নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে ৫ ডিসেম্বর থেকে। তবে এরই মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির সাখাওয়াত হোসেন খান নির্বাচনী প্রচার কৌশল নির্ধারণ করেছেন। দুই প্রার্থীর ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটের মাঠে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশ নেওয়া আইভীর প্রচার চলবে অনেকটাই ‘নীরবে’। অন্যদিকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মাঠে থাকা বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াতের প্রচার চলবে ‘সরবে’। আইভী ও সাখাওয়াতের পক্ষে নিজ নিজ দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে প্রচার চালানোর বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই প্রার্থীর কেউই স্থানীয় নেতাদের নিজ নিজ পক্ষে মাঠে নামাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে এখনো সংশয় আছে। আইভীর ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, গত নির্বাচনে মেয়র পদে আইভী নীরবেই প্রচার চালিয়েছেন। অল্প কয়েকজন কর্মী নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর প্রচার ছিল মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাওয়া। গত নির্বাচনে ভোটের মাঠে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর, বিশেষ করে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানের সরব প্রচারের কাছে আইভীর প্রচার ছিল অনেকটাই নীরব। ওই সময় দলীয় লোকদের চেয়ে স্থানীয় সুশীল সমাজের সমর্থন ও প্রচারকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন আইভী। এ কারণে আইভী মনে করেন, এবারও তাঁকে সেভাবেই মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হবে। জানতে চাইলে আইভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই নগরের ভোটার ও এখানকার মানুষ আমাকে সব সময় তাঁদের সঙ্গেই রেখেছেন। তাই তাঁদের কাছে আমাকে যেতে হবে। আমি প্রার্থী, ভোটাররা প্রার্থীকেই পাশে চান।’ স্থানীয় রাজনীতিক, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে আইভীকে নিজের ও তাঁর নীরব সমর্থকদের প্রচারের ওপর নির্ভর করতে হবে। কেন্দ্র তাঁর পাশে থাকলেও স্থানীয় নেতারা কতটা কাজ করবেন, সেটা সময় বলে দেবে। তা ছাড়া ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ অনেককেই আইভীর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা মন থেকে কাজ করছেন কি না, তা বোঝা কঠিন। স্থানীয় বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত নির্বাচনে আইভীর অন্যতম ভরসা ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। তিনি ছিলেন আইভীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান। সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক এস এম আকরাম। তিনি দল ছেড়ে এখন মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যে যোগ দিয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আইভী আকরামকে কাজে লাগাতে পারবেন না। এ ছাড়া গত নির্বাচনের সময় ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিন্তু তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নারায়ণগঞ্জ শাখার আহ্বায়ক। এই সংগঠনটি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। তাঁকে নিয়ে আইভী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগে সমালোচনা হয়েছে। জেলার প্রভাবশালী শামীম ওসমান বলেছেন, যিনি (রাব্বি) প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিদিন ক্ষমতা থেকে উৎখাত করছেন, তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন নেতাও এর সমালোচনা করেছেন। এ কারণে রাব্বির পক্ষে সক্রিয় থাকাটা কঠিন হবে। আইভীর জন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রচার চালানো সহজ নয়। নির্বাচনে প্রধান সমন্বয়কারী করা হয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে। সমন্বয়কারী থাকবেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি ও আবদুর রহমান। তবে তাঁরা সাংসদ হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে প্রচারে যেতে পারছেন না। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও এ কারণে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। তবে সাংসদ-মন্ত্রী নন এমন নেতারা স্থানীয় পর্যায়ে প্রচারে অংশ নেবেন। নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালন করবেন দুই সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম ও মুহিবুল হাসান চৌধুরী। সরব হবে ধানের শীষের প্রচারণা: বিএনপির প্রার্থী সাখাওয়াত গত ২৪ নভেম্বর থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে যাচ্ছেন। দলীয় ও বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়ে গিয়ে মতবিনিময় করছেন। বিএনপির স্থানীয় রাজনীতিতে কখনো কোনো বড় পদে না থাকা সাখাওয়াতকে নিজেকে চেনাতে ও মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চিনতে ছুটতে হচ্ছে। তাঁর পক্ষে এখনো জেলার প্রভাবশালী নেতারা সেভাবে নামেননি। অবশ্য তাঁকে নিয়ে দলে দৃশ্যমান কোনো কোন্দলও নেই। সাখাওয়াত মূলত মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তাঁর পক্ষে সক্রিয় করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আইনজীবী হওয়ায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মামলা লড়েছেন তিনি। ওই সব নেতা-কর্মীকে প্রচারে নামাতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার বন্ধ থাকায় ঘরোয়া ও মতবিনিময় সভায় প্রতিদিনই বক্তব্য দিচ্ছেন। স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে আদালতে হাজিরা দিতে আসা নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সাখাওয়াত কথা বলছেন। তাঁর পক্ষে সরব হতে অনুরোধ করছেন। সাখাওয়াত প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অন্তত দলের ২০ হাজার নেতা-কর্মীর মামলা লড়েছেন এবং লড়ছেন। বিনা মূল্যে মামলা পরিচালনা করছেন। তাঁরাই এখন তাঁর জন্য প্রচারে সরব হচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন আদালতে চার শতাধিক নেতা-কর্মী হাজিরা দিতে আসেন। এঁদের সরব হতে বলছেন তিনি। এদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সাখাওয়াতকে সমর্থন দিয়েছে। এ কারণে সেখানে জোটের কল্যাণ পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে প্রধান করে একটি সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। সাখাওয়াতের জন্য সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, বিএনপি সংসদে না থাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনে প্রচার চালানোর ওপর বিধিনিষেধ নেই। প্রয়োজনে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রচার-প্রচারণায় নেওয়া যায় কি না, ইতিমধ্যে দলে সেটিও আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.