খেলার বয়স তখনও পার হয়নি। বাবার সঙ্গে মাজারের ওরসে যাওয়ার বায়না ধরতেন শিশু আমেনা। বাউল শিল্পীদের গান শুনতেন মন দিয়ে। গুন গুন করে গাইতেন আপনমনে। কখনও একাকী আবার কখনও গলা ছেড়ে। শিল্পীর সুপ্ত প্রতিভা যে কন্যার মধ্যে লুকায়িত আছে সেটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তার কৃষক পিতা। স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই মাজারের ওরসে যাওয়ার নেশা পেয়ে বসে। ঘুরে বেড়াতেন মাজারে মাজারে। ততদিনে রপ্ত করে ফেলেন বাউল গান। আয়ত্ত করে ফেলেন একতারা-দোতারা বাজানোর তরতরিকাও। কিশোরী আমেনার সুরেলী কণ্ঠের নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। পাড়া-পড়শী হররোজই বাড়িতে এসে খোঁজ নেন। বায়না ধরেন তার গান শোনার। নিরাশও করেননি কাউকে। যেই আসতেন দুই-চার কলি গেয়ে শোনাতেন। একপর্যায়ে গানই তার নেশা হয়ে যায়। বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। চলে আসেন রাজধানীতে। উঠেন মালিবাগ এলাকার পূর্বপরিচিত এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায়। হাতে-কলমে গান শিখতে যান উস্তাদের কাছে। প্রথমে দৌলতউদ্দিন বয়াতির কাছে বাউল গানের তালিম নেন। পরে উস্তাদ ইসহাক সরকারের কাছে গান শিখেন। বছরখানেকের মধ্যেই পুরোদস্তুর শিল্পী হয়ে উঠেন। মাজারে মাজারে গান করে বেড়ান। মাঝে-মধ্যে স্টেজ শোতেও অংশ নেন। এরইমধ্যে বের হয় আমেনার গানের অডিও ক্যাসেট। একদিন হাইকোর্ট মাজারে আমেনার গানের ক্যাসেট বাজছিল। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলেজের প্রফেসর অধ্যাপক রায়হান। আমেনার জাদুকরী কণ্ঠ ছুঁয়ে যায় ওই প্রফেসরের মন। মাজারের এক ব্যক্তির কাছে বাউল শিল্পীর পরিচয় জানতে চান এবং তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ওই ব্যক্তি জানান, প্রতি বৃহস্পতিবারই হাইকোর্ট মাজারে গান গাইতে আসেন আমেনা। পরের সপ্তাহেই আমেনার দেখা পান অধ্যাপক। আসরে বসে সারারাতই গান শুনেন আমেনার। এরপর যেখানেই আমেনার গানের আসর হতো সেখানেই ছুটে যেতেন ওই অধ্যাপক। প্রায় দুই বছর পর আমেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তিনি। ছোট আয়োজনে ঢাকার একটি কাজী অফিসে বিয়ে হয় তাদের। অধ্যাপক রায়হানের বাড়ি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার সোহাগপাড়ার গ্রামে হলেও ঢাকায় শুরু করেন সংসার। বিয়ের পর মাজারে মাজারে গিয়ে গান গাইতে বারণ করেন স্বামী। তবে সংসারে তিতু হতে পারেননি আমেনা। ছাড়তে পারেননি গান গাওয়ার নেশাও। প্রায় সময়ই বাসা থেকে বেড়িয়ে চলে যেতেন মাজারে। এদিকে বছর খানেক পর আমেনার কোলজুড়ে আসে পুত্র সন্তান। শিশু নাহিদকে বাসায় রেখেই বেড়িয়ে পড়তেন বাউণ্ডুলে আমেনা। অসহায় স্বামী তাকে মাজার থেকে খোঁজে নিয়ে বাসায় আনতেন। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে জামানের জন্ম হয় তার। ছেলে জন্মের ১৫ দিন পরই স্বামীকে হারান। দুই শিশু পুত্র নিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে যান আমেনা। বড় ছেলে স্বামীর প্রথম স্ত্রীর কাছে রেখে গ্রামে চলে আসেন ছোট ছেলেকে নিয়ে। প্রায় দুই বছর লালনপালনের পর গানপাগল আমেনা ছেলেকে এক নিকটাত্মীয়কে পালক দিয়ে দেন। এরপর নিঃসঙ্গ আমেনা গান করে বেড়ান মাজারে মাজারে। তাতে বাদ সাধেন বাবা। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়। অভিমান করে ফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। এমনকি দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বেনাপোল দিয়ে প্রবেশ করেন ভারতে। এরপর পাঞ্জাব দিয়ে চলে যান পাকিস্তানে। ইসলামাবাদের অদূরে একটি গ্রামে আশ্রয় নেন। ছন্নছাড়া আমেনাকে আপন করে নেন ওই গ্রামের মানুষ। থাকার ব্যবস্থা করে দেন একটি বাড়িতে। সেখানে হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। হাঁস-মুরগি বিক্রির টাকা দিয়ে মহিষও