চার বছর ধরে ফাইল টানাটানি। জাইকার ঋণ হাতছাড়া। শেষকালে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাতিল। সেবার পরিধি কমিয়ে সরকারি তহবিলের টাকায় আবার প্রকল্প গ্রহণ। ছয় মাসের প্রক্রিয়ায় দরদাতা নির্বাচন। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সেই দরপত্র বাতিল। তারপরই কর্মকর্তাদের ভারত সফর। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চার কার্যদিবসে চুক্তি সম্পাদন। এই হচ্ছে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা দিতে সুরক্ষিত ও উচ্চগতির অপটিক্যাল ফাইবার লাইন ও উচ্চক্ষমতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপন প্রকল্পের সাড়ে চার বছরের খতিয়ান। এরপরও কথা আছে, যেসব যন্ত্রপাতি কেনার জন্য এই চুক্তি, সেই যন্ত্রপাতি কোম্পানিটি তৈরি করে না। তাদের দেওয়া অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতার সনদও ভুয়া। অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ ও উচ্চক্ষমতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপন নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কারসাজির সূত্রপাত ২০১১ সালে। জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে ওই বছর টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় বিটিসিএল। দরপত্রের প্রাক্যোগ্যতা পর্যায়েই বাদ দেওয়া হয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ওই প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য মেনে নিয়ে দরপত্র ডাকতে বাধ্য হয় বিটিসিএল। এরপর দুই বছর ধরে প্রকল্পটির (লট-বি) দরপত্রের মূল্যায়ন চলে। তারপর কারিগরি ও আর্থিকভাবে গ্রহণযোগ্য দরদাতা নির্বাচিত হয় ওই প্রথম বাদ পড়া প্রতিষ্ঠানটিই। জাইকা তা পর্যালোচনা করে কাজের সম্মতি দেয়। পছন্দের প্রতিষ্ঠান কাজ না পাওয়ায় আবার টালবাহানায় নামে বিটিসিএল। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এর মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিবের নেতৃত্বাধীন বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ এক বৈঠকেই আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। জাইকা আগের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে বারবার তাগাদা দেয়। কিন্তু বিটিসিএল তা আমলে নেয়নি। গত বছরের শেষ দিকে জাইকা ঋণ প্রত্যাহার করে নিলে প্রকল্পটির অপমৃত্যু হয়। ওই প্রকল্পের কাজ কাটছাঁট করে চলতি বছর সরকারি টাকায় নতুন প্রকল্প হাতে নেয় বিটিসিএল। প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ঢাকা থেকে দেশের জল ও স্থলসীমানার চারটি পয়েন্ট কুয়াকাটা, বেনাপোল, আখাউড়া ও সিলেট এবং বগুড়া, খুলনা ও বরিশালের মধ্যে উচ্চক্ষমতার (১০০ জিবি) ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপন। প্রকল্প ব্যয় হবে আনুমানিক ২৭ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ পথগুলো যেন উচ্চগতিতে সংযুক্ত থাকে এবং কেব্ল কাটা গেলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক বিকল্প পথে টেলিযোগাযোগ-ব্যবস্থা যেন অব্যাহত থাকে। এর আগে নামমাত্র সুদে জাইকার ঋণে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তাতে এসব কাজের সঙ্গে বাড়তি ছিল দেশের প্রধান প্রধান শহরেও যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং পদ্মার তলদেশসহ মোট ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার লাইন বসানো। ওই প্রকল্পটি ছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকার। ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সারা দেশের টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা অনেক দ্রুতগতির হতো, সক্ষমতাও বাড়ত, যা সরকারের প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়। সেবার পরিধি কমিয়ে এবার যে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়েও শুরু হয় নয়ছয়। বিটিসিএল সূত্র জানায়, ঢাকা-কুয়াকাটা, ঢাকা-বেনাপোল, ঢাকা-আখাউড়াসহ সিলেট, বগুড়া, খুলনা ও বরিশালের মধ্যে উচ্চক্ষমতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় গত এপ্রিলে। প্রায় ছয় মাস সময় নিয়ে দরপত্রের প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। এরপর এ ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সিয়েনা থেকে যন্ত্রপাতি কেনার সুপারিশ করে কারিগরি কমিটি ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। সিয়েনার যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রস্তাবকারী প্রতিষ্ঠান নেতাশকে সফল দরদাতা মনোনীত করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু গত ১৫ অক্টোবর বিটিসিএল পরিচালনা পর্ষদ পুরো দরপত্র-প্রক্রিয়া বাতিল করে দেয়। অবশ্য ক্রয় আইনে নির্দিষ্ট কিছু কারণ ছাড়া এমন বাতিলের সুযোগ নেই। এই দরপত্র বাতিলের পরপরই ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ। যদিও ওই কোম্পানির এত উচ্চক্ষমতার যন্ত্রপাতি তৈরির পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই। এ ক্ষেত্রে দরপত্র ছাড়া সরাসরি ক্রয় করার কৌশল হিসেবে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস) ব্যবহার করা হয়। মাত্র চার কার্যদিবসে কেনাকাটার যাবতীয় কাজ শেষ করেছে বিটিসিএল। আর এটা করতে গিয়ে দরপত্র বাতিলসহ প্রতিটি পর্যায়ে সরকারি ক্রয় আইন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নথিপত্রে দেখা যায়, বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ট্রান্সমিশন লিংক স্থাপনের যন্ত্রপাতি বিনা দরপত্রে টেশিসের মাধ্যমে কেনার সিদ্ধান্ত হয় ৯ নভেম্বর। ওই পর্ষদ সভার সিদ্ধান্তে সবার স্বাক্ষর হয়েছে চার দিন পর ১৩ নভেম্বর। কিন্তু§তার আগেই ১০ নভেম্বর টেশিসের কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়। এত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল কারিগরি ও অর্থনৈতিক প্রস্তাব টেশিস থেকে পাওয়া যায় ওই দিনই। টেশিস সূত্র জানায়, টেশিস এ ধরনের যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে না। তারা ভারতের তেজাস থেকে যন্ত্রপাতি কিনে আনবে। নথিপত্রে দেখা যায়, বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ দরপত্র ছাড়া সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি অনুমোদন করার পরদিন বিটিসিএল টেশিসের কাছ থেকে কারিগরি ও আর্থিক তথ্য চেয়েছে। এরপর টেশিস তেজাসের কাছে প্রস্তাব চেয়েছে। তেজাস কারিগরি ও আর্থিক বিষয়াদির তথ্য দিয়েছে টেশিসকে। আর টেশিস তা যাচাই-বাছাই করে তাদের প্রস্তাব বিটিসিএলে জমা দেয়। এসব কাজ শেষ হয়েছে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে। ১০ নভেম্বর টেশিস থেকে কারিগরি প্রস্তাব পাওয়ার পর ১১ ও ১২ নভেম্বর সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। টেশিসের প্রস্তাব পরীক্ষার জন্য ১০ নভেম্বর গঠিত কমিটি ১৩ নভেম্বরের মধ্যে তা পরীক্ষা করে চূড়ান্ত করে ফেলে, আর ক্রয় প্রস্তাবসহ খসড়া চুক্তিও তৈরি করে। ১৪ নভেম্বর বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের আরেকটি জরুরি বৈঠক ডেকে ওই ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অর্থাৎ যাবতীয় কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে মাত্র চার কার্যদিবস! সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা যায়, সর্বশেষ দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত হয় ২৬ অক্টোবর। পরদিন ২৭ অক্টোবর তেজাসের খরচে ও আতিথেয়তায় টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন তিনটি কোম্পানি বিটিসিএল, সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি ও টেশিসের তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভারত সফরের আমন্ত্রণ পান। ৪ নভেম্বর তাঁরা ভারত ভ্রমণের প্রথম দিনেই তেজাসের সঙ্গে ঢাকা-কুয়াকাটায় যন্ত্রপাতি স্থাপন বিষয়ে একটি কার্যবিবরণীতে সই করেন। এরপর টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া এক পত্রে জানান, তাঁরা তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক তেজাসের ১০০ জিবি যন্ত্রপাতি পর্যবেক্ষণে সন্তুষ্ট হয়েছেন। বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ ৯ নভেম্বর বিনা দরপত্রে তেজাস থেকে সরাসরি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের অনুমতি দেয়। সরকারি ক্রয় বিধিমালা (তফসিল-১৩-এর কোড অব এথিকস) অনুযায়ী কোনো দরপত্র কিংবা প্রস্তাব বিবেচনা করার সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দাওয়াত কিংবা আতিথেয়তা গ্রহণ করা যায় না। ক্রয় আইনের ৬৪ ধারায় এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিন কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণে সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয় এবং তাঁরা তেজাসের আতিথেয়তায় ভারত ভ্রমণ করেন। ক্রয়বিধির ৭৬(ছ) ধারা ব্যবহার করে সরকারি কারখানা থেকে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি কেনা যায়। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, ওই যন্ত্রপাতি অবশ্যই ওই কারখানায় উৎপাদিত হতে হবে। আবার ভারতের যে কোম্পানি থেকে যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলা হচ্ছে, সেই কোম্পানিও সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি তৈরি করে না। কিন্তু টেশিস এক পত্রে বিটিসিএলকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়েনা ও কানাডার নরটেলের মতো বিখ্যাত কোম্পানিগুলো ভারতের তেজাস থেকেই এ-জাতীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করিয়ে নেয়। এখানেও তারা অসত্য তথ্য দিয়েছে। সিয়েনা গত অক্টোবরে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তারা কানাডা ও মেক্সিকোতে নিজস্ব অংশীদারি কারখানা ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশে, বিশেষত ভারতের তেজাসে ১০০ জিবি ক্ষমতার যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে না। সিয়েনা বাংলাদেশকে আরও জানিয়েছিল, কানাডার নরটেল ছয় বছর আগেই বিক্রি হয়ে গেছে। নরটেলের ট্রান্সমিশন অংশ তারা কিনে নিয়েছে। টেশিস ভারতের তেজাসের হয়ে বিটিসিএলকে দেওয়া চিঠিতে আরও দাবি করেছে, তেজাস কম্বোডিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৩ সালে ১০০ জিবির যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও স্থাপন করে দিয়েছে। এর সত্যতাও মেলেনি। টেলিযোগাযোগ-সংক্রান্ত খ্যাতনামা সাময়িকী টেলিজিওগ্রাফি, টেলকমএশিয়া, লাইটওয়েভ-এ প্রকাশিত সংবাদ হলো কম্বোডিয়ায় প্রথম ১০০ জিবি ক্ষমতার যন্ত্রপাতি স্থাপিত হয় ২০১৫ সালে। স্থাপন করে ‘চুয়ান উই’ নামক অপারেটর। আর যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী অ্যালকাটেল-লুসেন্ট (বর্তমানে নকিয়া)। নকিয়ার নিজস্ব ওয়েবসাইটে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে অ্যালকাটেল লুসেন্টের ২০১৫ সালের নথিতেও একই তথ্য পাওয়া যায়। জানতে চাইলে ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর’ বলে এ বিষয়ে টেশিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কবির হাসান কিছু বলতে রাজি হননি। এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি তেজাস নামে কোনো কোম্পানিকে চেনেন না। যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে টেশিসকে। তাঁর দাবি, এভাবে বিনা দরপত্রে কেনাকাটা করা যায়। সচিব একই সঙ্গে বিটিসিএল, টেশিসসহ পাঁচটি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান। ‘টেশিস এসব যন্ত্রপাতি তৈরি করে না, এটা ঠিক’—বললেন সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী। তাহলে টেশিস উচ্চক্ষমতার এসব যন্ত্রপাতি কোথা থেকে আনবে? জবাবে সচিব বলেন, ‘তেজাস-তুজাস চিনি না। টেশিস যেখান থেকে খুশি আইন্যা ওরা সংযোজন করবে।’ সচিব ফয়জুর রহমান তেজাসকে চেনেন না বললেও ১৮ আগস্টের এক সরকারি পত্রে দেখা যায়, তিনি ওই মাসেই তেজাসের আতিথেয়তায় ভারতে যান এবং তেজাসের অফিস ও কারখানা ভ্রমণ করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.