খেলাপি ঋণ সমস্যা থেকে ব্যাংকিং খাতের কি মুক্তি নেই? এ ঋণের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এখন দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে অবলোপনের পরিমাণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে ঋণ অবলোপন বেড়েছে ৮৮৪ কোটি টাকা। এ নিয়ে ব্যাংকিং খাতে অবলোপন করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৩২২ কোটি টাকায়। এ টাকা প্রায় দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের সমপরিমাণ। বিষয়টি উদ্বেগজনক। মূলত মন্দ খেলাপি ঋণই অবলোপন করা হয়। যে ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা একেবারেই নেই, সেসব ঋণকে আর্থিক হিসাবের সুবিধার্থে ব্যাংকের স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেয়া হয়। ফলে ওই অনাদায়ী ঋণ খিলাপি হিসাবের আড়ালে চলে যায়। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির মূল কারণ দুর্নীতি। বাছবিচারহীনভাবে ঋণ প্রদানের কারণেও খেলাপির পরিমাণ বাড়ছে। এর চেয়েও বড় কারণ, ঋণখেলাপিদের শাস্তি না হওয়া, মামলা হলেও তার দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়া। জানা যায়, অর্থঋণ আদালতে এ সংক্রান্ত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
বস্তুত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির দায় ব্যাংকগুলোর ওপরই বর্তায়। বাণিজ্যিক ব্যাংক যে সেবামূলক লাভজনক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকপক্ষ তথা কিছু পরিচালক এ কথা ভুলে গিয়ে একে ব্যবহার করছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হাতিয়ে নেয়ার মেশিন হিসেবে। জানা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের ১৫ শতাংশই নিয়েছেন ব্যাংক পরিচালকরা। উল্লেখ্য, পরিচালকদের নিজের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার বিধান নেই। তাই এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের সঙ্গে সমঝোতা করে ঋণ নিচ্ছেন। এভাবে তারা প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন!
সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখেন নিরাপত্তার কথা ভেবে। সেই আমানতের টাকা ব্যাংক পরিচালকরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন! আবার সেই ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপি হয়ে একপর্যায়ে তা অবলোপনও করছেন! এ শুধু উদ্বেগের বিষয় নয়, অবাক করা ব্যাপারও বটে! এ চিত্র সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক উভয় খাতেরই। সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের পরিচালকরা সরাসরি ব্যাংকের মালিক না হলেও পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে মালিকের ভূমিকায়ই অবতীর্ণ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা নিজেরা ঋণ না নিলেও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বড় অংকের ঋণ দিতে তৎপর থাকেন। এসব দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রতিরোধ করা কি এতই কঠিন?
ব্যাংক পরিচালকরা এভাবে নিজেদের মধ্যে ঋণ ভাগাভাগি করে নেয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তারা। বস্তুত এই পরিচালকদের কারণেই ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ঋণের সুদ যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে না আনার এটি একটি বড় কারণ। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ছে না। গড়ে উঠছে না নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিদ্যমান শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোরও সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের পথ। তাছাড়া ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের কারণে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছে রফতানি খাত। এটা চলতে দেয়া যায় না। ব্যাংকিং খাতকে ঋণ খেলাপির অপসংস্কৃতি থেকে বের করে আনতে হবে যে কোনো উপায়ে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.