বেসিক ব্যাংকের নানা দুর্নীতি ও জালিয়াতি ঘটনার বিচার এখন পর্যন্ত না হলেও উল্টো মূলধন ঘাটতি মেটাতে ইস্যু করা হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার রি-ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বেসিক ব্যাংকের দেয়া এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকে পদে পদে দুর্নীতি হওয়ায় ২৫৯৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি হয়। মূলধন কমে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিশেষ করে পণ্য আমদানিতে এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট বা ঋণপত্র) খোলা ও তা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের ব্যাংকগুলোর কাছে আস্থার সংকট দেখা দেয়। চাহিদা অনুযায়ী বন্ড ইস্যু করা হলে বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে বলে বেসিক ব্যাংকের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দুর্নীতির বিচার না করে জনগণের অর্থ দিয়ে এমন ঘাটতি পূরণ করা হলে দুর্নীতিবাজরা আরও উৎসাহিত হবে। আর সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহায়তা দেয়ার বিষয়টি অনৈতিক বলেও মন্তব্য করেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের উল্লিখিত প্রস্তাবটি চলতি সপ্তাহে অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্ড ইস্যু সংক্রান্ত সারসংক্ষেপ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে পাঠানো হয়েছে অর্থমন্ত্রীর কাছে। প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে প্রতিটি ১শ’ কোটি টাকা মূল্যের মোট ২৬টি বন্ড ইস্যু করা হবে। এর মধ্যে ১০ বছর মেয়াদি ৮টি, ১৫ বছর মেয়াদি ৮টি ও ২০ বছর মেয়াদি ১০টি রয়েছে। তবে এসব বন্ডের কোনো সুদ থাকবে না।
প্রসঙ্গত, বেসিক ব্যাংক ঘিরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৯ সালে ৯টি একক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ৪৫৬ কোটি টাকা ও ২০১০ সালে ৮টি একক প্রতিষ্ঠানকে ৪৯৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। এছাড়া ২০১১ সালে ১২টি একক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ৮৮১ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ২৩টি একক ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানকে ২৩০৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এসব ঋণের বেশির ভাগই ইস্যু করা হয় ভুয়া দলিল, অপর্যাপ্ত মর্গেজ এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে। এ ব্যাপারে একাধিক মামলাও হয়েছে। জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সব মামলাই বিচারাধীন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকার মালিক হিসেবে আইনগতভাবে এই টাকা দিতে বাধ্য। কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে এটি অনৈতিক কাজ। কারণ সরকার নিযুক্ত এমডি ও পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এখন জনগণের টাকায় ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে।
বেসিক ব্যাংকের অনুকূলে ‘রি-ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড’ ইস্যুর ব্যাপারে গত ২১ ডিসেম্বর একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে তা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠানো হয়। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের অনুকূলে বন্ড ইস্যু করা হলে মূলধন ঘাটতির আংশিক পূরণ হবে। বিপুল অংকের মূলধন ঘাটতি বাজেট থেকে পূরণ করা যাবে না। কারণ চলতি বাজেট থেকে এই অর্থ দেয়া হলে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। ব্যাংকের অনুকূলে ক্যাপিটালাইজেশন বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এটি পূরণ করা যেতে পারে।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে নির্ধারিত মূলধন সংরক্ষণ বিবেচনায় বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৫৯৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ব্যাংকের স্বাভাবিক আয় থেকে এ ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। বেসিক ব্যাংক পরিকল্পনা অনুযায়ী মুনাফা করতে পারলে তাদের শেয়ার সরকারের কাছ থেকে পুনঃক্রয়ের ফলে পরিশোধিত বন্ডের অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এতে সরকারের কোনো আর্থিক দায় থাকবে না। ওই সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সরকার ব্যাংকটির একশ’ শতাংশ শেয়ারের মালিক। ফলে ঘাটতি মূলধন পূরণে অত্যাবশ্যকতা রয়েছে। তবে এই বন্ড ইস্যুর পর বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সরকারের অনুকূলে শেয়ারের বিপরীতে কোনো আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংক মুনাফা করতে না পারলে বন্ডের মূল্য হিসেবে মেয়াদ শেষে ব্যাংকের মূলধন পরিশোধ করতে হবে।
জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এ মজিদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বন্ড ইস্যু করা হলে বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণ হবে। এতে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে অবস্থান আগের তুলনায় ভালো হবে। বর্তমান মূলধন ঘাটতি থাকায় অন্য ব্যাংক এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি করতে গড়িমসি করছে, যা আগামীতে কেটে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের আরেকটি সমস্যা তা হল শ্রেণীকৃত ঋণ। এই ঋণের পরিমাণও কমিয়ে আনতে হবে। এটি চেষ্টা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে বন্ড ইস্যু- এটি দেশের প্রথম। এ ধরনের ব্যবস্থা ভারত ও বুলগেরিয়াসহ কয়েকটি দেশে আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে বন্ড ইস্যুর ধারণা সংগ্রহ করেছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো বেসিক ব্যাংকের প্রস্তাবে বলা হয়, বর্তমান ব্যাংকের মূলধন হচ্ছে ২ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। নতুন করে বন্ড ইস্যু হলে মোট মূলধনের পরিমাণ হবে ৫ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয় ৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে এসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা। বিপরীতে প্রভিশন কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। আগামী ৩১ ডিসেম্বর প্রভিশনের পরিমাণ আরও কমবে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, প্রভিশনের পরিমাণ প্রতিবছর এভাবে কমার গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছর পর এর পরিমাণ দাঁড়াবে ২১শ’ কোটি টাকা। ফলে ভবিষ্যতে ব্যাংকের জন্য মূলধনের প্রয়োজন হবে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.