প্রায় দুই মাস আগে পুলিশ অজ্ঞাত–পরিচয় এক শিশুর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছিল। ১০ দিন পর লাশটি নিখোঁজ এক শিশুর দাবি করে শিশুটির পরিবার খুনের মামলা করে। খুনি সন্দেহে পুলিশ দুই শিশুকে গ্রেপ্তার করে। বিচারিক হাকিম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে তাদের টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠান। এর আগে অভিযোগকারী পরিবার ও পুলিশ অভিযুক্ত শিশুদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের স্বীকারোক্তি নেয়। এ সবই ঘটে দুই দিনের মধ্যে। আরও পরে জিজ্ঞাসাবাদের দুটি ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে তুলে দেন নিখোঁজ শিশুটির এক ফুফাতো বোন। লাশটির পরিচয় কিন্তু অজানাই আছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন বলছে, সে পানিতে ডুবে মারা গেছে। অভিযুক্ত দুই শিশু বলছে, মারধর করে তাদের মিথ্যা দায় স্বীকার করতে বাধ্য করা হয়েছে। মামলাটি হয়েছে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানায়। ওই থানার পুলিশ, নিখোঁজ ও গ্রেপ্তার হওয়া শিশুদের পরিবার আর এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এক জটিল ঘটনার আভাস পাওয়া যায়। পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় শিশুটির লাশ উদ্ধার করে গত ১ অক্টোবর, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের কালুনগর খাল থেকে। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম সেটা দাফন করে। এদিকে ২৯ সেপ্টেম্বর লালবাগ এলাকা থেকে আলিফ নামের নয় বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়েছে বলে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তার বাবা উজ্জ্বল ভূঁইয়া। ৮ অক্টোবর তিনি কামরাঙ্গীরচর থানায় গিয়ে অজ্ঞাতপরিচয় লাশের ছবি দেখেন, কিন্তু সেটাকে নিজের ছেলের বলে শনাক্ত করেন না। তবে আলিফের পরিবার বলছে, ১১ অক্টোবর সকালে তারা ছেলের একজন খেলার সঙ্গীকে বাসায় ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। সে (শিশু ‘ক’) আরেক বন্ধুর (শিশু ‘খ’) সঙ্গে মিলে আলিফকে হত্যার কথা স্বীকার করে। সাংবাদিকতার নীতিমালা ও শিশু আইন মেনে প্রতিবেদনে তাদের নাম-পরিচয় দেওয়া হচ্ছে না। ১১ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে আলিফের বাবা বাদী হয়ে কামরাঙ্গীরচর থানায় শিশু দুটির নামে খুনের মামলা করেন। এজাহারে তিনি লেখেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশটি তাঁর ছেলের। শিশু ‘ক’ ও শিশু ‘খ’ মিলে আলিফকে গলা টিপে হত্যা করে কালুনগর খালের পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছে। আলিফের বাবা তখনই শিশু ‘ক’কে পুলিশে সোপর্দ করেন। পুলিশ রাত দেড়টার দিকে শিশু ‘খ’কে গ্রেপ্তার করে। ১২ অক্টোবর সকালে শিশু দুটিকে খালপাড়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। পরে ঢাকার মহানগর হাকিম লস্কর সোহেল রানা তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আজহার হোসেন শিশু দুটির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার আবেদনে লেখেন, তারা আলিফের বন্ধু ছিল। একসঙ্গে খেলাধুলা ও গোসল করত। ঘটনার দিন খালে গোসল করতে নামলে আলিফের সঙ্গে তাদের ঝগড়া বাধে। তারা আলিফকে গলা টিপে মেরে লাশ পানিতে রেখে চলে যায়। কালুনগর খালটি আলিফ ও শিশু ‘ক’-এর বাসা থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে। শিশু ‘খ’-এর বাসা খালের কাছাকাছি। আলিফ মূলত তারই বন্ধু ছিল। শিশু ‘ক’-এর বাবা পুরান ঢাকার এক রেস্তারাঁয় কাজ করেন। শিশুটি নিজেও বাসে হেলপারি করে। শিশু ‘খ’ একটি কারখানায় কাজ করে। তার বাবা আলাদা থাকেন। মা বাসাবাড়িতে কাজ করেন। আলিফের বাবা পুরান ঢাকার একটি কারখানার ম্যানেজার। আলিফ তার ফুফুর কাছে থাকত। ফুফার একটি জুতার কারখানা আছে। