বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস সমাগত। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। বাঙালি জাতির জন্য দিনটি পরম গর্বের, বিশেষ করে বাংলাদেশিদের জন্য। এ দিনটি পৃথিবীর মানচিত্রে একটা নতুন সার্বভৌম দেশের নাম চিরকালের জন্য জন্য এঁকে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস ধরে স্বাধীনতার জন্য নিবেদিত প্রায় ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণ ও দুই লাখ মা–বোনের ইজ্জত বিসর্জনের বিনিময়ে এই মুক্তিপথ অর্জিত হয়েছে।
বিজয় দিবস বা ভিক্টরি ডে বলতে আমরা কি বুঝি? মূলত সাধারণ দিনগুলির মধ্য থেকে এটি কোনো এক বিশেষ দিনের অসাধারণ একটি নাম। অনেক দেশের অনেক জাতীয় ছুটির দিন আছে বিভিন্ন কারণ, বৈশিষ্ট্য বা তাৎপর্য অনুযায়ী। সেই উপলক্ষ ও তাৎপর্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে আলাদা হতে পারে। কিন্তু ভিক্টরি ডের তাৎপর্য সব দেশে একই। জাতীয় এই ছুটির দিনে দল–মত নির্বিশেষে সমগ্র জাতি এক হয়ে জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়লাভের স্মৃতিচারণ করে। একদিকে যেমন গৌরবে তাদের বুক ফুলে ওঠে, উল্লাসে ফেটে পড়ে, অন্যদিকে দেশের এই গৌরব এনে দিতে যারা প্রাণদান করেছেন, তাদের স্মৃতিচারণ করেন এবং অংশগ্রহণকারী যারা সেই গৌরবের যুদ্ধের পর এখনো বেঁচে আছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। বিজয় দিবস বা ভিক্টরি ডের ইতিহাসটা কিন্তু বেশি দিনের নয়। সংক্ষেপে একটু ঘুরে ফিরে দেখা যাক। ১৯৪৫ সালের ২ মে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। পর্যুদস্ত জার্মান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করে ৪ ও ৫ মে তারিখে। কিন্তু বাস্তবে সরকারিভাবে যুদ্ধ শেষ হয় ৮ মে মধ্যরাতে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে ধরে রাখার জন্য রাশিয়ানরা ঠিক পরের মুহূর্ত, অর্থাৎ ৯ ইং মে তারিখটাকে বিজয় দিবস বা ভিক্টরি ডে নাম দিয়ে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে উদ্যাপন করা শুরু করে। নাৎসি জার্মানি যখন রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে, রাশিয়ার সেনারা চতুর রণকৌশলে জার্মান সেনাবাহিনীকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য করে। ঠেলতে ঠেলতে তাদের বার্লিন পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে আসে। যুদ্ধ তখন রাশিয়ার মাটিতে না হয়ে আক্রমণকারী জার্মানদের নিজেদের মাটিতেই হয়। যুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। কিন্তু ঠিক জয়ের উৎসব হিসেবে নয়, ভিক্টরি ডে উদ্যাপনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, যারা যুদ্ধে মারা গেছেন তাদের সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা। দেশ রক্ষায় তাদের আত্মাহুতির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এই দিন যুদ্ধে মৃত সৈনিকদের কবরে ফুল দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে এখনো যারা বেঁচে আছেন, তারা সেদিন তাদের অর্জিত তকমা ও মেডেলগুলো ঝুলিয়ে মিলিটারি পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিলে বের হন। রাশিয়া যুদ্ধে নেমেছিল মূলত আক্রমণকারীদের কাছ থেকে নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষার তাগিদে। সে জন্য তারা এই যুদ্ধটাকে দেশপ্রেমের যুদ্ধ মনে করেন। সে হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাদের কাছে দেশপ্রেমের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতিটি পরিবার থেকে অন্তত একজন সদস্য সমরে যোগদান করেছিল। বার্ধক্যজনিত কারণে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে পারেননি, তাদের অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানায় কাজ করতে হয়েছিল। সেটা যুদ্ধে যাওয়ার চেয়ে নেহাত কম কষ্টকর ছিল না। ৬ ডিসেম্বর রাশিয়ায় ভিক্টরি ডে সেলিব্রেশন শুরু হয় যুদ্ধফেরত জীবিত সৈনিকদের প্রতি সে দেশের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অভিনন্দনের বাণীর পত্র দিয়ে। প্যারেড, ফুলের তোড়া, ভূরিভোজন ও উপহার বিতরণ ইত্যাদি দিনটি পালনের একটা অঙ্গ। প্রেসিডেন্টের অনুকরণে বড় ছোট সব অঞ্চলের প্রধানেরা নিজ নিজ এলাকায় অনুরূপ ব্যবস্থা নেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস পালনে এ বিষয়ে গভীর মিল আছে। বিজয় দিবসকে নানা দেশে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ডাকলেও এর মানে বা তাৎপর্য মোটামুটি একই। মজার ব্যাপার হলো এই ভিক্টরি ডে সারা বছর ধরে চলতে থাকে। এমনকি একই মাসে কয়েকটি দেশে ভিক্টরি ডে প্রতিপালিত হয়। কয়েকটি নমুনা দেওয়া যাক। কম্বোডিয়া ৭ জানুয়ারি। অ্যাঙ্গোলা ২৭ মার্চ। ভিয়েতনাম ৭ মে। ইউরোপ ৮ মে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ৯ মে। শ্রীলঙ্কা ১৮ মে। এস্তোনিয়া ২৩ জুন। ভারত ২৬ জুলাই। উত্তর কোরিয়া ২৭ জুলাই। লাওস ১ আগস্ট। ক্রোয়েশিয়া ৫ আগস্ট। তুরস্ক ৩০ আগস্ট। তাইওয়ান ৩ সেপ্টেম্বর। মোজাম্বিক ৭ সেপ্টেম্বর। মাল্টা ও পাকিস্তান ৮ সেপ্টেম্বর। ইতালি ৪ নভেম্বর। বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর। এ ছাড়া পৃথিবীর আরও কিছু দেশে অন্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেও ভিক্টরি ডে পালন করা হয়। মিশর ২৩ ডিসেম্বর ভিক্টরি ডে পালন করে তিন পরাশক্তির যৌথ আক্রমণ শেষ হওয়ার দিন হিসেবে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে রাশিয়া যেমন ৯ মে তারিখে অনুষ্ঠান করে, তেমন ফ্রান্সও এ উপলক্ষে ৮ মে ভিক্টরি ডে পালন করে। আমেরিকার হাওয়াই ও রোড আইল্যান্ড স্টেটে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সোমবার ভিক্টরি ডে, বিশেষ করে ভিক্টরি ওভার জাপান ডে হিসেবে প্রতিপালিত হয়। এক সময় দিনটাকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালন করা হতো। পরে দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিনের তালিকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তার কারণ যুদ্ধটাকে যেভাবে শেষ করানো হয়েছে-১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকির ওপর অ্যাটম বোমা ফেলে, তার স্মৃতিচারণ মোটেও উল্লাস করার মতো কোনো ব্যাপার নয়। অবশ্য রোড আইল্যান্ড দিনটাকে জাতীয় না হলেও, স্টেট হলিডে হিসেবে পালন করে। তারা এটা স্মরণে রাখতে চায় যে, তাদের স্টেটই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সেনা পাঠিয়েছিল এবং পার্ল হারবারের জাপানি হামলায় তাদের স্টেটের সেনারা অনুপাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারান।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.