সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হলেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামী চার বছর বিশ্বরাজনীতি আরও অস্থির ও বেসামাল হবে কি না, আমেরিকান সমাজের বিভেদ বাড়বে কি না, সেটি নির্ভর করবে তাঁর গৃহীত নীতি ও কর্মসূচির ওপর। বলতে হবে, ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের কপাল খারাপ। ট্রাম্পের চেয়ে লক্ষাধিক ভোট বেশি পেয়েও এই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডিকে হার মানতে হয়েছে। মার্কিন নির্বাচন–পদ্ধতিতে পপুলার বা গণভোট দিয়ে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় না। তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যিনি ইলেকটোরাল কলেজের ভোট বেশি পান। ৫৩৮ ইলেকটোরাল কলেজের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন ২৯০ এবং হিলারি ক্লিনটন ২২৮। যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি অনেক দিক দিয়েই ব্যতিক্রমী। নতুন প্রেসিডেন্ট একজন সফল ব্যবসায়ী হলেও রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। তিনি একটি জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য যখন দলীয় মনোনয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন অধিকাংশ মার্কিন ভাবতে পারেননি যে ট্রাম্পই মনোনয়ন পাবেন। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালেও তিনি অনেক নাটক করেছেন। কখনো ভোট কারচুপির আশঙ্কা করেছেন, কখনো তাঁর সমর্থকদের দুটি করে ভোট দিতে বলেছেন। যৌন কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর একবার তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহারেরও গুঞ্জন উঠেছিল। আমেরিকার প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলো তাঁকে উপস্থাপন করেছিল একজন খলনায়ক হিসেবে। সেই খলনায়ক এখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তবে আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো, নির্বাচনের আগে দলীয় প্রচারকালে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন যতই বাদানুবাদ করুন না কেন, নির্বাচনের পর তাঁরা পরস্পরকে সম্মান দিয়ে ও সমীহ করে কথা বলেছেন। ফল প্রকাশের পরপরই হিলারি টেলিফোনে ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বুধবার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে পাশে নিয়ে সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ আমাদের ধারণার চেয়েও বেশি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের উচিত ট্রাম্পকে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেওয়া।’ হিলারি বলেন, ‘এটা কষ্টদায়ক। কিন্তু আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমাদের প্রচার কখনো এক ব্যক্তি বা একটি নির্বাচনের জন্য ছিল না। আমি ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছি এবং একসঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছি। আশা করি, সব আমেরিকানের জন্য তিনি একজন সফল প্রেসিডেন্ট হবেন।’
অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের পর নিউইয়র্কে দলের প্রচার সদর দপ্তরের সামনে সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি মাত্রই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারির কাছ থেকে ফোন পেয়েছি। তিনি আমাদের জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কঠিন লড়াইয়ের জন্য আমিও তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘হিলারি দীর্ঘ এবং কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে কাজ করেছেন এবং দেশের জন্য কাজ করায় তাঁর কাছে আমাদের অনেক ঋণ।’ রিপাবলিকান, ডেমোক্রেটিক ও ইনডিপেনডেন্ট পার্টির সবার প্রতি একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার বিভক্তির ক্ষত জোড়া দেওয়ার, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখন সময়। প্রত্যেক নাগরিকের কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হব এবং এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ যুক্তরাষ্ট্রের যে নাগরিকেরা তাঁকে সমর্থন করেননি, তাঁদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একসঙ্গে কাজ করতে এবং আমাদের এই মহান দেশকে একতাবদ্ধ করতে পথনির্দেশনা এবং সহায়তার জন্য আমি আপনাদের দিকে হাত বাড়াচ্ছি।’
নির্বাচনী প্রচারের সময়ে নানা মন্তব্যের কারণে আলোচিত-সমালোচিত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়-উত্তর ভাষণ ছিল একদমই আলাদা। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ের জন্য যত অপকৌশলই নিন না কেন, বিজয়ের পর পাল্টে যাবেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি বাস্তবমুখী পদক্ষেপই নেবেন। অনেকে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে ভারতের বিগত লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির ভাষাভঙ্গির তুলনা করে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। মোদিও নির্বাচনী প্রচারে কথিত অভিবাসী খেদাও স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি কংগ্রেসকে তুলাধোনা করেছিলেন। এখন তিনি অভিবাসী প্রশ্নে নীরব এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি নিয়েছেন।