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া শিশু দুটির দেখা হয় ১০ নভেম্বর বিকেলে, ঢাকা জেলা আদালতের চত্বরে। তাদের মহানগর শিশু আদালতে হাজিরা দিতে আনা হয়েছিল। শিশু ‘ক’ বলে, তারা আলিফকে খুন করেনি। তার সামনে তার মাকে আলিফের ফুফুসহ অন্যরা তাঁদের সাততলার বাসায় নিয়ে হাত-পা বেঁধে রেখে মেরেছেন। তাকেও মারধর করেছেন, গলা টিপে ধরেছেন। তারপর সে বাধ্য হয়ে বলেছে যে তারা আলিফকে খুন করেছে। দুজনেই বলে, তারা আলিফের কোনো খোঁজ জানে না। আদালতে দেওয়া জবানবন্দি প্রসঙ্গে শিশু ‘খ’ বলে, ‘স্যারে (পুলিশ) সবকিছু বলেছে। মিথ্যা (কথা) খাতার মধ্যে সবকিছু লিখেছে।’ তদন্ত কর্মকর্তা আজহার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, মারধর করে স্বীকারোক্তি আদায় বা ফেসবুকে স্বীকারোক্তির ভিডিও তুলে দেওয়ার কথা তিনি জানেন না। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশটি আলিফের কি না, তা নিশ্চিত নয়। নিখোঁজ হওয়ার সময় আলিফের পরনে ছিল নীল রঙের প্যান্ট, জামা ও জুতা। পুলিশ এগুলো খুঁজে পায়নি। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ অক্টোবর করা লাশটির ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তার মত দিয়েছেন, মৃত্যুর কারণ পানিতে ডুবে শ্বাসরোধ হওয়া। লাশের দুই ফুসফুস ও পাকস্থলীতে বালু ছিল। লাশটি খালে দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা খলিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, লাশে পচন ধরায় চেনার উপায় ছিল না। একই কথা বলেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডোম শ্যামল। ৮ নভেম্বর পুলিশ ডিএনএ পরীক্ষা করার জন্য লাশের সংরক্ষিত অংশ ও আলিফের বাবার দেহের নমুনা সিআইডি কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। রিপোর্ট পেতে দু-তিন মাস লেগে যাবে। আলিফের লাশ আছে কি নেই, সেটা নিশ্চিত নয়। তবে তদন্ত কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, শিশু দুটি জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে খুন করার কথা বলেছে। তাই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, আদালতে জবানবন্দি নেওয়ার সময় শিশু দুটির অভিভাবকেরা উপস্থিত ছিলেন না এবং থাকার নিয়ম নেই। তবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ (সিসিবি) ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবদুল হালিম বলছেন, শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার সময় অবশ্যই তার বাবা-মা, অভিভাবক, হেফাজতকারী বা আইনি প্রতিনিধির তার সঙ্গে থাকা উচিত। এটা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। তিনি আরও বলেন, অজ্ঞাতপরিচয় লাশটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। সুতরাং কাউকে গ্রেপ্তার করার আগে ওই লাশের পরিচয় জানতে হবে। তার আগে অভিযুক্ত দুই শিশুকে পুলিশ কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করতে পারে না। শিশু আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, নয় বছরের কম বয়সী কোনো শিশুকে গ্রেপ্তার কিংবা আটক করা যাবে না (ধারা ৪৪/১)। