বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোক থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা আক্রান্ত। এমন তথ্য দিয়ে বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি ও হাসপাতাল এবং ইয়ুথ ক্লাব অব বাংলাদেশ বলেছে, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার শিশু এই ঘাতক ব্যাধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। দিন দিন এই রোগের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু এই রোগে ভুগছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে থ্যালাসেমিয়ার বাহক সংখ্যা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ১ লাখ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে থ্যালাসেমিয়া শিশুরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতি বছরে এক লাখ টাকার উপরে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় হয়। যা গরিব রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমাটোলজি ও বিএমটি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএ খান মানবজমিনকে বলেন, তাদের হাসপাতালে ২০১৫ সালে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগী এসেছে ৩শ’ জন। তাদেরকে প্রতি সপ্তাহে একদিন আলাদা সেবা দেয়া হয়েছে। এবছর থেকে তাদের জন্য ডে কেয়ার চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এই রোগের রি-এজেন্ট হাসপাতালে পর্যাপ্ত থাকে না। এধরনের রোগীদের শরীরে আয়রন জমে যায়, তা বের করে দেয়ার জন্য ওষুধ দরকার হয়। তা সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ হয় না। ব্লাড দিয়ে স্ক্যানিং করার খরচও ২ হাজার টাকার উপরে। প্রতি বছরে এক লাখ টাকার উপরে রোগীর চিকিৎসা ব্যয় হয়। যা গরিব রোগীর পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই এসব গরিব রোগীদের জন্য সুলভমূল্যে বা বিনা খরচে রক্ত দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। থ্যালাসেমিয়া একটি রক্তস্বল্পতাজনিত বংশগত রোগ। বাবা-মা উভয়েই এই রোগের বাহক হলে সন্তান এই রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। থ্যালাসেমিয়া শব্দের উৎপত্তি গ্রিক শব্দ থ্যালাসা থেকে এসেছে যার অর্থ সমুদ্র। ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এ জন্য একে থ্যালাসেমিয়া বলে। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। অর্থাৎ ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে এ রোগ হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। বাবা অথবা মা কিংবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জিন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এই রোগ কোনো ছোঁয়াচে নয়। জিনগত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর শরীরে যে লাল রক্ত কণিকা অর্থাৎ রেড র্লাড সেল তৈরি হয়, সেগুলো ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই ভেঙে যায়। আর এই সেল ভাঙার কারণে শরীরে একদিকে হিমোগ্লোবিন কমে যায়, অন্যদিকে বিলিরুবিনের এবং আয়রনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে শরীর হলদেটে হয়ে যায় এবং অতিরিক্ত আয়রন-এর কারণে শরীরের বর্ণ হয়ে যায় তামাটে বা ধূসর। এ কারণে এদেরকে নিয়মিত রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এই ঘাতক ব্যাধি থ্যালাসেমিয়া দুটি প্রধান ধরনের হতে পারে। আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণত আলফা থ্যালাসেমিয়া বিটা থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়া বিশিষ্ট রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি হয় অপরদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি। এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমতো চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। এ রোগের কিছু উপসর্গ বা লক্ষণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দুর্বলতা, অবসাদ অনুভব, অস্বস্তি, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি হৃৎপিণ্ডের সমস্যা, অতিরিক্ত আয়রন, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি। এসব লক্ষণসমূহ কারও মধ্যে দেখা গেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা যেমন কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট এবং পেরিফেরাল ব্লাড ফিল্থ করতে হবে। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কম থাকলে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস করে থ্যালাসেমিয়া রোগ নির্ণয় সম্ভব। মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ ও উপসর্গ খুবই অল্প থাকায় ব্লাড ট্রান্সিফিউশন লাগে না। বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন কোনো অপারেশন হলে বা প্রসবের পর অথবা কোনো সংক্রমণ হলে প্রয়োজনবোধে রক্ত গ্রহণ করতে হয়। চিকিৎসকরা বলেন, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। প্রয়োজনবোধে ওষুধ এবং রক্ত গ্রহণ করতে হয়। তাই এই রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এই রোগে আক্রান্ত রোগীকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে হয়। এই রোগের স্থায়ী চিকিৎসা হচ্ছে ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এতে বাংলাদেশে খরচ পড়বে ১৫ লাখ টাকা। এবছর এধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। চিকিৎসকরা বলেছেন, কিউরেটিভ চিকিৎসা হিসেবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন লাভজনক। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর পক্ষেই এটা করা সম্ভব নয় বলে তারা মনে করেন। প্রতি মাসে এক ব্যাগ করে রক্ত নিতে হয় রোগী মাহীউদ্দিনকে। রক্ত নিয়েই চার বছরের শিশুটিকে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। গত বছরে তার থ্যালাসেমিয়া রোগটি ধরা পড়ে। তারপর থেকেই তার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। এবছরের এপ্রিলে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার বাবা কবির হোসেন বলেন, চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি মাসে এক ব্যাগ করে রক্ত দিতে হয়। সন্তানের চিকিৎসা ব্যয় করতে গিয়ে তাদের দরিদ্র পরিবারটি হিমশিম খাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। চিকিৎসকরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়া রোগটির প্রতিকার করা সম্ভব একমাত্র জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে। এই রোগ সম্পর্কে মানুষের বিস্তারিত ধারণা থাকলে এর পরিপূর্ণ প্রতিকার সম্ভব হবে। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে যে যে বিষয়গুলো প্রথমে জানতে হবে তা হলো-বিয়ের আগে বর ও কনের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে তারা কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা রোগী কিনা। যদি দুজনেই বাহক বা একজন বাহক অন্যজন রোগী হয় তাহলে তাদের সন্তান-সন্ততিরও এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই তাদের না বিয়ে করাই উত্তম। চিকিৎসকরা আরো পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আয়রন জাতীয় ওষুধ না খেতে। অধিক আয়রনজনিত জটিলতা এড়ানোর জন্য ৩ থেকে ৬ মাস পরপর রক্তরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে। বাবা-মা উভয়েই বাহক হলে প্রিনেটাল ডায়াগনোসিস করাতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.