ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ ও ঋণ অবলোপন আশংকাজনক হারে বাড়ছে। কমছে না ঋণের সুদের হার। বরং অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে, খেলাপি ঋণের কারণে সুদের হারের লাগাম টানা যাচ্ছে না। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ঋণখেলাপি নন দেশের এমন ভালো শিল্পোদ্যোক্তারা।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে মোট খেলাপি ঋণ প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে নিয়মিত হিসাবে খেলাপি ঋণ ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। আর হিসাবের বাইরে অর্থাৎ দীর্ঘদিন খেলাপি থাকার পর যে ঋণ আদায় করতে পারছে না বা আদায়ের কোনো সম্ভাবনাও নেই, তেমন ঋণ অবলোপন করা হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। খেলাপির এ চিত্র ব্যাংকিং কার্যক্রমের শুরু থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। তবে অবলোপন শুরু হয় ২০০২ সাল থেকে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এভাবে চলতে থাকলে দেশে শিল্প বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়বে। তাদের দাবি, অবিলম্বে এ সেক্টরের ভয়াবহ দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্র বন্ধ করে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক। এজন্য সরকারকে কঠোর হস্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার না কমার পেছনে খেলাপি ঋণ একমাত্র কারণ নয়। এর বাইরেও অনেক কারণ রয়েছে। তাছাড়া খেলাপি ঋণ হচ্ছে ব্যাংকার ও ব্যাংক মালিকদের কারণে। প্রশ্ন হল- তারা যাচাই-বাছাই ছাড়া ঋণ দিচ্ছে কেন। তিনি বলেন, ব্যাংকের খরচ কমাতে হবে। একেক জন এমডি-ডিএমডির বেতন ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা। এসব উচ্চ খরচের দায় এসে পড়ছে গ্রাহকের কাঁধে। তিনি মনে করেন ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় না কমালে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও কমবে না।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যাচ্ছে না। চলতি বছরের ২৬ জুলাই মুদ্রানীতি ঘোষণার লিখিত বক্তব্যের একস্থানে উল্লেখ করা হয়, ‘ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের মাত্রা প্রতিবেশী ও তুলনীয় দেশগুলোর চেয়ে বেশি থাকায় ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাস মন্থর রয়েছে। বাজারে ঋণ সুদহার কমাবার জন্য ব্যবসায়ী মহল দাবি করে থাকেন, তবে ঋণ বাজারে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং যথাযথ ঋণ পরিশোধ শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করেই কেবল ঋণ সুদহার কার্যকরভাবে কমানো সম্ভব হবে।’
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানো যাচ্ছে না। এছাড়া আরও অনেক আনুষঙ্গিক বিষয় রয়েছে।
ব্যাংক এমডিদের সংগঠন এবিবির সাবেক সভাপতি ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার না কমার জন্য খেলাপি একমাত্র এবং বড় কারণ নয়। তার মতে, ব্যাংক ঋণের সুদের হার উঠানামা নির্ভর করে বিনিয়োগ ও পণ্যের চাহিদা এবং জোগানের ওপর। অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোসহ বিনিয়োগের পরিবেশ কতটা মসৃণ- এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমানে সবচেয়ে ভালো গ্রাহক ৯ শতাংশ, তার চেয়ে একটু কম ভালো ১১ শতাংশ ও মোটামুটি চলে তেমন গ্রাহকরা পাচ্ছেন ১২ শতাংশ সুদে ঋণ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে বারবার বলা হচ্ছে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ঋণের সুদের হার কমাতে পারছে না ব্যাংকগুলো সেখানে অবাক হলেও সত্য যে- ঘুরেফিরে ঋণ খেলাপিরাই বাল্ক ঋণ (বড় পরিমাণে) পাচ্ছেন। তাদের ধারণা, যেহেতু ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ করতে হবে না, কিংবা না দিয়ে পার পেয়ে যাবেন- তাই ঋণ নিয়ে আর চিন্তা কী। এমনকি একপর্যায়ে তাদের নেয়া ঋণ ব্যাংক অবলোপন করা হবে। বাস্তবতা হল, ক্ষমতার প্রভাব আর দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা ঋণ লেনদেন করে উভয়পক্ষ লাভবান হচ্ছে। এক অর্থে এ টাকা তো সাধারণ গ্রাহকের। মাঝখানে এসব মন্দ ঋণ দেয়ার নামে চলে আগাম কমিশন বাণিজ্যের বড় দুর্নীতি। দেখা যায়, জামানতের চেয়ে ঋণের পরিমাণ কয়েকশ’ গুণ বেশি। ক্ষেত্র বিশেষে সব কিছু ভুয়া দেখিয়ে বড় অংকের ঋণ নেয়া হয়। জাল-জালিয়াতি করে নেয়া ঋণের টাকা ব্যাংক চাইলেও আর আদায় করতে পারে না। মামলা করেও কোনো লাভ হয় না। জামানত রাখা সম্পদ বিক্রি করেও ঋণের ৫ শতাংশ আদায় হয় না। আর এসব প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের কেউ কেউ সরকারি ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের শেষমেশে কিছুই হয় না। বরং তারা সিআইপি কিংবা ভিআইপি হয়ে দিব্যি সমাজে চলাফেরা করেন। আইনের আওতায় নেয়া তো দূরের কথা অনেক সময় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রটোকল দিতে ব্যস্ত থাকেন।
অথচ সামান্য কৃষি ঋণ পরিশোধ না করার দায়ে শত শত কৃষকের নামে মামলা ঠুকে দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। রীতিমতো কোমরে দড়ি দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। এ রকম নজির অনেক আছে। এমনকি এ দেশে কৃষি ঋণ পেতে ৩০ ভাগ ঘুষ দিতে হয়। গ্রামাঞ্চলে এমন ঘটনাও ঘটেছে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি সময়মতো দিতে না পারায় কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ৯ বছরে দেশের আর্থিক খাত থেকে শীর্ষ ১০০ উদ্যোক্তা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। কিন্তু এক হাজার কোটি টাকার জন্য আড়াই লাখ কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে কয়েকটি তফসিলি ব্যাংক।
