অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় নান্দনিকতা হারাচ্ছে রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র হাতিরঝিল। লেকটি পরিচ্ছন্ন রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় অধরাই থেকে যাচ্ছে এর কার্যকারিতা। সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কাজে আসছে না বিপুল অর্থ ব্যয়ে কেনা উন্নতমানের যন্ত্রগুলোও। এতে নগরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা হাতিরঝিলের দূষণ যেমন রোধ হচ্ছে না তেমনি এর প্রভাবে প্রতিনিয়তই বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত সমন্বয়হীনতার কারণেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। বরং দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান রাজউক, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বুয়েট ও সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়েই দায়িত্ব সারছেন। এতে ঝিলের পরিচ্ছন্নতায় বিপুল অর্থ ব্যয় করেও সফল হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে রাজধানীবাসীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তা।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, লেকটিতে আকারে বড়, শক্ত ও প্লাস্টিক জাতীয় ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য চারটি স্থানে মোট ১২টি ক্লিনিক্যাল স্ক্রিন মেশিন আছে। এছাড়া পানিতে মিশে থাকা তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্যও রামপুরায় একটি বৃহৎ ইনটেরিয়াম পাম্পিং সিস্টেম মেশিন রয়েছে। তবে এসব মেশিনের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সঠিকভাবে বর্জ্য পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব মেশিনের দায়িত্বে থাকা কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেও বর্জ্য পরিচ্ছন্নতার পথে বড় বাধা হয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা যেনতেনভাবে দায়সারাভাবে কাজ করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। হাতিরঝিলের বাংলামোটর, মগবাজার, রামপুরা, মধুবাগ ও গুলশান এলাকায় আকারে বড় বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য যে ১২টি ক্লিনিক্যাল স্ক্রিন মেশিন আছে তার মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি চালু আছে। বাকিগুলো বন্ধ থাকার কারণ জানতে চাইলে রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) প্রকল্প পরিচালক জামাল আক্তার ভুইয়া যায়যায়দিনকে বলেন, বর্ষার সময়ে বাইরে থেকে ব্যাপক ময়লা পানি ঝিলে প্রবেশ করে বলে সে সময়ে সবগুলো মেশিন চালু রাখা হয়। অন্য সময় বাইরে থেকে ময়লা আসতে পারে না বলে এক বা দুটি মেশিন চালু রেখে বাকিগুলো বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু এখন পানিতে প্রচুর ময়লা থাকার পরও এগুলো বন্ধ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে ময়লা আছে তা পরিষ্কারের জন্য এটিই যথেষ্ট। ক্লিনিক্যাল স্ক্রিন মেশিনগুলোকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এখান থেকে যে ময়লা নিষ্কাশিত হচ্ছে তা যথাসময়ে সরিয়ে না নেয়ায় এর একটি বড় অংশ আবারও ঝিলের পানিতে পড়ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে যথাসময়ে ময়লা নিতে না আসায় কুকুর, বিড়াল ও কাকে টেনে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে এসব ময়লা। ফলে ঝিলের ময়লা পরিষ্কারের চেয়েও দূষণের মাত্রা বেশি। বিষয়টি রাজউকের প্রকল্প পরিচালক জামাল আক্তার ভুইয়ার নজরে আনলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, এখানকার বিষয়টি সেনাবাহিনীর লোকজন দেখাশোনা করেন। ফলে এ বিষয়ে তারাই সঠিক তথ্য দিতে পারবে। ক্লিনিক্যাল স্ক্রিন মেশিনের ময়লা উত্তোলনের কাজ করেন রবিউল মিয়া। তিনি বলেন, সপ্তাহে একবার সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে ময়লা নিয়ে যায়। বাকি পুরো সপ্তাহ ময়লা এখানে পড়ে থাকে। ফলে টাকা খরচ করে বর্জ্য নিষ্কাশন করা হলেও তা কোনো কাজেই আসছে না। এ বিষয়ে হাতিরঝিলের বর্জ নিষ্কাশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর শাকিলের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এটি সিটি করপোরেশনের কাজ। তারা শুধু বিষয়টি তদারকি করেন। জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, তারা শুধু ময়লা আনার গাড়িটি সরবরাহ করে থাকেন। এর বাইরে বাকি কোনো কাজের দায়িত্ব তাদের নয়। এভাবে একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে মুখ রক্ষার চেষ্টা করেন হাতিরঝিলের দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। ঝিলের পানিতে মিশে থাকা তরল ময়লা পরিষ্কারের জন্য যে বৃহৎ ইনটেরিয়াম পাম্পিং সিস্টেম মেশিন আছে সেটি রামপুরা ব্রিজের নিচে অবস্থিত। সেখানে যেয়ে দেখা যায়, ছাকনি দিয়ে যে পরিমাণ পানি আসছে তাতেও প্রচুর ময়লা থাকছে। আবার ছাকনির উপর দিয়েও ব্যাপক ময়লা পানি আসছে। ফলে মেশিন চলার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও বাস্তবে তা বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। এ বিষয়ে রাজউকের কর্মকর্তা জামাল আক্তার বলেন, এভাবে যদি পানি বের হয়ে থাকে তবে তা দেখে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হবে। চার বছর আগে রাজধানী ঢাকার মানুষকে একটু বিনোদনের ছোঁয়া দিতে গুলশান, রামপুরা, মগবাজার, বাংলামোটরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে উদ্বোধন করা