২৬ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক সিটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্যাসিনোতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেশ আনন্দেই কেটেছিল সারাটা দিন। তখন ঘুণাক্ষরেও এটা মনে হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি যে এই ভদ্রলোকের হাতে একদিন পৌঁছে যাবে জাদুর কাঠি, যা দিয়ে তিনি পুরো দুনিয়াটাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। বলা চলে, সব পূর্বাভাসকে কাঁচকলা দেখিয়ে ট্রাম্প বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। এখন শুরু হবে নানা রকমের সুরতহাল। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে আগ্রহের কমতি ছিল না। নানা কারণেই এ দেশের জনমত ছিল হেভিওয়েট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে। তিনি এ দেশে দুবার এসেছেন। প্রথমে ফার্স্ট লেডি এবং পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সবার পরিচিত। এ দেশে বেড়াতে এসে গ্রামে গিয়ে তিনি শাড়ি পরে ছবিও তুলেছেন। তাঁকে মনে হতো কাছের মানুষ। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প জন-আলোচনায় এসেছেন মাত্র বছর খানেক আগে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে শামিল না হলে তিনি অগোচরেই থেকে যেতেন। তাঁকে এ দেশের মানুষ চেনেন না। তাঁর জিতে যাওয়াটা একটা অঘটনের মতোই মনে করেন এ দেশের অনেক মানুষ। তবে এটা সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশিরা ভোট দেন না। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা তাঁকে পছন্দ করেছেন। একটা লোক ভালো কি মন্দ, তার চেয়েও বড় হলো, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে নির্বাচিত। এটাই হলো গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। চার বছর পরপর যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের মেলা বসে, তখন আমাদের দেশের আকাশ ছেয়ে যায় আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের পতাকায়। কিন্তু আমরা চাইলেই তো আর তারা বিশ্বকাপ জিতবে না! ওই কাপ খেলে জিততে হয়। লড়াই করেই ট্রাম্প জিতেছেন। তাঁকে অভিনন্দন। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আমাদের ধারণা বেশ নেতিবাচক। এ দেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত স্লোগানগুলোর একটা হলো ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, তো ওই ‘সাম্রাজ্যবাদী’ দেশের মধ্যেও আমাদের কিছু বাছবিচার থাকে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন ওই দেশের ভোটাররা। এ দেশে হোক কিংবা ওই দেশে, মূলধারার গণমাধ্যম এলিট–নিয়ন্ত্রিত। সেখানে হিলারির প্রতি পক্ষপাত ছিল। হিলারি নিজেও উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত ও অভিজ্ঞ। চালচলনে অনেকটাই অগোছালো, গোঁয়ারগোবিন্দ ট্রাম্প আলোকপ্রাপ্তদের সমাজের বৈঠকখানায় জায়গা পাননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত তরুণদের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ট্রাম্পের পক্ষে ছিল। ট্রাম্প একটা ধারণা জাগাতে পেরেছিলেন; তিনি ‘সাধারণের’। সে জন্যই হিসাব-নিকাশ অনেকটাই পাল্টে গেছে। তবে প্রত্যেক ভোটারের মনের কুঠুরিতে ঢুকে তো জানা যাবে না তাঁরা কী কারণে কাকে ভোট দিয়েছেন? আমরা শুধু আমাদের নিজস্ব আন্দাজকে প্রথাগত ছাঁচে ফেলে মন্তব্য করতে পারি। বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়ার মতো পণ্ডিতের অভাব নেই সে দেশে এবং এ দেশে। ইতিমধ্যে অনেকেই হামলে পড়েছেন টক শোতে এবং তাঁরা মার্কিন নির্বাচনের ব্যবচ্ছেদ করে যাচ্ছেন। রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের খুব আলাদা করার সুযোগ নেই। দুনিয়াজুড়ে অশান্তি সৃষ্টিতে কোনো পক্ষই কম যায়নি। হিলারিকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের খুব কারণ নেই। ‘আরব