দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অবলোপন ৪২ হাজার ৩২২ কোটি এবং খেলাপি ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসেই অবলোপন করা হয়েছে ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। এর অধিকাংশই সরকারি ব্যাংকের মন্দ বা খারাপ ঋণ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, সম্প্রতি ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণে বড় অনিয়ম-জালিয়াতির বিরাট অংশই অবলোপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে এই অপকৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে।
অবলোপনের পর ঋণ আদায়ে জোরদার ব্যবস্থা নেয়ার নিয়ম থাকলেও সেই তৎপরতা দেখা যায় না।
অবলোপন করা ঋণও প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাবি করে সূত্র বলছে, ব্যাংকের মন্দ বা ক্ষতিকর মানের খেলাপি ঋণ, যা আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই নেই, সেসব ঋণকে আর্থিক হিসাবের সুবিধার্থে ব্যাংকের স্থিতিপত্র বা ব্যালেন্সশিট থেকে বাদ দেয়া হয়।
এর ফলে ওই সব অনাদায়ী ঋণ লোকচক্ষু ও খেলাপি হিসাবের আড়ালে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার সুযোগ নিয়েই ২০০২ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। এই নীতিমালার আওতায় পাঁচ বছর কিংবা তার বেশি সময় ধরে থাকা খেলাপি ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রেখে তা অবলোপন করা হয়। ঋণ অবলোপন করতে মামলা থাকতে হয় এবং শতভাগ সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া ঋণ মন্দ হলেই অবলোপন করে ফেলছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এর মাধ্যমে আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখানোর সুযোগ নিচ্ছে এসব ব্যাংক।
এর ফলে প্রতিবছরই অবলোপন করা ঋণ আশংকাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আগে মামলা দায়ের না করে ঋণ অবলোপনের কোনো সুযোগ ছিল না। এখন মামলা না করেই ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ অবলোপনের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েক বছর দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী ঋণ অবলোপন করতে হচ্ছে। এছাড়া কোনো পথও খোলা নেই। সে কারণে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে। এটি উদ্বেগজনক।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে অশুভ প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। অনেক ব্যাংকই ঋণগ্রহীতা অন্য ব্যাংকে চলে যেতে পারে এমন আশংকা থেকে বাছ-বিচার ছাড়াই ঋণের অনুমোদন দেয়। এতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার ঋণখেলাপিদের শাস্তি না হওয়া এবং অর্থঋণ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকার কারণে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমছে না বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, যে খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি খুবই খারাপ তা অবলোপন করতে পারে। তবে ঋণ যেন বিশেষ যত্ন নিয়ে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। যদি শুধু ব্যালেন্সশিট পরিষ্কার করার জন্য ঋণ অবলোপন করা হয় তা মোটেও ঠিক হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসেই ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৮৮৪ কোটি টাকা। আর এ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে অবলোপন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা।
এই টাকা প্রায় দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমান। প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত জুন পর্যন্ত সরকারি সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট এই ৬ বাণিজ্যিক ব্যাংকে অবলোপন করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৪৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
এ সময় পর্যন্ত বিশেষায়িত দুই ব্যাংক অবলোপন করেছে ৫৫৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ অবলোপন করেছে ১৮ হাজার ৯৩৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর বিদেশী ব্যাংকগুলোতে অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
অন্যদিকে ২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি ঋণ অবলোপন করা হয়। ওই বছর অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে অবলোপন করা হয় ৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।
সূত্রগুলো বলছে, অবলোপন করা খেলাপি ঋণ আদায়ে বিভিন্ন ব্যাংকে আলাদা সেল রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কোনো ব্যাংকই ওই ঋণ আদায় করতে পারছে না। অন্যদিকে, বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম. রাজনৈতিক চাপ ও তদবিরে ব্যাংকের পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাছ-বিচার ছাড়া ঋণ অনুমোদন, বিভিন্ন অজুহাতে ঋণগ্রহীতা কর্তৃক সময়মতো ঋণ ফেরত না দেয়ার সংস্কৃতির কারণে প্রতি বছরই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। যার বড় অংশ নির্দিষ্ট সময় শেষে মন্দ ঋণে পরিণত হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.