হয় ৩০২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত লেক হাতিরঝিল। উদ্বোধনের সময়ে বলা হয়েছিল এটিকে বিশ্বের বড় শহরগুলোর ঐতিহাসিক লেক বা নদীর মতো করে গড়ে তোলা হবে। যা রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতাকে বহুগুণে বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগাযোগেরও অন্যতম মাধ্যম হয়ে কাজ করবে। তবে চার বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, এখন স্বপ্নের সেই হাতিরঝিলই রাজধানীবাসীর অন্যতম প্রধান দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হাতিরঝিলে দুর্গন্ধ এবারই নতুন নয়। তবে এবারের অবস্থা অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ এবং দুর্গন্ধের ধরনও অন্যান্যবারের চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁজালো ও তীক্ষ্ন। শীতকাল শুরু হওয়ার আগেই এবার রাজধানীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ঝিলের তীব্র দুর্গন্ধ। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাতিরঝিল লেকটি বাংলামোটর থেকে শুরু করে গুলশান পর্যন্ত বিস্তৃত হলেও এর সর্বত্র দুর্গন্ধের ধরন এক রকম নয়। এ সমস্য বাংলামোটর ও মগবাজার অঞ্চলেই সর্বাধিক। কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ যাওয়ার পথে বাংলামোটর অংশে এবং সাতরাস্তা থেকে মগবাজার যাওয়ার পথে রেললাইন এলাকায় এ দুর্গন্ধ সবচেয়ে বেশি। রাজধানীর সর্বাধিক ব্যস্ততম এ দুটি মহাসড়কে এ সমস্যা প্রকট হওয়ায় এসব পথে প্রতিদিন চলাচলকারী হাজারো মানুষকে পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় এ দুর্গন্ধের ধকল। তবে রামপুরা থেকে গুলশান পর্যন্ত এ সমস্যা কিছুটা কম। পথচারীরা বলছেন, মগবাজার ও বাংলামোটর অঞ্চল দিয়ে তাদের সবচেয়ে বেশি চলাচল করতে হয়। রামপুরা ও গুলশান অঞ্চলে সাধারণ মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় এখানকার দুর্গন্ধ অপেক্ষাকৃত কম। হাতিরঝিল ঘুরে দেখা যায়, ঝিলের বাংলামোটর থেকে মগবাজার অংশে লেকের পানি কালো আলকাতরার মতো রং ধারণ করেছে। সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ময়লা পানিতে মিশে আছে। এখানকার পানির দূষণ ও দুর্গন্ধ বুড়িগঙ্গার চেয়েও বেশি বলেই মনে হবে। এখানকার ঝিলের আশপাশ দিয়ে চলাচল করাও খুবই কষ্টসাধ্য। বাংলামোটরের একজন বাসিন্দা নাজনীন সুলতানা জানান, বছরের পর বছর ধরে এখানকার দুর্গন্ধ তাদের নিত্য সঙ্গি। তবে এবার এখানে দুর্গন্ধ অনেক আগে থেকেই তীব্র আকার ধারণ করেছে। এ ঝিলের কারণে তারা এ অঞ্চল থেকে সরে অন্য কোথাও থাকার চিন্তা করছেন। তিনি আরও জানান, গত কয়েক বছরে এখানে বসবাসের ফলে তার ও তার পরিবারের সদস্যরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। যা আগে তাদের পরিবারে কারো ছিল না। হাতিরঝিলের পাশেই একটি গাড়ি মেরামতের কারখানায় কাজ করে ১০ বছরের রুবেল। সেও জানায়, গত দুই বছর ধরে এখানে কাজ করায় এখন তারও অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা হচ্ছে। রুবেল জানায়, এখন প্রায় সময় তার বুকে ব্যথা করে ও শ্বাসকষ্ট হয়। বিকল্প কোনো কাজের সন্ধান না করতে পারায় তাকে বাধ্য হয়ে এ দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও বলছেন প্রতিনিয়ত কেউ এ ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে থাকলে তার বা তাদের শরীরের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। কেউ নিয়মিতভাবে এ ধরনের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে থাকলে তার গ্যাস, আলসার, হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। এ ধরনের পরিবেশে রোগ-জীবাণুও বেশি বংশ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয় বলে অন্যান্য রোগের প্রকোপও এসব এলাকায় বেশি থাকে। হাতিরঝিলের দুর্গন্ধ সম্পর্কে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারমান বজলুল করিম চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ‘তারা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এখানে ওয়াসার ড্রেনের পানিও আসে। ফলে তাদের সঙ্গেও কথা বলতে হয়। তারা ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। আশা করছেন শীগ্রই পরিস্থিতি উন্নত হবে। রাজউকের সচিব সুশান্ত চাকমা বলেন, এ বিষয়ে তারা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে কবে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে ও কবে তা বাস্তবায়ন হবে তা জানাতে পারেননি তারা কেউই। এ বিষয়ে রাজধানীর ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সুয়্যারেজ অথরিটির (ওয়াসা) ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খানের কাছে জানতে চাইলে তিনিও রাজউক কর্মকর্তাদের মতো নিজের ব্যস্ততার কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য যেসব মেশিন হাতিরঝিলে আছে তা ১০ দশমিক ৪৫ কোটি ঘনফুট বর্জ্য অপসারণ করতে সক্ষম। যা সঠিকভাবে কাজ করলে এ ঝিলের পানিতে কোনো ধরনের ময়লা থাকার কথা নয়। বরং এখানকার পানি নলকূপের পানির মতোই স্বচ্ছ থাকার কথা। তবে ব্যবস্থাপনার অভাব ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। উল্লেখ্য, হাতিরঝিল প্রকল্পটি এক হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩০২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা। অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে রয়েছে রাজউকের ৪৬ শতাংশ, সেনাবাহিনীর অধিনস্ত কোর্ট অব ওয়াক্স-এর ৮১ একর, জনগণের ১৪১ একর ও বিটিভির এক একর।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.