এবার দেখা যাক আমেরিকার নির্বাচনী উত্তাপটা প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে বুড়িগঙ্গার তীরে কেমন অভিঘাত সৃষ্টি করল। আমরা সবাই জানি, বুড়িগঙ্গার পানি অত্যন্ত ময়লাযুক্ত, ব্যবহারের অনুপযোগী। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের মনটা বর্ষার টলটলে পানির মতো পরিষ্কার, তা বলা যাবে না। এ কারণে আমেরিকায় যখন নির্বাচনী ঝগড়া মিটমাট হয়ে গেল (যদিও বিভিন্ন শহরে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলছে), তখন সেই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ঝগড়াটা চাঙা হয়ে উঠল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও বিএনপির চেয়ারপারসন—সবাই অভিনন্দন জানিয়েছেন। এটাই রীতি। হিলারি জিতলেও তাঁরা অভিনন্দন জানাতেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রাম্পকে কেবল অভিনন্দন জানাননি; তিনি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। আমরা এত দিন জানতাম, উদার ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই আওয়ামী লীগের এবং রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের সঙ্গে বিএনপির একটি আদর্শগত মিল আছে। এখন দেখা যাচ্ছে উল্টোটাই ঘটছে। রক্ষণশীলদের আওয়ামী লীগ কাছে টানছে এবং উদারপন্থীদের ঠেলে দিচ্ছে বিএনপির দিকে।
বিএনপির নেতা রুহুল কবির রিজভী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছে ডেমোক্রেটিক পার্টি, জিতেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মতামতেরই প্রতিফলন হয়েছে। বুধবার নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন থেকে যদি প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা নেন, তাহলে তিনি সত্য কথা বলবেন। তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ের কথা বলেন। আমার মনে হয়, এসব বলার ক্ষেত্রে ওনার মধ্যে কিছুটা লজ্জা আসবে।’ (প্রথম আলো, ১০ নভেম্বর ২০১৬)
পরদিনই এর কড়া জবাব দিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপিকে নীতিহীন ও নীতিবিবর্জিত দল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচন থেকে আপনারাও শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করুন। এটাই শিক্ষা নিন যে জনগণই সব ক্ষমতার মালিক। জনগণের বাইরে ষড়যন্ত্র করে কিছু হয় না।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এই নেতা আরও যোগ করেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কে নির্বাচিত হবেন, তা নির্ধারণ করবেন সেই দেশের ভোটাররা। বিএনপি কখনো জনগণের প্রতি আস্থাশীল নয়। তারা সব সময় ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসী। যেসব দেশের আন্তর্জাতিকভাবে একটা প্রভাব আছে, তারা সব সময় সেসব দেশের নির্বাচনের দিকে চেয়ে থাকে। আগবাড়িয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। এগুলো করে যে কোনো লাভ হয় না, তা সম্প্রতি আমাদের দেশের পার্শ্ববর্তী দেশের নির্বাচনের ফলাফলে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন।’
হানিফ ও রিজভী—দুজনই দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিবের অনুপস্থিতিতে তাঁরা নিজ নিজ দলের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলেন। সেই দুই নেতা যখন পরস্পরকে আমেরিকার নির্বাচন থেকে শিক্ষা নিতে বলেন, তখন সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয় বৈকি। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকতে রিপাবলিকান প্রার্থীর বিজয় থেকে শিক্ষা নিতে বলেছেন রিজভী সাহেব। কিন্তু সে জন্য তো নির্বাচনে আসতে হবে, নির্বাচন বর্জন করে কিংবা লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষা নেওয়া যাবে না। আবার হানিফ সাহেব তাঁর প্রতিপক্ষকে জনগণ যে ক্ষমতার মালিক, সে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ কথার অর্থ হলো, জনগণ যাঁকে চাইবে, তিনিই ক্ষমতায় থাকবেন বা আসবেন। কথা হলো, বাংলাদেশে সেই সুযোগ কতটা আছে? ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও পরবর্তী স্থানীয় সরকারের সব কটি নির্বাচনে তারা অংশ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে কি জনগণের প্রতিফলন ঘটেছে, সে কথা আওয়ামী লীগের নেতারাও বলতে পারবেন না। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এতটাই বিশৃঙ্খল ও সংঘাতপূর্ণ ছিল যে, তাঁরাও বিব্রত বোধ করেছেন।
তাই আমরা মনে করি, আমেরিকার নির্বাচন থেকে দুই পক্ষেরই শিক্ষণীয় আছে। সেখানে যে দলই জয়ী হোক না কেন, কেউ ভোট কারচুপির অভিযোগ আনেনি। সেখানে নির্বাচনী প্রচারের সময় যতই কাদা-ছোড়াছুড়ি হোক না কেন, নির্বাচনের পর বিজয়ী ও বিজিত—উভয়ই একযোগে কাজ করার কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান দল থেকে। সিনেট ও কংগ্রেসেও তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এর মানে এই নয় যে তাঁরা দেশ পরিচালনায় ডেমোক্র্যাটদের কোনো কথাই শুনবেন না। আর ডেমোক্র্যাটরাও নির্বাচনের পরদিন থেকে মানি না মানব না বলে মাঠ গরম করবেন না। আমেরিকায় নির্বাচনে হারলে বিজিত পক্ষ যেমন জনগণের রায় মেনে নেয়, তেমনি বিজয়ী পক্ষ বিজিতদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এই শিক্ষাটুকু আমাদের দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মনে রাখলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত।
পাদটীকা: লেখাটি যখন শেষ করেছি, তখনই পত্রিকায় দেখলাম, সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিএনপি সমর্থন করেছে বলেই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন হেরেছেন। খবরটি পড়ে এক বন্ধু মন্তব্য করলেন, তাহলে তো আগামী নির্বাচনে বিএনপির উচিত হবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা। অন্য কোনো উপায়ে আওয়ামী লীগকে হারানোর উপায় আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.