বসন্তের’ নামে তিনি উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার অনেক দেশ তছনছ করে দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটরা একসময় গণতন্ত্র রপ্তানি করার নামে ভিয়েতনামে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান পাঠিয়েছিল। ভিয়েতনামের সবুজ জমিন বোমার আঘাতে তামাটে হয়ে গিয়েছিল। রিপাবলিকানদের আমলে ওই যুদ্ধের একটা নিরসন হয়। কিউবায়ও আক্রমণ চালিয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রশাসন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মুখোমুখি হয়ে কেনেডি প্রশাসন তখন বিশ্ববাসীর ঘাড়ের ওপর গরম নিশ্বাস ছাড়ছিল। শেষমেশ যুদ্ধটা এড়ানো গেছে। কিন্তু কিউবা পড়ে গিয়েছিল অর্থনৈতিক অবরোধের কবলে। অবশেষে ডেমোক্র্যাট প্রশাসনের আমলেই জলপাইগাছের শাখা হাতে নিয়ে বারাক ওবামা হাভানা সফর করলেন। অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হলো। কিন্তু পাঁচ দশক ধরে চরম মূল্য দিতে হলো কিউবার মানুষকে। অবরোধের পরিণাম যে কী দুঃসহ, তা কিউবার মানুষ ভালোভাবেই বোঝেন। আর আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়া নিয়ে রিপাবলিকানরা যা করল, তার খেসারত তো বিশ্ববাসী এখনো দিচ্ছে। বাংলাদেশে বসে আমরাও তার আঁচ পাই। আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পানি অবরোধের শিকার। ৫৪টি অভিন্ন নদীর জল আমাদের দেশে ঢুকবে কি না, অথবা ঢুকলেও কখন ও কী পরিমাণে ঢুকবে, তা নদীর ইচ্ছার ওপর আর নির্ভর করে না। এ জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। তো সেখানে যে দলের সরকারই থাকুক, এ ব্যাপারে সবাই উগ্র ভারতীয়। মাঝখানে মূলধারার রাজনীতির বাইরে গিয়ে সাবেক ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এবং দেব গৌড়ার প্রশাসন পানি অবরোধ তুলে নিয়েছিল। তবে সেটা শুধু গঙ্গার বেলায়। এখন তিস্তার পানির জন্য আমরা চাতক পাখির মতো পশ্চিমে তাকিয়ে আছি, আর অপেক্ষা করছি কবে তাদের মনের বরফ গলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ভূরাজনীতি ও বিদেশনীতি বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোই জনমতকে প্রভাবিত করে। এবারও তা–ই হয়েছে। ট্রাম্প ছোটখাটো ভোটব্যাংকের পরোয়া করেননি। তাঁর নজর ছিল বড় ভোটব্যাংকটি। অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। তারপরও তিনি হিলারির ভোটব্যাংকে হাত বসাতে পেরেছেন। সর্বশেষ এক্সিট পোলে দেখা গেছে, ২৯ শতাংশ লাতিনো ভোট ট্রাম্পের পক্ষে গেছে। সব নারী হিলারিকে ভোট দেননি। আফ্রিকান-আমেরিকানদের অনেকেই ট্রাম্পের পক্ষ নিয়েছেন। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে সৌদি আর কাতারের অনুদান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কেননা, জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে তারাই টাকার জোগান দেয় বলে অভিযোগ আছে। শেষমেশ উইকিলিকসের ফাঁস করা হিলারির হাজার হাজার ই-মেইল জনমনে একটা ধারণা জন্মাতে সাহায্য করেছে যে, হিলারি এতটা ‘বিশ্বস্ত’ নন। হয়তো এসব ফ্যাক্টরও কাজ করেছে হিলারির বিপক্ষে। হিলারির পক্ষে যাঁরা প্রচার চালিয়েছেন, তাঁদের কথাবার্তায় অনেক চটক ছিল। শব্দচয়নে তাঁরা ছিলেন খুবই পারঙ্গম। কিন্তু অনেককেই বলতে শোনা গেছে, এঁরা হলেন ‘প্রফেশনাল লায়ার্স’ (পেশাদার মিথ্যুক)। তবে সব ছাপিয়ে উঠেছে পরিবর্তনের প্রত্যাশা। যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচন ভারতের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কংগ্রেসের প্রচারণায় উন্নয়নের ফিরিস্তি ছিল, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের বরাবরই একটা ইতিবাচক সমীকরণ ছিল। তবু ভারতীয় জনতা পার্টি সারা দেশে ‘হিন্দুত্ববাদের’ একটা জোয়ার তুলতে সমর্থ হয় এবং সেই জোয়ারে কংগ্রেসসহ অন্যান্য দল খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডা হাতে নিয়ে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি এখন ভারতের রাজনীতির নিয়ামক। ডোনাল্ড ট্রাম্পও একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদ তৈরি করতে পেরেছেন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর পুনরুত্থানের বাগাড়ম্বর ছিল। নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেন। প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছিটান। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। নরেন্দ্র মোদি এখন কথাবার্তায় অনেকটাই সংযত। হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁর একগুঁয়ে মনোভাব ঝেড়ে ফেলে সত্যিকার অর্থেই ‘নাইস গাই’ হওয়ার চেষ্টা করবেন। নির্বাচনের ফলাফল যখন পরিষ্কার হয়ে এসেছে, তখন ট্রাম্প তাঁর প্রথম ভাষণে যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। এই সুরে তিনি কথা বলেননি অনেকগুলো মাস। তাঁর কণ্ঠে ছিল রিকনসিলিয়েশনের সুর। প্রতিপক্ষ হিলারিকে প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেননি। এটাই পশ্চিমা গণতন্ত্রের মহিমা। এখন যুদ্ধ শেষ। তাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং কাদা-ছোড়াছুড়িও শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। হিলারিও নির্বাচনোত্তর ভাষণে নতুন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়ে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি নির্বাচনে স্থূল বা সূক্ষ্ম কোনো ধরনের কারচুপির অভিযোগ করেননি। আমাদের দেশে আমরা নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জারি হওয়া জঙ্গ নির্বাচনের পরও জারি রাখি, এমনকি অনেক সময় মুখ দেখাদেখিও বন্ধ থাকে। আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের কাছ থেকে সহবৎ শিখতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা অম্লমধুর। আমাদের দেশের অনেকেই ওই দেশে অভিবাসী হয়েছেন। আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রধান গন্তব্য হলো যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আমাদের পক্ষে ‘উদ্বৃত্ত’; সম্প্রতি জিএসপি নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের কিছুটা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই আমাদের কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা ও মন্ত্রীকে দায়িত্বহীন মন্তব্য করতে শুনি। এটা ঠিক নয়। আমাদের জাতীয় স্বার্থেই তাদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। এই পৃথিবী চলে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। যাঁরা সমালোচক, তাঁদের তো দায়িত্ব নিতে হয় না! আমাদের অর্থনীতিটা যত দিন না একটা টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়াচ্ছে, আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই সমঝে চলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালক্ষেপণ না করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সস্ত্রীক ঢাকায় বেড়িয়ে যেতে নেমন্তন্ন করেছেন। জসীমউদ্দীনের কবিতার অনুকরণে বলা যায়, ‘আমার বাড়ি এসো বন্ধু বসতে দেব পিঁড়ে’। এটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক উদ্যোগ। তিনি এ দেশে আসবেন কি না, তা নির্ভর করে আমাদের কূটনৈতিক সক্ষমতার ওপর। ট্রাম্পকে স্বাগত জানানো ব্যক্তিদের সামনের কাতারে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁরা সবাই আমাদের বন্ধু। স্বাগত জানানো ব্যক্তিদের তালিকা থেকে ট্রাম্পের অনুরাগী কারা, তা হয়তো চটজলদি বোঝা যাবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন থাকলে তা জাতীয় স্বার্থের অনুকূলেই থাকবে। তৃতীয় ছাগশিশুর মতো লাফালাফি না করে আমাদের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে টানাপোড়েনের ঝামেলা যথাশিগগির মিটিয়ে ফেলা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.