প্রবাসী ব্যক্তিদের পাঠানো আয় পাঁচ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন। গত নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে মাত্র ৯৫ কোটি ডলার। এর আগে ২০১১ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ ৯০ কোটি ডলার আয় পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী ব্যক্তিরা। এরপর থেকে প্রতি মাসেই আয় ছিল ১০০ কোটি ডলারের ওপরে।
ব্যাংকিং সূত্রগুলো বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থানকারী প্রবাসীদের আয় পাঠানো সবচেয়ে বেশি কমে গেছে। এ ছাড়া পাউন্ডসহ বিভিন্ন মুদ্রার দাম পড়ে গেছে। আবার বৈধ পথে কড়াকড়ির কারণেও অবৈধ পথে আয় পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। এসব কারণেই প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) প্রবাসী আয় এসেছে ৫২০ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৬১৭ কোটি ডলার। আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
সার্বিক অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার প্রভাব বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মোট জাতীয় আয় কমবে। বেসরকারি খাতের ভোগ-বিলাসও কমবে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)।
এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, বিদেশে অনেকে যাচ্ছেন, কিন্তু ফিরছেন কত—এর কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরতদের বেতন কমে গেছে, অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া নিয়মকানুন কঠোর হওয়ায় অনেকেই অবৈধ পথে অর্থ পাঠাচ্ছেন। ফলে দেশে এলেও এসব অর্থ হিসাবে আসছে না।
প্রবাসী আয় কেন কমছে, তা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও কাজ শুরু করেছে। এ নিয়ে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠকও করেছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলাবাজারে মার্কিন ডলারের দামের পার্থক্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ টাকার বেশি। ব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য গড়ে ৮০ টাকা হলেও, খোলাবাজারে তা ৮৪ টাকা দাঁড়িয়েছে। বেশি টাকার আশায় অনেকেই অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে এ নিয়ে বলা হয়েছে, দেশে নগদ ডলারের সংকট রয়েছে। এই সংকটের কারণে ব্যাংক ও খোলাবাজারে দামের পার্থক্য বাড়ছে। ফলে অবৈধ পথে আয় পাঠানো বাড়ছে। নগদ ডলার আমদানি করা গেলে এ সংকট দূর করা যেত। ডলারের বিপরীতে ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, মালয়েশিয়ান রিংগিত, সিঙ্গাপুর ডলারসহ বিভিন্ন মুদ্রার মূল্যমান কমে গেছে। ফলে এসব দেশের শ্রমিকদের আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকা কম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের দাম কমায় শ্রমিকদের আয় কমে গেছে। অনেক দেশে শ্রমিকদের বেতনও অনিয়মিত হয়ে গেছে।
পর্যবেক্ষণে আরও উঠে এসেছে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে বিকাশের নামে টাকা গ্রহণ করা হচ্ছে। এর পুরোটাই অবৈধ পথে দেশে আসছে। এসব কারণে ক্রমেই প্রবাসী-আয় কমছে।
সৌদিতে ১০ বছর ধরে কাজ করছেন ফেনীর দাউদ আহমেদ। বর্তমানে সৌদি টেলিকমে কর্মরত। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। গত ২০ নভেম্বর ফেনীতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অনেকেই চাকরি হারিয়ে পথে বসেছেন। বিদেশি যাঁরা কর্মরত আছেন, বিভিন্ন ফির নামে তাঁদের অর্থ কেটে রাখা হচ্ছে। খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবের দামও অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সেখানে বাংলাদেশিদের আয় অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল প্রথম আলোকে বলেন, বাজারমূল্যের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ডলারের পার্থক্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। ভারতীয় মুদ্রা বাতিল হওয়ার পর সবাই ডলারের দিকে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া পর্যটন মৌসুম চলায় ডলারের ওপরও চাপ বাড়ছে। ফলে দেশে অর্থ পাঠাতে অনেকেই অবৈধ উৎস বেছে নিচ্ছেন।
আসছে অবৈধ পথে, তবে নামে বিকাশ: মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরবসহ শ্রমিক অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে বিকাশের নাম ব্যবহার করে হুন্ডি ব্যবসা জমে উঠেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকেও অভিযোগ এসেছে। বিকাশের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে চলছে অবৈধ পথে টাকা পাঠানোর এই ব্যবসা। এতে আয়ের কোনো নথিপত্রের প্রয়োজন পড়ছে না। এর মাধ্যমে মিনিটেই অর্থ চলে আসছে প্রাপকের কাছে। ফলে বৈধ পথে আয় আসা কমে গেছে।
জানা গেছে, আইন কড়াকড়ির কারণে যেকোনো দেশ থেকে অর্থ পাঠাতে এখন আয়ের বৈধ সনদ চাইছে ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। এ ছাড়া পাঠানো অর্থের সুবিধাভোগী কারা তারও তথ্য দিতে হচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকগুলোর পরিবর্তে অবৈধ পন্থা বেছে নিচ্ছেন। আবার হুন্ডির মাধ্যমে এলেও দর ভালো পাওয়া যাচ্ছে।
সৌদিপ্রবাসী দাউদ আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে এখন খরচ বেড়ে গেছে। নানা রকম নথিপত্রও জমা দিতে হয়। এ ছাড়া ৩ হাজার সৌদি রিয়ালের বেশি পাঠালে অতিরিক্ত ১০০ রিয়াল চার্জ দিতে হয়। এ কারণে অনেকেই অবৈধ পথে অর্থ পাঠাচ্ছেন। বিকাশের মাধ্যমে আমরা এখন অর্থ পাঠাচ্ছি।’
অবশ্য বিকাশের গণমাধ্যম বিভাগের ব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে আমরা পাঠানো টাকা বিতরণ করতে পারি। বিষয়টা বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও আমরা জানিয়েছি।’
প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৪০ পয়সা: ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল করায় দেশে রুপির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর এই সুযোগে খোলাবাজারে ডলারের বাজার অস্থির করে তুলছেন ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর মতিঝিল ও গুলশানের খোলাবাজারে গত বৃহস্পতিবার প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোতেও ডলারের মূল্য প্রায় একই। যদিও ব্যাংকে ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের মূল্য ধরা হচ্ছে ৮০ টাকার নিচে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংকগুলোতে প্রতি ডলারের গড় মূল্য ৭৮ টাকা ৭৫ পয়সা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রতি ডলার ৮৩ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি হলেও গত বৃহস্পতিবার তা ৮৪ টাকা ৪০ পয়সা পর্যন্ত উঠেছিল। ভারতগামী ক্রেতারাও এখন ডলার কিনছেন। খোলাবাজারে সরবরাহ কম থাকায় ব্যাংক থেকেই ডলার কিনে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর মতিঝিলের দিলকুশা এলাকার ডলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিপন প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের সরবরাহ নাই। মাঝে মাঝে আসছে, তবে খুব কম। রুপি সহজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এ কারণে দামও বেড়ে গেছে।
সার্বিক বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারের দামের পার্থক্য অনেক। ফলে দেশে অর্থ এলেও বৈধ পথে আসা কমে গেছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.