ভোর ৫টায় অ্যালার্ম দেওয়া ছিল। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে রওনা দিলাম। সঙ্গে সপ্ত আর পাপলুদা। তিনজনের গন্তব্য ‘কুমারী’ বন রেমা কালেঙ্গা। কিন্তু একটু পরই দেখি বেশ জোরেই বৃষ্টি নামল। ক্ষণিকের জন্য রাস্তার ধারে আশ্রয় নিতেই দেখি বৃষ্টির মায়া হলো! সূর্য মামাও নিজের অস্তিত্ব জানান দিল। দ্রুত গাড়ি ছোটানো হলো আবার। চুনারুঘাটের কাঙ্ক্ষিত রেমা কালেঙ্গার সরু পথ ধরে ছুটলাম। পথের দু’ধারে নৈঃস্বর্গিক সব দৃশ্য দেখতে দেখতে গাড়ি পৌঁছাল বর্জুসে। সেখানকার কর্দমাক্ত পিচ্ছিল পথে ১৫ মিনিট হেঁটে উঠে পড়লাম ভাড়া করা বাইকে। অল্পক্ষণ পরই রেমা কালেঙ্গার মূল গেটের সাক্ষাৎ পেলাম।
ফোন করে দিয়েছিলাম আগেই, পৌঁছাতেই দেখা গেল আদিবাসী গাইড রবিন টুডুর হাসি মাখা মুখ। শক্ত সামর্থ্যবান চেহারা, বয়স কুড়ি খানেক হবে। তাঁকে নিয়ে গভীর অরণ্যের পথে পা বাড়াই। গাইড টুডু জানাল, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার ট্রেইল পথ রয়েছে। আমি এক ঘণ্টার ট্রেইল পথেই সায় দিলাম। অন্যরাও আপত্তি করল না। এগোতেই ওয়াচ টাওয়ার দেখা গেল। চট করেই উঠে পড়লাম আমি, পেছন পেছন পাপলু দা। সপ্ত নিচেই দাঁড়াল। ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে পুরো বনকে অদ্ভূত সুন্দর লাগল! অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। চারপাশে সবুজের মেলা, বৃষ্টির পরশে গাছের পাতাগুলো চকচক করছিল। নিচে তাকাতেই অসম্ভব সুন্দর একটি লেক। লেকের চারপাশ এতই প্রাকৃতিক যে, মনেই হলো না লেকটা কৃত্রিম। বনে পানির চাহিদা মেটাতে এবং প্রাণীদের পিপাসা মেটাতেই এই লেক তৈরি হয়েছে নাকি।
রেমা কালেঙ্গা বন বিভাগের অন্তর্গত। বনবিভাগকে সহায়তা করে আইপ্যাক। জানা যায়, ১৯৯৪ সালে এখানকার প্রায় এক হাজার ৮০০ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। ১৩ হাজার ২১৭ দশমিক ২১ একর মোট আয়তনের বনে চাপালিশ, গর্জন, গামারি, জারুল, জাম, বনাক, আকাশি ও সেগুনসহ নানা ধরনের গাছ-গাছালি আছে। ভয়ঙ্কর আয়তনের কিছু গাছও আছে। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ হতে পারে কারো কারো। এখানে ২০০ জাতের পাখি আছে। আছে চিতাবাঘ, মেছোবাঘ, বার্কিং ডিয়ার কুলু বানর, চশমা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, মুখপোড়া হনুমান, কালো কাঠবিড়ালি। শোনা যায়, ময়না বিলে বিপন্ন প্রজাতির উড়ন্ত কাঠবিড়ালিও আছে। যদিও আমরা তা দেখার সুযোগ পাইনি।
