স্টকহোমে উঠেছি আরস্ত্রাভাইকেন হোটেলে। সেখান থেকে যেতে হবে গ্যামলা স্তান—নোবেল মিউজিয়ামটা সেখানেই। গ্যামলা স্তানে নেমে এক কিশোরীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নোবেল মিউজিয়ামে যাব, ওটা কি অনেক দূরে?’ ‘আরে না!’ মোবাইল ফোনটা সরিয়ে রেখে বলল মেয়েটি। তারপর চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবল। বলল, ‘এই যে সোজা রাস্তাটা ওপরে উঠে গেছে, ওটার শেষ পর্যন্ত যাবে, তারপর প্রথম লেফট, প্রথম রাইট, আবার প্রথম লেফট, প্রথম রাইট, দেখবে নোবেল মিউজিয়ামে পৌঁছে গেছ!’ দুর্বল ইংরেজিতে রসিকতা করতে ছাড়ি না, ‘তার মানে মার্চপাস্ট? লেফট-রাইট-লেফট-রাইট?’ দারুণ মজা পেল মেয়েটি। খিলখিল করে হেসে উঠল। বিদায় নিয়ে ওর বলে দেওয়া পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। গ্যামলা স্তান কথাটার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘পুরোনো শহর’। মধ্যযুগ আর রেনেসাঁ যেন মিলেমিশে আছে এখানে। নোবেল মিউজিয়াম ছাড়াও এখানে আছে রয়্যাল প্যালেস সেন্ট নিকোলাস ক্যাথিড্রাল। ছোট ছোট ইট দিয়ে তৈরি সড়ক। কেউ রাস্তায় বুট পরে হাঁটলে যে শব্দ হয়, তা ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে কানে এসে লাগে। রাস্তার দুপাশে দোকান আর দোকান। খাবার-দাবারের দোকান অনেক, আছে অ্যাক্টিকের দোকান। সরু রাস্তার দুপাশে বাড়ি। বাড়িগুলো একে অপরের গায়ে লাগানো প্রায়। চিকন গলিঘুঁজি একের পর এক চলে গেছে। তবে বলতেই হয়, দারুণ গোছানো ছিমছাম প্রতিটি রাস্তা। বাড়ির সামনে রাস্তার নাম আর বাড়ির নম্বর দেওয়া আছে। পথ ভুল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নোবেল মিউজিয়ামে নয় শতাধিক নোবেল বিজয়ীর যে ছবিগুলো আছে, তা অন্য মিউজিয়ামগুলোর মতো দেয়ালে টাঙানো নেই। সেগুলো ঝুলছে হ্যাংগারে ঝুলে থাকা জামার মতো। একটার পর একটা দাঁড়িয়ে আছে ছবিগুলো। কিন্তু যখন একটা বোতাম টিপে দেওয়া হয়, তখন সেগুলো চলতে শুরু করে। মাথার ওপর দিয়ে একটির পর একটি ছবি যেতে থাকে। ছবিতে লেখা আছে নোবেল বিজয়ীর নাম এবং নোবেল পাওয়ার বছর। সত্যিই ভালো লাগে দেখতে। অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখা যায়, কিংবা অমর্ত্য সেন বা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তখন মনটা বড় হয়ে ওঠে। অন্য দর্শনার্থীদের বলতে ইচ্ছে করে, ‘দেখো, এরা বাঙালি।’ ফিরে আসার সময় এখানে রাস্তায় কোথাও ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি। লাল বাতি দেখার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে গাড়ি, রাস্তা যতই ফাঁকা থাক। আলো পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকে। তবে পথচারীদের নিয়ে এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা যাবে না। ব্যস্ত রাস্তায় দেখেছি সবুজ বাতি পর্যন্ত অপেক্ষা করে সবাই। কিন্তু ছোটখাটো রাস্তায় রাস্তার নিয়ম মানে না। সুযোগ পেলেই দৌড়ে পার হয়ে যায়। শিশু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য এ শহর স্বর্গতুল্য। মেট্রোতে তাদের জন্য লিফটও আছে। শুধু মায়েরা নন, বাবারাও শিশুদের নিয়ে বের হয়ে পড়ছেন রাস্তায়। স্টকহোমে পাবলিক ট্রান্সপোর্টকে উৎসাহিত করা হয়। তাই মেট্রো, বাসে মানুষের যাতায়াত বেশি। বাসগুলো সব ঝকঝকে তকতকে। ৯ ডিসেম্বর স্টকহোমের সিটি কনফারেন্স সেন্টারে দিনব্যাপী যে নোবেলসংলাপ হবে, তা নিয়ে বেশ উৎসাহ আছে মানুষের। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও উপস্থিত থাকবেন। মোট ১৩০০ অতিথির সামনে খাদ্য ও খাদ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে। সকাল ১০টায় টারা গারনেটের ‘ইয়োর প্লেট, আওয়ার প্ল্যানেট’ বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হবে এ আয়োজন। এরপর আনগাস ডিয়াটন বলবেন ‘খাদ্য, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি’ নিয়ে। ট্রিস্টাম স্টুয়ার্ট বলবেন আবর্জনার অর্থনীতি বিষয়ে। জোহান রকসন্ট্রম বলবেন ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্যকর ও টেকসই খাদ্য’ নিয়ে। এরপর থাকবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কথোপকথন। এভাবেই দুটো বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠান। প্রতিবছরই নোবেলসংলাপ নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকে। বিভিন্ন বছর বিভিন্ন বিষয়ে এ সংলাপ হয়। এবারের বিষয় খাদ্য বলে আলাদা একটা আগ্রহ আছে মানুষের। কিন্তু মাত্র ১৩০০ আসন বলে এর বাইরে কেউ এতে অংশ নিতে পারবেন না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.