জুলাইয়ে ঢাকার গুলশান ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে যে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, এখনো তার সুযোগ নিচ্ছেন ক্রেতারা। নিরাপত্তার কথা বলে তারা বাংলাদেশে আসতে চাইছেন না। শিল্প মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করতে তৃতীয় কোনো দেশের প্রস্তাব করছে। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিল্পমালিকরা। তারা বলছেন, এখন দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ক্রেতাদের এমন শর্তের পেছনে রহস্য রয়েছে। তারা অতীতের ঘটনার কারণে সুবিধা নিতে চাইছে। তবে দেশের শিল্পরক্ষার স্বার্থে এখন অনেক উদ্যোক্তা বাধ্য হয়েই বিদেশে গিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। গুলশানের হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলায় ৭ জন জাপানি ও ৬ জন ইতালির নাগরিকসহ ২০ জন নিহত হন। এর মধ্যে ইতালির ৬ জনই পোশাক ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় করে এমন বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, ইন্ডিটেক্স, বেস্ট সেলার, ভিএফ করপোরেশন, সিয়ার্স, ক্যারিফোর, জেসি পেনি, গ্যাপ ইত্যাদি। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সিঅ্যান্ডএ, যুক্তরাষ্ট্রের চেরোকি গ্লোবাল ব্র্যান্ড, মার্কিন প্রতিষ্ঠান লিভাইস, ওয়ালমার্ট এবং টার্গেট। গুলশানে হামলার পর বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা সংকোচনের কথা প্রকাশ্যে বলেছিল বিখ্যাত কোম্পানি এইচঅ্যান্ডএম। এদের মধ্যে অনেকেই এখন বাংলাদেশে সফর করছেন না। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় সব গার্মেন্টের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটছে। ক্রেতারা আসছেন না। কারখানা মালিককে বিদেশে গিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পোশাকের ক্রেতারা উন্নত দেশের। তারা তাদের সরকারের কাছ থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ না পাওয়া পর্যন্ত আসতে আগ্রহী হন না। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে নেতিবাচক বার্তা চলে গেছে, তা ফেরাতে বেশ সময় লাগবে। খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়টির সমাধান হবে না। এখন দরকার আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা। অন্যথায় আগামীতে এর প্রভাব আরো সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আসলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কারখানায় বড় দুর্ঘটনার চেয়েও গুলশান হামলা পোশাকশিল্পের বেশি ক্ষতি করেছে বলে জানান তারা। বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির বলেন, আগের চেয়ে পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে। ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে বিজিএমইএ। যেহেতু কয়েকটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ওপর বাংলাদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা আছে, সে কারণে কয়েকটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সতর্কতা পালন করছে। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ক্রেতারা বাংলাদেশে না এসে একটা সুযোগ নিচ্ছেন। বর্তমানে দেশে সব ধরনের পরিবেশ ভালো। ক্রেতাদের না আসার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের দেশের বাইরে বৈঠক করতে হচ্ছে। এর ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তবে কতটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসছে না তা বলতে পারেননি এই বিজিএমইএ নেতা। তবে বাংলাদেশের এ ঘটনার পর বেশিরভাগ বিদেশি ক্রেতা এদেশে আসার ক্ষেত্রে সতর্ক বলে তিনি মনে করেন। পোশাক মালিকরা জানান, কারখানাগুলোতে এখন বড়দিনের পণ্য রপ্তানির কাজ চলছে। এছাড়া আগামী মৌসুমের পোশাকের অর্ডার এখনই আসার কথা। কিন্তু ক্রেতাদের সফর বাতিল ও দেশের বাইরে গিয়ে বৈঠক এটি স্পষ্ট করে যে, নিরাপত্তা নিয়ে ক্রেতাদের অস্বস্তি এখনো কাটেনি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগই আসে পোশাক শিল্পখাত থেকে। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরই অবস্থান বাংলাদেশের। তাই বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় দেশের গার্মেন্ট মালিকরা। পোশাক খাতে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব হলো ৫০৩ বিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ৫.১ শতাংশ। এক্ষেত্রে চীনের অংশীদারিত্বের পরিমাণ হলো ৩৮.৬ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদাও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৫.৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি করেছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাংলাদেশ ২৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসাইন বাবুল বলেন, গুলশানের ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে এমন বেশিরভাগ বিদেশি রিটেইলার ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে। তার মতে, কবে এই সমস্যা শেষ হবে কেউ জানেন না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.