জানতে চাইলে কৃষি গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ যুগান্তরকে বলেন, দেশে হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেও অনেক সময় খেলাপি দেখানো হয় না। অথচ একজন কৃষক মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অসম প্রতিযোগিতা চলছে। এতেও কৃষক খেলাপি হচ্ছেন।
একই দেশে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করা নিয়ে এই যখন চিত্র তখন ভুক্তভোগী মহলের অনেকে মনে করেন, এ রকম বৈষম্যমূলক ব্যাংকিং নীতি বলবৎ থাকলে দেশ কোনোভাবেই শিল্পে-বাণিজ্যে সামনে এগোতে পারবে না। কেননা, ঋণ খেলাপিদের কারণে যদি ভালো উদ্যোক্তাদের (যারা কখনও ঋণ খেলাপি নন) উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে হয় তাহলে সে শিল্প কখনও দাঁড়াবে না। কোনোমতে যাত্রা শুরু করলেও সুদ আর খরচের চাপে ব্রেক ইভেনে আসা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। একপর্যায়ে লে-অফ ঘোষণা করতে হবে। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকের দায়-দেনা পরিশোধ করতে হবে অন্য সম্পদ বিক্রি করে। সঙ্গত কারণে দেশে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনে এগোতে পারবে না।
তাহলে প্রশ্ন, কাদের চক্রান্তে দেশের এমন বড় ধরনের ক্ষতি করা হচ্ছে। হতে পারে, যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি চায় না তারা পেছন থেকে ষড়যন্ত্র করে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও শিল্প দুটোই ধ্বংস করে দিচ্ছে। আর এটি কেউ মানতে নারাজ হলে ধরে নিতে হবে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা অন্ধকারে আছেন। ঋণখেলাপি নন এমন ভালো শিল্পোদ্যোক্তাদের কয়েকজন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর উচিত হবে যারা ঋণখেলাপি হিসেবে স্বীকৃত তাদের আর ঋণ না দিয়ে ঋণের টাকা আদায়ে শক্ত ব্যবস্থা নেয়া।
পাশাপাশি যারা ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত তাদের পুনরায় ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সুদের হার বৃদ্ধিসহ কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া। বিপরীতে যারা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে পরিচিত তাদের স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া উচিত। এ ছাড়া ব্যাংকের বহুবিধ অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জানা গেছে, বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা নানা রকম সুবিধা পেলেও বঞ্চিত হচ্ছেন ভালো গ্রাহকরা। নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী গ্রাহকদের সুদহারে বিশেষ ছাড় দিতে প্রথমবারের মতো একটি নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোকে ভালো গ্রাহকদের সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সেটি মানতে নারাজ অধিকাংশ ব্যাংক। এতে ভালো গ্রাহকরা প্রণোদনা না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন, অন্যদিকে ঋণখেলাপিরা উৎসাহিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছিলেন, ভালো গ্রাহক যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, খেলাপি হন না, তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা নীতিমালা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কোন প্রক্রিয়ায় সুবিধা দেয়া হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভালোদের জন্য এক রিবেট (ছাড়), ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে বলা হয়েছে। নীতিকাঠামো তৈরি করেই তাদের প্রণোদনা, পুরস্কার বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে। কিন্তু সাবেক গভর্নর ভালো গ্রাহকের ক্ষেত্রে কম সুদে ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিলেও তা প্রকৃতপক্ষে আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
২০১৪ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্দেশনায় বলা হয়, টানা তিন বছর নিয়মিত ঋণ পরিশোধ রয়েছে এমন গ্রাহকদের আরোপিত সুদের ওপর কমপক্ষে ১০ শতাংশ রিবেট দিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর বার্ষিক অনুষ্ঠানে এ ধরনের গ্রাহকদের স্বীকৃতি বা পুরস্কার দিয়ে সামাজিকভাবে সম্মানিত করতে হবে। তা না করায় একই বছরের ৩০ ডিসেম্বর এবং ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে আরও দুটি সার্কুলার জারি করা হয়। এরপরও কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে আরও একটি চিঠি দিয়ে ২০১৫ সালে যারা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন তাদের কতজনকে এ পর্যন্ত রিবেট দেয়া হয়েছে এবং পরিমাণ কত দুই সপ্তাহের মধ্যে তা জানাতে বলা হয়েছে। এছাড়া রিবেট পাওয়ার উপযুক্ত অথচ এখনও সুবিধা না দিয়ে তার বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয়েছে এ ধরনের গ্রাহকের সংখ্যা ও পরিমাণ জানাতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একাধিক ব্যাংকের এমডি দাবি করেছেন, ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে পরিচিতরা শুরু থেকেই প্রতিযোগিতামূলক কম সুদে ঋণ পেয়ে থাকেন। ফলে নতুন করে প্রণোদনা দিতে গেলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে নতুন করে কোনো সুবিধা তারা দেবেন না। তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মানা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা কেন কার্যকর হচ্ছে না জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বুধবার যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ভালো গ্রাহকদের বাধ্যতামূলকভাবে প্রণোদনা দিতে হবে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোর অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছে। অগ্রগতি প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যাংকার্স মিটিংয়ে নির্দেশনা দেয়া হবে বলে তিনি জানান।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.