পাপলু দা এই বনে আগেও এসেছেন। তিনি জানালেন, বনের ঠিক মাঝখানে কারিঙ্গী নদী। এসেছে ভারতের ত্রিপুরা হয়ে। অসম্ভব সুন্দর নাকি সে নদী। দেখার জন্য মন আকুপাকু করলেও সময়ের অভাবে যেতে পারলাম না। ত্রিপুরা, সাঁওতাল, উড়ং এই তিন সম্প্রদায় মিলেমিশে এখানে বসবাস করছে যুগ যুগ ধরে বলে জানাল টুডু। দেখা পেলাম বন মোরগ আর তার ডিমের। হঠাৎ রবিন টুডু মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলল। খুব আস্তে বলল, ‘ঝাঁজালো গন্ধ পাচ্ছি। বিষাক্ত সাপ আছে আশপাশে।’ সাবধানে দ্রুত এগোলাম। এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের মাঝে আমরা এগিয়ে চলছি। ফেরার পথ ধরতে হবে বলল সপ্ত।
নিচে নেমে ট্রেইল ধরে এগোতেই জোঁকে আক্রমণ করেছে জানাল পাপলু দা। দেখলাম, সত্যিই সত্যিই জোঁক সেটে আছে তার পায়ে। দ্রুত সেটা ছোটাতে সাহায্য করলাম। ফিরতি পথ ধরতেই ফসলের মাঠে ঢেউ তুলে দমকা হাওয়া দেহমন জুড়িয়ে দিয়ে কানে কানে ফিস ফাস করে বলল,‘এত দ্রুত চলে যাবে?’ হ্যাঁ, ফিরে তো যেতেই হবে। নিজেকে শান্ত করি আমি। এমন স্বর্গীয় উদ্যান কে ছেড়ে যেতে চায়? কিন্তু পেছনে রেখে আসা ‘নাগরিক’ জীবনে ফিরতেই তো হবে। তাই ফেরার সময় কষ্ট নিয়েই বারবার বনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। মনে মনেই বলছিলাম, বিদায় বনের রাজা রেমা, বিদায় নিসর্গের রানি কালেঙ্গা।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সিলেটগামী বাস কিংবা ট্রেনে চড়ে নামতে হবে শায়েস্তাগঞ্জ। সেখান থেকে অটোরিকশায় চেপে যেতে হবে কালেঙ্গা। বাসে শায়েস্তাগঞ্জের ভাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। ট্রেনে গেলে শায়েস্তাগঞ্জে থামে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেন উপবন এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে এই ট্রেন। আসন ভেদে ভাড়া ১৫০ থেকে ৭০০ টাকা। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে কালেঙ্গার বেবি টেক্সি ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। কালেঙ্গা যাওয়ার অন্য পথটি হলো— ঢাকা থেকে বাস কিংবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে জিপে চড়ে কালেঙ্গা। শ্রীমঙ্গল থেকে গেলে জঙ্গলের ভেতরের দীর্ঘ পথটি চলতে ভালো লাগবে সবার। শ্রীমঙ্গল থেকে কালেঙ্গার জিপ ভাড়া দুই থেকে তিন হাজার টাকা। বর্ষা মৌসুমে দুটি পথই বেশ কর্দমাক্ত থাকে বলে চলতে অসুবিধা হতে পারে। তবে খুব উপভোগ করা যাবে।
কোথায় থাকবেন
কালেঙ্গায় থাকার ভালো কোনো ব্যবস্থা নেই। বন বিভাগের বিশ্রামাগার অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গা। তবে সেজন্যে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি লাগবে। এ ছাড়া নিসর্গ তরফ হিল কটেজে (০১৭৩১৯৭৭৮০৭) থাকতে পারেন। কটেজের তিনটি কক্ষে আট জন থাকা যায়। বড় দুটি কক্ষের ভাড়া এক হাজার টাকা আর ছোটটির ভাড়া ৭০০ টাকা। প্রতিবেলা খাবারের খরচ জনপ্রতি ২০০ টাকা। আর সকালের নাস্তা ৬০ টাকা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.