শস্য ভা-ারখ্যাত দেশের বুত্তর চলনবিল অঞ্চলের প্রাচীন ঐতিহ্য ধানের গোলা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ অঞ্চলের ৫টি জেলার প্রায় ২০টি উপজেলায় এখন আর ধানের গোলা তেমন চোখে পরে না। কোথাও কোথাও ধানের গোলার খোঁজ মেলা দায় হয়ে পড়েছে। তাই বলা যায় সিরাজগঞ্জ-পাবনাসহ সমগ্র চলনবিল অঞ্চলে গ্রাম বাংলার সেই ধানের গোলা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে ক্রমেই অপরিচিত হয়ে উঠছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো জাদুঘরে এই ধানের গোলা দেখতে হতে পারে। জানা গেছে, কৃষকের সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কৃষি জমিতে এখন তৈরি হচ্ছে বসবাসযোগ্য ঘরবাড়ি। হারিয়ে যাচ্ছে কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী গোলা। বর্তমানে মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত থাকলেও অধিকাংশ কৃষকের বাড়িতে নেই ধান মজুদ করে রাখার বাঁশ, বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি গোলাঘর। অথচ একসময় সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করতো কার কয়টি ধানের গোলা আছে। বর-কনে পাত্রস্থ করতেও ধানের গোলার খবর নিত বর-কনের লোকজন। যা এখন শুধু কল্পকাহিনী। গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ দিয়ে গোলাকৃতির তৈরি ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। কৃষকরা ধান কাটার মৌসুম এলেই পাটনিদের কাছে ধান রাখার গোলা তৈরির জন্য খবর দিত। তারা বাড়িতে এসে বাঁশ দিয়ে তৈরি করত গোলা। সিরাজগঞ্জ জেলার বিল অঞ্চল এলাকায় অধিক জমির কৃষকদের ধানের গোলা দেখা যেত মিসরের পিরামিড আকৃতির মতো। দেখা যেত অনেক দূর থেকে। কৃষি অধ্যুষিত এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে বাঁশ, বাঁশের বাতা ও কঞ্চি দিয়ে প্রথমে গোল আকৃতির কাঠামো তৈরি করা হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্গ বা আয়তক্ষেত্র আকারে গোলা তৈরি করা হতো। এঁটেল মাটির কাদা তৈরি করে ভিতরে ও বাইরে আস্তর লাগিয়ে দিত। এর প্রবেশপথ রাখা হতো বেশ ওপরে, যেন চোর/ডাকাত চুরি করতে না পারে। সেই সঙ্গে ইঁদুরও ধানের গোলায় ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি করতে পারতো না। ধানের গোলা বসানো হতো উঁচুতে। গোলার মাথায় থাকত বাঁশ ও খড়ের তৈরি বা টিনের তৈরি ছাউনি। গোলায় শুকানো ভেজা ধানের চাল হতো শক্ত। কিন্তু সম্প্রতি রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আধুনিক কলের লাঙ্গল যেন উল্টে-পাল্টে দিয়েছে কৃষি অঞ্চলের চিত্র। গোলায় তোলার ধান আর তাদের থাকে না। গোলার পরিবর্তে কৃষকরা ধান রাখা শুরু করে বাঁশের তৈরি ক্ষুদ্রাকৃতি ডোলায়। ধান আবাদের উপকরণ কিনতেই কৃষকের বিস্তর টাকা ফুরায়। বর্তমানে সংসারে যেটুকু খাদ্যের প্রয়োজন, তা কৃষকরা চটের বস্তা বা ব্যারেলভর্তি করে রাখছে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধান-চাল। নব প্রজন্মের কাছে গোলাঘর একটি স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। এখন আধুনিক গুদামঘর ধান-চাল রাখার জায়গা দখল করছে। ফলে গোলাঘরের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু কি তাই? কাঠের নাঙ্গল, ঢেঁকি, কাঠের উলকিসহ বিভিন্ন প্রাচীন এসব সমগ্রী বিলুপ্তির পথে। সেই সাথে গ্রাম বাংলার ঐহিত্য হিসেবে ধনীদের বাড়িতে থাকতো কাচারি ঘর বা বৈঠক খানা। সেই ঐহিত্য গ্রাম বাংলা থেকে এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐহিত্যগুলো ধরে রাখার জন্য প্রাযোজনীয় ব্যবস্থা জরুরিভাবে গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যত প্রজন্ম এ প্রাচীন এতিহ্য দেখতে জাদুঘরেই যেতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.