দেশে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মানে তেমন উন্নতি নেই। পুঁথিগত বিদ্যায় প্রায় বন্দি হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা। পাঠ্যপুস্তক বা সিলেবাসনির্ভর পড়ালেখা ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের জগৎ খণ্ডিত করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ফেসবুক সুলভ হওয়ায় তারা বই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভরতা তাদের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, শিশু-কিশোর ও তরুণদের সিলেবাসের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের করতে পারে পাঠাগার। দেশে পাঠাগারের সংখ্যা বেড়েছে, বইও বেরোচ্ছে প্রচুর, তবে কমেছে পাঠক। অল্প বয়সীদের বেশির ভাগই বইবিমুখ। গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠের মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে কত সংখ্যক গ্রন্থাগার আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ ব্যাপারে কখনো কোনো জরিপ হয়নি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মূল কাজ দেশে গ্রন্থের উন্নয়ন, প্রকাশনা ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধি। এই প্রতিষ্ঠানটিরও কাজ ও কাজের পরিধি আশাব্যঞ্জক নয়।
অতীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকত পাঠাগারগুলো। পাঠাগারকেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠত। এখনকার ব্যস্ত জীবনে ছোট বা বড়দের পাঠাগারে যাওয়ার সময় কই। পাঠকের অভাবে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে একসময় আলোর মশাল জ্বালানো একেকটি পাঠাগার।
নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে দৈনন্দিন জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে; কিন্তু মানুষের মননে, মূল্যবোধে তার প্রভাব পড়ছে না। বিজ্ঞান যখন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, মানুষ হয়ে পড়ছে আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। এই ভারসাম্যহীনতা ঘোচাতে চাইলে মানুষকে শেষ পর্যন্ত বইয়ের কাছেই ফিরতে হবে। তা না হলে প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান মিলবে না। বিকাশ ঘটবে না নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের। সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা মানুষের মূল্যবোধের পতনকেই বেশি দায়ী করে থাকেন। ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের দৃঢ় মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না।
এই সময়ের অন্যতম বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যে জঙ্গিবাদ—তারও অন্যতম কারণ আদর্শ শিক্ষার অভাব। মানস গঠনের উপযোগী বই শিশুর হাতে দেওয়া হচ্ছে না। তাকে নম্বরের প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে জ্ঞানের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বৃদ্ধিতে আমরা উল্লসিত হই, খতিয়ে দেখি না উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীটি সত্যিকার অর্থেই কিছু শিখল কি না।
ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাই একজন শিক্ষার্থীকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে—এ কথা শিক্ষক, অভিভাবক, নীতিনির্ধারক—কারোরই ভুলে গেলে চলবে না। যে নবীন প্রজন্ম একদিন সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেবে, তাদের বইমুখী না করা গেলে জাতি কাদের কাঁধে ভর দিয়ে এগোবে? তাই মানসম্মত বইয়ের প্রকাশ, আরো বেশি পাঠাগার স্থাপন ও পুরনো পাঠাগারগুলোর আধুনিকায়নে সরকারি-বেসরকারি সব মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.