আইন লঙ্ঘন করলেও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। পুরো পরিবারটি বরং বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছে। এইচ বি এম ইকবাল বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। ব্যাংক কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে এই ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে আছেন তাঁর ছেলে মোহাম্মদ ইমরান ইকবাল। আরেক ছেলে মঈন ইকবাল এবং মেয়ে নওরীন ইকবালও একইভাবে ব্যাংকটির পরিচালক হয়েছিলেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১৫(৬) ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হলে কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না।’ দণ্ডিত কেউ পরিচালক হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁকে অপসারণ করতে পারে, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দুদকের মামলায় ২০০৮ সালে এইচ বি এম ইকবাল, তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগমসহ দুই ছেলে ও এক মেয়েকে সাজা দেন বিশেষ আদালত। এইচ বি এম ইকবাল নিম্ন আদালতে ২০১০ সালে আত্মসমর্পণ করেন এবং পরের বছর হাইকোর্ট তাঁকে খালাস দেন। এই খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করেও দুদক ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেননি কখনো। হাইকোর্টে তাঁদের সাজার কার্যকারিতা স্থগিত হয়, যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১০ সালের নভেম্বরে। ছয় বছর চুপচাপ থেকে নতুন করে স্থগিতাদেশ চাইলে গত ১৮ অক্টোবর বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. সেলিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ সাজা আরও ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। শুনানির সময় দুদকের কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তবে একাধিক অভিযোগ আসার পর দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সময় নড়েচড়ে বসেছে সংস্থাটি। দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, ওই চারজনের সাজার ওপর সর্বশেষ স্থগিতাদেশ স্থগিত চেয়ে ১৫ নভেম্বর আদালতে আবেদন করে দুদক। ১৬ নভেম্বর চেম্বার জজ আদালত ১৮ অক্টোবরের স্থগিতাদেশটি স্থগিত করেন। এ বিষয়ে ২৭ নভেম্বর (কাল রোববার) পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর পরিবারের প্রতি সরকারি সংস্থার বিশেষ আনুকূল্য এদিকে, চলতি বছরের ২৮ জুন সোহাগ তালুকদার নামের এক ব্যক্তি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে ইমরান ইকবালের বৈধতার প্রশ্নে রিট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদকের প্রতি রুল জারি করেন আদালত। রুলের জবাব দিতে চার সপ্তাহ সময় দেওয়া হলেও কেউ জবাব দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা অবশ্য এক মাস আগে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘রুলের জবাব তৈরির কাজ চলছে। অন্য বিষয়ে কিছু বলা কঠিন।’ গত বৃহস্পতিবার জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে হালনাগাদ তথ্য দিতে পারেননি। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবাল ২ নভেম্বর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইমরান ইকবালের সাজার বিপরীতে উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।’ পরিবারের অন্য সদস্যদের সাজার বিপরীতেও কি স্থগিতাদেশ রয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ। সবারটাই। আর আমি তো খালাস পেয়েছি আগেই।’ স্থগিতাদেশ স্থগিত হওয়ার বিষয়ে বক্তব্য জানতে গত দুই দিন তাঁর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করে ও খুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি। যেভাবে শুরু: এইচ বি এম ইকবাল পরিবারকে দুদক সম্পত্তির বিবরণী দাখিলের নির্দেশ দেয় ২০০৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, আর মামলা করে ২৭ মে। বিশেষ জজ আদালত মামলার রায় দেন ২০০৮ সালের ১১ মার্চ। রায়ে এইচ বি এম ইকবালকে অসাধু উপায়ে সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর, মিথ্যা সম্পদ বিবরণী দাখিলের কারণে আরও ৩ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে ৩ বছর করে কারাদণ্ড দেন এবং প্রত্যেককে জরিমানা করেন ১ লাখ টাকা। দুদকের মামলা হওয়ার পর অনেক দিন আত্মগোপনে ছিলেন এইচ বি এম ইকবালসহ এই পাঁচজন। রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এইচ বি এম ইকবালের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল করেন তাঁর ভাই এইচ বি এম শোয়েব রহমান। তখন জানানো হয়, এইচ বি এম ইকবাল চিকিৎসার জন্য বিদেশে রয়েছেন। হাইকোর্ট ওই দিন রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। ২০০৯ সালের ১৮ জানুয়ারি এইচ বি এম ইকবালের পক্ষে হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করলে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এর বিরোধিতা করে বলেন, আত্মসমর্পণ ছাড়া জামিন চাওয়া বেআইনি। পরে জামিন পান এইচ বি এম ইকবাল। তিনি মামলাটি নথিভুক্ত করার আবেদন করলে ২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর হাইকোর্ট গ্রহণ করেন। ওই আবেদন গ্রহণের আদেশ বাতিল চেয়ে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি দুদক আপিল করে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করেন। আদালতের নির্দেশে এইচ বি এম ইকবাল ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। নিম্ন আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। আদালতে অসত্য তথ্য: এইচ বি এম ইকবাল এ মামলা থেকে খালাস চেয়ে আবেদন করেন। ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট তাঁকে খালাস দেন। তাঁর পক্ষে ছিলেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান ও বঙ্গবন্ধু আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাসেত মজুমদারসহ কয়েকজন আইনজীবী। আদালতকে তাঁরা বলেন, ২০০৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এইচ বি এম ইকবালকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী এবং বিনা বিচারে তাঁকে আটক রাখা হয়। আটক অবস্থায় দুদক ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়ে তাঁকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয়। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন তৎকালীন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান (পরে বরখাস্ত)। তবে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলেছে, এইচ বি এম ইকবাল ওই সময় আটক ছিলেন না। আবদুল বাসেত মজুমদার গত ২৭ অক্টোবর তাঁর চেম্বারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে এইচ বি এম ইকবালের আটক থাকার তথ্যটি ভুলভাবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’ আপিল থেকে দুদকের সরে আসা: এইচ বি এম ইকবালের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করেও ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি মামলা না চালাতে আবেদন করে দুদক। দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত ৩১ অক্টোবর তাঁর কার্যালয়ে এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই সময়ের দুদক কেন এইচ বি এম ইকবালের বিরুদ্ধে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে ব্যাপারে মন্তব্য করতে চাই না। তবে অন্য বিষয়ে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ ওই সময় দুদকের চেয়ারম্যান ছিলেন এম বদিউজ্জামান, কমিশনার ছিলেন সাহাবউদ্দিন ও নাসিরউদ্দিন আহমেদ। বদিউজ্জামান ১৯ নভেম্বর মুঠোফোনে বলেন, ‘এইচ বি এম ইকবালের বিরুদ্ধে মামলা না চালাতে তখন আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশ ছিল। তবে সুপারিশ বড় নয়, আমরাও ভেবেছিলাম যে মামলার ভিত্তি অত শক্ত নয়।’ দুর্নীতির মামলায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ সাবেক মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা জেল খেটেছেন। অনেকে খালাস পেলেও সুপ্রিম কোর্ট ২৬টি মামলার রায় বাতিল করে হাইকোর্টে পুনঃশুনানির জন্য পাঠান। এর মধ্যে এইচ বি এম ইকবালের মামলাটি নেই। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর কার্যালয়ে গত ২৬ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইকোর্টে খালাস হওয়ার পর দুদক আপিল করেছিল বলে জানি। সংস্থাটি পরে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিল কেন বুঝতে পারছি না।’