কেনেন। মহিষের দুধ বিক্রি করে টাকা সঞ্চয় করেন। গ্রামের মানুষরা তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। এভাবে ভালই চলছিল আমেনার জীবন। হঠাৎ একদিন তার জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। শীতের সকালে মহিষের দুধ দোহন করছিলেন। ওই সময় যমদূত হিসেবে আবির্ভূত হয় মহিষ। পা দিয়ে লাথি মেরে তাকে ফেলে দেন। এরপর তার হাতের ওপর দৈত্যকার মহিষ পাড়া দেয়। এতে তার ডান হাতের হাড় ভেঙে যায়। এরপর ওই গ্রামের এক প্রতিবেশী তাকে উদ্ধার করে কাপড় দিয়ে হাত বেঁধে দেন। আর কিছু কবিরাজি ওষুধ দেন। কদিন পর আমেনা দেখেন- তার হাতে পচন ধরেছে। এরপর দ্রুত তাকে রাওয়ালপিণ্ডির সিভিল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখেন- তার হাতে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার। এর বিস্তার ঠেকাতে চিকিৎসকরা দ্রুত তার বাহুর নিচ থেকে ডান হাত পুরো কেটে ফেলে দেন। এদিকে হাসপাতালে অপারেশন চলাকালে জ্ঞান ফেরার সময় নিজের আসল পরিচয় (গ্রাম-ঠিকানা ও পিতার নাম) বলতে থাকেন। চিকিৎসকরাও এটা নোট করেন। এর আগে পাকিস্তানে থাকাকালে কারও কাছে নিজের আসল ঠিকানা বলেননি তিনি। হঠাৎ একদিন বাংলাদেশে বাবার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই চিঠিতে তার দুর্ঘটনার খবর জানান। পরে ফিরতি চিঠি পাঠান আমেনার বাবা হাসপাতালের ঠিকানায়। ওই চিঠিও আমেনার হাতে পৌঁছে। চিঠিতে ভাই-বোন ভাল থাকার কথা জানান এবং বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুরোধ করেন বাবা। তবে ওই চিঠি পাওয়ার পর কোন উত্তর দেননি আমেনা। খোঁজও নেননি পরিবারের। ফিরে যান ইসলামাবাদের ওই গ্রামে। অসহায় আমেনার পাশে দাঁড়ায় পুরো গ্রামের মানুষ। গ্রামের ছেলে-মেয়েরাও নিঃস্ব আমেনাকে মা বলে ডাকতেন। যখন যা প্রয়োজন হতো সবই দিতো তারা। দীর্ঘ ২০ বছর পাকিস্তানে থাকায় উর্দু ভাষা রপ্ত করে ফেলেন। অনর্গল বলতেও পারেন। এদিকে ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে হঠাৎ দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন আমেনা। তখন পাকিস্তানি ওই গ্রামের মানুষরা তাকে পাসপোর্ট ও ভিসার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন। এমনকি তিন মাসের পর ফিরতি বিমান টিকিটও করে পাকিস্তানিরা। দেশে ফিরে আসেন। উঠেন হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার বেলঘর গ্রামের পিতার ভিটায়। দেখেন জন্মদাতা পিতা মোর্তুজ আলী চলে গেছেন পরপারে। এরপর সন্তানের খোঁজে ছুটে আসেন স্বামীর কর্মস্থল মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলেজে। খোঁজ নেন বড় ছেলে নাহিদের। কিন্তু পাননি ছেলের সন্ধান। এমন কি ছেলেও জানেন না- মা বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন। তবে ছোট ছেলে জামানের খোঁজ পেয়েছেন। দেখাও হয়েছে মা-ছেলের। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস- নারীছেঁড়া সেই ধনের কাছে যেন সেই গর্ভধারিণী মা এখন দূরপরবাসের কোন অচেনা অতিথি। মাকে চিনতে পারলেও আপন করে নিতে পারেননি ছেলে। এমনকি মায়ের খোঁজ নেন না শিক্ষকপুত্র। মা ফোন করলেও ছেলে বিরক্ত বোধ করেন। অসুস্থতার জন্য চিকিৎসার কথা বললে এড়িয়ে যান। তবুও কোন আক্ষেপ নেই আমেনার। জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এই শিল্পী। ফিতরা-যাকাতের টাকা তুলে দুবেলা দুমোটা খাবার জোগান। হাতে টাকা না থাকলে কোন বেলা থাকেন উপোস। ছয় মাস পর প্রতিবন্ধী ভাতা পান ১৫০০ টাকা। তাও অনেক খেয়ে ফেলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তরুণী বয়সে মরণব্যাধি ক্যানসার জয় করতে পারলেও ষাটোর্ধ্ব আমেনার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। মাঝে-মধ্যেই গলা ফুলে যায়। হাঁটতে হয় লাঠি ভর করে। তারপরও কারও কাছে কোন অভিযোগ নেই আমেনার। যেন জীবনের এই পরিণতিকে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.