। মোট ভোটের হিসাবে সামান্য পিছিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটের জোরে জিতে গেলেন ট্রাম্প। শুধু হোয়াইট হাউস নয়, এই নির্বাচনী জোয়ারে রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেসের উভয় কক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। শেষ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাব অনুসারে সিনেটে ৫১-৪৭ এবং প্রতিনিধি পরিষদে ২৩৮-১৯৩ আসনের ব্যবধানে রিপাবলিকান দল নিজেদের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। এর ফলে মার্কিন শাসনব্যবস্থার দুই প্রধান অঙ্গ-প্রশাসন ও আইন পরিষদের ওপর এই রক্ষণশীল দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ অর্জিত হলো। ট্রাম্পের এই অভাবিত জয়ের তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে। ওয়ালস্ট্রিটে শেয়ারের সূচকের ৩ শতাংশ পড়ে যায়। জাপানের নিক্কেই ও হংকংয়ের হ্যাংসেং সূচক যথাক্রমে ৫ দশমিক ৪ ও ২ শতাংশ নেমে যায়। ম্যাক্সিকান পেসোর মূল্য নাটকীয়ভাবে কমে যায়। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বিজয় ভাষণে একটি বিভক্ত ও তিক্ত দেশকে এক সূত্রে গাঁথার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ম্যানহাটনের একটি হোটেলে উৎফুল্ল সমর্থকদের তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে এই বিভক্তি কাটিয়ে উঠে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রকে একত্র করার। গতকাল বুধবার সকাল তিনটার দিকে হিলারি ক্লিনটন তাঁকে টেলিফোন করে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন, সে কথা উল্লেখ করে ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের প্রতি তাঁর যে অবদান, সে জন্য তাঁর প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।’ কীভাবে এই অভাবিত বিজয় সম্ভব হলো, সে কথা বুঝতে পণ্ডিতেরা এখনো মাথা চুলকাচ্ছেন। বলা হয়েছিল, ট্রাম্পের পক্ষে জেতার পথ খুবই সংকীর্ণ, কার্যত অসম্ভব। এ জন্য তাঁকে নিদেনপক্ষে একটি ডেমোক্রেটিক নিয়ন্ত্রিত রাজ্য নিজের দখলে আনতে হবে। পণ্ডিতদের কথা ভুল প্রমাণ করে ট্রাম্প পেনসিলভানিয়া, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলাইনা ও ওহাইও অঙ্গরাজ্যে জয়ী হন। এমনকি ডেমোক্র্যাটদের জন্য নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত উইসকনসিনেও ট্রাম্প জয়ী হন। এই রাজ্যে তাঁর বিজয়ের ব্যাপারে হিলারি এতটা নিশ্চিত ছিলেন যে সেখানে তিনি একবারের জন্যও নির্বাচনী প্রচারে আসার প্রয়োজন মনে করেননি।
ভোটকেন্দ্র-ফেরত ভোটারদের প্রশ্নোত্তর থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিক তাঁদের চলতি শাসনব্যবস্থায় গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। শুধু ডেমোক্র্যাট নয়, রিপাবলিকান নেতৃত্বের প্রতিও তাঁদের গভীর ক্ষোভ। ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে পেশাদার রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ নিজেদের বিদ্রোহ প্রকাশ করেছে, এ কথা বলা মোটেই অযৌক্তিক নয়। এই বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন এমন একজন বহিরাগত, যাঁর প্রতি নিজ দলের অধিকাংশ নেতাই সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। অনেকেই বলেন, তাঁরা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দেবেন না। শেষ বিচারে দেখা গেল, রাজনীতিকদের সমর্থন তাঁর প্রয়োজন ছিল না। প্রধানত স্বল্পশিক্ষিত ও কর্মজীবী শ্বেতকায় ভোটারদের সমর্থনেই নির্বাচনী বৈতরণি পেরোতে সক্ষম হন ট্রাম্প। এমনকি আফ্রিকান-আমেরিকান ও হিস্পানিকদের মধ্যেও ট্রাম্প প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছেন।