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলছেন, এই বয়সী শিশুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও নেওয়া যাবে না। মামলার এজাহারে শিশু দুটির বয়স বলা হয়েছে ১২ বছর। কিন্তু অভিভাবকেরা বলছেন, তাদের বয়স নয় বছরের কম। আদালতে জন্মসনদ দাখিল করে মামলা থেকে শিশু ‘ক’-এর অব্যাহতি চেয়েছেন তার আইনজীবী। ওই সনদে দেখা যায়, তার জন্ম তারিখ ২৯ জানুয়ারি, ২০০৮। শিশু ‘ক’-এর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন আদালত। শিশু আইন বলছে, শিশুকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ কর্মকর্তা জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা অন্য কোনো দলিল খুঁজে তার বয়স নির্ণয় করবেন। খোদ তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি তা করেননি। আলিফের ফুফু নাহিদ পারভিন বলেছেন, ছেলেটির মা কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। বাবা আবার বিয়ে করেছেন। আলিফকে তাই তিনি নিজের ছেলের মতো পালতেন। নাহিদ নিঃসন্তান। নাহিদ বলেন, আট মাস আগে পাশের একটি কারখানা থেকে শিশু ‘খ’ আড়াই হাজার টাকা চুরি করে। আলিফ দেখতে পেয়ে বলে দিলে কারখানার মালিক আর এলাকার লোকজন শিশুটিকে ধরে পিটুনি দেয়। নাহিদের মতে, এই রাগেই সে আলিফকে খুন করেছে। কারখানাটির মালিক মো. খলিল। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আলিফ ও আরেক শিশু তাঁর কর্মচারী সুমনের টাকা চুরি করেছিল। আলিফের ফুফুকে জানানোর পর তিনি টাকাটা দিয়ে দেন। তিনি বলেন, তাঁরা কাউকে মারেননি। কারখানার কর্মচারী সুমনও একই কথা বললেন। নাহিদ বলছিলেন, আলিফ নিখোঁজ হওয়ার পর তিনি রোজ শিশু ‘খ’-এর বাসায় গিয়ে ছেলের খোঁজ জানতে চাইতেন। সে কিছু বলত না। পরে শিশু ‘ক’কে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে সবকিছু স্বীকার করে। তিনি বলেন, তাঁরা কাউকে মারধর করেননি। তবে শিশু ‘ক’-এর মা প্রথম আলোকে বলেছেন, খবর পেয়ে তিনি সেখানে গেলে ওই বাসার লোকজন তাঁকে মারধর করেন, গলা টিপে ধরেন। তাঁর ছেলেকেও তাঁরা মারধর করেন। ভয়ে ছেলে খুন করার কথা বলেছে। সে আলিফের ব্যাপারে কিছুই জানে না। শিশু ‘খ’-এর বাবা বলছেন, তাঁকে আর তাঁর ছেলেকেও আলিফের পরিবার মারধর করেছে। তাঁর ছেলে নির্দোষ। আলিফের ফুফাতো বোন তাঁর ফেসবুকে শিশু দুটিকে জিজ্ঞাসাবাদের দুটি ভিডিও ক্লিপ তুলে দিয়েছেন। এগুলোতে দেখা যায়, একের পর এক প্রশ্নের উত্তরে তারা আলিফকে নিয়ে খালে গোসল করার সময় তাকে হত্যা করার কথা বলছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জামিউল হক ফয়সালের মতে, ওই শিশুদের স্বার্থের পরিপন্থী ভিডিও ক্লিপগুলো ফেসবুকে প্রচার করা অন্যায় হয়েছে। শিশু আইনে এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। এদিকে আলিফের ফুফু নাহিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ছেলেটি নিখোঁজ হওয়ার পর একাধিক ব্যক্তি ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছিলেন, আলিফ তাঁদের কাছে আছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আজহার অবশ্য বললেন, তিনি এ সম্পর্কে কিছু জানেন না। কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি শেখ মুহসীন আলম মনে করেন, এলাকার সুযোগসন্ধানী কেউ এসব ফোন করেছেন। আজহার হোসেন বলছেন, দুই শিশুর স্বীকারোক্তিতে এ মামলার রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে। অজ্ঞাতপরিচয় লাশটির সঙ্গে আলিফের বাবার ডিএনএ মেলা সাপেক্ষে তিনি আদালতে অভিযোগপত্র দেবেন। ঘটনার বিবরণ শুনে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজ শিশুটির হদিস পুলিশ দিতে পারেনি। সে খুন হয়ে থাকলে অবশ্যই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। গ্রেপ্তার শিশু দুটির স্বীকারোক্তি আদালতে অগ্রাহ্য হতে পারে। এটা খুব অসম্ভব নয় যে তাদের মারধর করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, এমন না যে শিশুরা হত্যা করতে পারে না। কিন্তু সত্যটা যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্ণয় করা দরকার। আর শিশু অধিকারের শর্তগুলো এই শিশুদের ক্ষেত্রেও মান্য করতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.