যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু হচ্ছে। এর দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার- যা হবে দেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু। এরফলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। আর এই রেল সেতু নির্মাণে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। যদিও পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। বাকি ২ হাজার ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। চলতি বছর উদ্বোধনের পর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেতু নির্মাণ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, যমুনায় প্রস্তাবিত রেল সেতু অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রেল যোগাযোগে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কনটেইনার পরিচালনার জন্য ব্রডগেজ কনটেইনার ট্রেইন সার্ভিস চালু করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে লোড ও স্পিড প্রতিবন্ধকতা দূর করে অধিক উৎপাদনশীলতা ও সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গ্যাস সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা সম্ভব হবে।
এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের জন্য কাজ করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরাল ৩০০ মিটার উজানে প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার ডেডিকেটেড ডুয়েলগেজ স্টিল রেল ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা।
একই সঙ্গে শূন্য দশমিক ৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ, বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও পশ্চিম রেল স্টেশন ভবন এবং স্টেশন চত্বর মেরামত ও রিমডেলিং এবং কম্পিউটার ইন্টারলকিং সিগন্যালিং সিস্টেমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম রেল স্টেশন আধুনিকায়নসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম করা হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, ইতিমধ্যেই প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে জাইকার সঙ্গে আলোচনা শেষ হয়েছে।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর ইআরডি ও জাইকা প্রকল্পটির ওপর মিউনিটস অব ডিসকাশন (এমওডি) স্বাক্ষর করেছে। প্রথম পর্যায়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে রেল সেতুটি নির্মাণে টেকনিক্যাল অ্যাসিসটেন্স ফর সাব-রিজিওনাল প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি শীর্ষক একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। পরে জাপান-বাংলাদেশ কম্প্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ শীর্ষক যৌথ ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫টি প্রকল্পের মধ্যে যমুনা রেলওয়ে সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি অন্যতম হিসেবে রাখা হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের সময় প্রকল্পটিতে অর্থায়নের বিষয়ে আলোচনা করেন। পরে জাইকা-এডিবির করা সমীক্ষার ওপর একটি সম্পূরক জরিপ করে গত বছরের নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
জাইকার ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত ব্রিজের কাঠামো ও ফাউন্ডেশন পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। জাইকা ট্রাচ ব্রিজ (হেভি লোড বেয়ারিং স্ট্রাকচার অ্যান্ড হাই লংজিবিটি) নির্মাণের সুপারিশ করে। সে অনুযায়ী স্ট্রিল পাইপ সিট পাইল ফাউন্ডেশনে ব্রিজটি নির্মাণ করা হবে। ফলে নির্মাণ কাজ দ্রুত হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ ও ব্যয় সাশ্রয়ী হবে। সেই সঙ্গে অনেক মজবুত ও ডিজাইন লাইফ ১২০ বছর হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য খোরশেদ আলম চৌধুরী কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে জানান, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে যমুনা নদীর ওপর ডেডিকেটেড রেল ব্রিজ নির্মিত হলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, নিরাপদ যাত্রী সেবা ও পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। তাই প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী সেকশনে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু সেতু রেলওয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এটি অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক যেমন ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়াকর্, সার্ক ট্রান্সপোর্ট করিডোর ও বিমসটেক রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। এসব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল প্রভৃতি দেশে চলাচলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট সেন্টার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুতে সীমিত এক্সেল লোড ও গতির সীমাবদ্ধতার কারণে এ রেল সেতুর পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ফ্রেইট ট্রান্সপোর্টের সম্ভাবনা থাকার পরও সুযোগটাকে পুরোপুরি কাছে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমানে ২৮টি ট্রেন বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করে। বাংলাদেশে ২ হাজার ৮৭৭ দশমিক ১০ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে তা ৪ হাজার ৭৩০ কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ফলে ভবিষ্যতে ট্রেন চলাচল সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।
এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের মধ্যে মংলা পোর্ট রেললাইন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাবে। এতে রেল চলাচলের পরিমাণ ২০২৩ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ২০৩৩ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ বাড়বে। জাতীয় ও উপাঞ্চলিক রেল চলাচলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরাল একটি ডেডিকেটেড রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.