শুধু সংখ্যার হিসাবে নয়, যে পদ্ধতিতে ট্রাম্প এই বিজয় অর্জন করেন, তা-ও ছিল সম্পূর্ণ প্রচলিত নিয়মবিরুদ্ধ। এটি ছিল ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনদের বিজয়। তিনি বারবার বলেছেন, মার্কিন শাসনব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত। তিনি ওয়াশিংটনে সবাইকে ‘ঝেঁটিয়ে’ বিদায় করার ডাক দিয়েছিলেন। নিজে একজন ধনকুবের হওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশের ক্ষমতাবান ‘এলিট’ শ্রেণির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি ব্যাংক ও ব্যবসায়ী শ্রেণির বিরুদ্ধেও দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। সেই অর্থে এটি ছিল এলিট শ্রেণির বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীনদের বিপ্লব। ঠিক এই বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। কিন্তু ডেমোক্রেটিক ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধতা এড়িয়ে দলের প্রার্থী হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ট্রাম্প নিজেও দলের ক্ষমতাবানদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক ভূমিকম্পে তিনি তাঁদের সবাইকে পরাজিত করতে সক্ষম হন।
ট্রাম্পের এই বিজয় শুধু হিলারির পরাজয় নয়, প্রেসিডেন্ট ওবামারও পরাজয়। নিজের উত্তরসূরি হিসেবে ওবামা হিলারির সমর্থনে সরাসরি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। ট্রাম্পকে পরাজিত করা তাঁর জন্য ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ট্রাম্প তাঁর জন্মস্থান প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করে এক গভীর বর্ণবাদী রাজনীতিকে উসকে দেন। ওবামার শাসনামলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আইনগত বিজয়, স্বাস্থ্যবিমা আইন, যা ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত, সেটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে যে আন্তর্জাতিক চুক্তির পক্ষে ওবামা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন, তা বাতিলের কথাও বলেছেন ট্রাম্প। সুপ্রিম কোর্টে আরও একজন উদারনৈতিক বিচারক নিয়োগের অপেক্ষায় ছিলেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের সব অর্জন এখন বাতিল করার সুযোগ পাবেন এমন একজন, যিনি নিজেকে খোলামেলাভাবে শ্বেত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কথা প্রকাশ করেছিলেন। ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিলেন ওবামা। বৃহস্পতিবার সেই ট্রাম্পকে তিনি হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানাবেন।
ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশিসহ অধিকাংশ অভিবাসীর জন্য এক বড় ধাক্কা। তিনি সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে দেশ থেকে বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে আগমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলেছেন। এ দুই প্রতিশ্রুতি পূরণের সুযোগ এখন তাঁর সামনে। এ দুই প্রস্তাবই বাস্তবসম্মত নয়। তা সত্ত্বেও যে লাখ লাখ শ্বেতকায় মানুষ তাঁর পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যাশা পূরণে ট্রাম্পকে প্রতীকী হলেও কোনো না কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এক ‘সুনামি’র আশা করেছিলেন। বাস্তবে ঘটল ঠিক বিপরীত। ঠিক কী কারণে এই বিপর্যয়, এখন তাঁরা তা নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন। ই-মেইল কেলেঙ্কারি, এফবিআইয়ের তদন্ত এবং প্রার্থী হিসেবে হিলারির ‘দুর্বলতা’কে তাঁরা বিপর্যয়ের প্রধান বলে বিবেচনা করছেন। হিলারির প্রতি অসন্তুষ্ট তরুণ ভোটারদের একাংশের ভোট গেছে লিবারটারিয়ান প্রার্থী গ্যারি জনসনের দিকে। সেটিও বিপর্যয়ের একটি কারণ।
যুক্তরাষ্ট্র তাঁর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে, এমন এক সম্ভাবনায় যাঁরা উচ্চকিত ছিলেন, এখন এক গভীর ও ব্যাখ্যার অতীত নিরাশায় তাঁরা নিমজ্জিত। এঁদের সবার মনোভাব এককথায় প্রকাশ করেছেন ওবামার সাবেক উপদেষ্টা ও সিএনএনের ভাষ্যকার ভ্যান জোন্স। তাঁর কথায়, ‘আমরা সবাই এক অলৌকিক সম্ভাবনার অপেক্ষায় ছিলাম। তার বদলে আমরা পেলাম এক দুঃস্বপ্ন।’ তিনি বলেন, ‘একজন বুলি বা ভাড়াটে গুন্ডা দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, এ কথা এখন আমরা কীভাবে নিজের ছেলেমেয়ের কাছে ব্যাখ্যা করব?’
এই প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.