‘প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৬’
প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন জাতীয় সংসদে পাস ও তা কার্যকর হলে নির্দিষ্ট কিছু জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১লা ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন-২০১৬’ এর খসড়া মন্ত্রিপরিষদের নিয়মিত বৈঠকে অনুমোদন লাভ করে। প্রস্তাবিত এই আইনটি এখনও জাতীয় সংসদে বিল আকারে উপস্থাপন করা না হলে খসরা এ আইনটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ ও ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে মনে করেন আইন, অভিভাসন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে, এই আইনে অনেক বিষয়েই স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তারা বলছেন, এই আইনে এমন কিছু বিধান রয়েছে যাতে উর্দুভাষী বিহারি (যারা আটকেপড়া পাকিস্তানি নামে পরিচিত) এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। তাই আইনটি কার্যকর হলে ওই জনগোষ্ঠী নাগরিকত্বহীনতা বা রাষ্ট্রহীনতার মতো সংকটে পড়তে পারে। প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন-২০১৬ এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ধারা ৪ এর উপধারা ১-এ উল্লেখ রয়েছে- বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন যদি তার পিতা বা মাতা এই আইন বলবৎ হবার তারিখে বা এর পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হতে এই আইন বলবৎ হবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন। আইনে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পূর্বে জন্মগ্রহণকারীদের জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। একই সঙ্গে এই আইনের ১৮ (ঘ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক হবার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি বাংলাদেশে বেআইনি অভিভাসী হিসেবে বসবাস করেন বা করে থাকেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্দিষ্ট ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে প্রায় ১০ লাখ আটকেপড়া পাকিস্তানি বা বিহারি জনগোষ্ঠী বসবাস করছেন। যাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকার যেমন আগ্রহী নয়, তেমনি বাংলাদেশেও তাদের স্থায়ী আবাস গড়ে উঠেনি। সকল নাগরিক সুবিধাও তারা পান না। আইন ও অভিভাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আটকেপড়া পাকিস্তানিদের মধ্যে একটি অংশ যারা এদেশেই থাকতে আগ্রহী তাদের অনেকেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেন। আবার এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা এদেশে থাকতে আগ্রহী নন এবং তারা এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র বা এদেশের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারছেন না। এই আইন কার্যকর হলে উর্দুভাষী বিহারিরা অনিশ্চয়তায় পড়তে পারেন। অন্যদিকে সরকারি বেসরকারি হিসেবে বাংলাদেশে অন্তত আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্নভাবে অবস্থান করছে। জাতিসংঘের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করা ইউএনইচসিআর’র (ইউনাইটেড নেশন হাইকমিশনার ফর রিফিউজিস) হিসেবে প্রায় ৩২ হাজার রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ক্যাম্পে বাস করছেন। আইন ও অভিভাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন কার্যকর হলে যেসব বাঙালি রোহিঙ্গাদের বিয়ে করেছেন সেই সব স্বামী, স্ত্রী এবং তাদের সন্তানরা নাগরিকত্বের সংকটে পড়তে পারেন। সেই প্রেক্ষিতে আইনে কিছু বলা নেই। প্রস্তাবিত আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক কোনো বিদেশিকে বিয়ে করলে যদি ওই বিয়ে সম্পর্কে বৈধতার কোনো প্রশ্ন না থাকে তবে, সরকার ওই ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিতে পারবে যদি তিনি কোনো অবৈধ অভিভাসী না হন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) অনারারী নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নাগরিকত্ব আইনটি এখনও স্পষ্ট নয়। উর্দুভাষী বিহারিদের মধ্যে নতুন প্রজন্মের অনেকেই আছেন যাদের বাবা মা এদেশে জন্ম নিয়েছেন। প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো সমস্যা কম হবে। আবার এই আইন অনুযায়ী কোনো রোহিঙ্গাকে এই ভূখণ্ডের কেউ বিয়ে করলে তাদের সন্তান কিন্তু এই ভূখণ্ডের নাগরিকত্ব পাচ্ছে না। মিয়ানমারও তাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে না বা নাগরিকত্ব দিচ্ছেনা। তাই, এই আইনের বিধান কার্যকর হলে তাদের সন্তানরা রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এখন এইসব জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়লে কি করা হবে তার কোনো নির্দেশনা প্রস্তাবিত আইনে নেই। তিনি বলেন, কেউ যেন রাষ্ট্রহীন না হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক আইনে অনেক কিছু বলা আছে। এখন আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যদি পদক্ষেপ নেয়া না হয়, তাহলে একটা পর্যায়ে দেখা যাবে যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হচ্ছেনা। তাই, রাষ্ট্রহীনতার সংখ্যাটা যেন না বাড়ে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আমাদেরও এ বিষয়ে কিছু দায়িত্ব রয়েছে। অভিভাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রামরুর (রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মো. জালালউদ্দিন শিকদার মানবজমিনকে বলেন, কোনো বিহারি বা রোহিঙ্গাকে বিয়ে করলে তাদের সন্তান বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারবে না বলে আইনের ধারার বিশ্লেষণে বোঝা গেছে। এখন বাংলাদেশিকে বিয়ে করা রোহিঙ্গা বা রোহিঙ্গাকে বিয়ে করা বাংলাদেশি স্বামী, স্ত্রী ও তাদের সন্তানরা নাগরিকত্বহীনতায় ভুগবেন। প্রস্তাবিত নাগরিত্ব আইনের ৩ ধারায় উল্লেখ রয়েছে আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইন, আদালত, দলিল, রায় ডিক্রি ইত্যাদিতে যাই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী কার্যকর হবে। আইনের এই ধারার সামলোচনা করে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৮ সালে হাইকোর্টের একটি রায়ে উর্দুভাষী বিহারিদের (যারা বাংলাদেশে থাকতে চায়) বাংলাদেশে নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এখন প্রস্তাবিত নাগরিক আইনের ৩ ধারা বাস্তবায়িত হলে হাইকোর্টের ওই রায়ের সঙ্গে সেটি সাংঘর্ষিক হবে কিনা সেই প্রশ্ন তুলেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত এই আইন কার্যকর হলে হাইকোর্টের ওই রায়ের প্রেক্ষিতে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে সে ব্যাপারে খসরা আইনে কিছু বলা নেই বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক আইন উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। মানবজমিনকে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত এই আইনে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। অনেক কিছুই অস্পষ্ট। এই আইনে অনেকেই নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যায় পড়বেন। এ এফ হাসান আরিফ বলেন, রাষ্ট্রের অনেক পলিসি থাকতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে এটি সংবিধান ও আইনের পরিপন্থি কিনা? জুডিশিয়ারি কোনো সিদ্ধান্তে আইনগত ও সাংবিধানিক যুক্তি থাকে। উর্দুভাষী বিহারিদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেয়ার ব্যাপারে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন। এখন নাগরিকত্ব আইন পাস হলে হাইকোর্টের ওই রায়কে বাতিল করা হলো কিনা বা পাস কাটানো হলো কিনা সে প্রশ্ন সামনে চলে আসবে। এ এফ হাসান আরিফ বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, বা তাদের প্রতি উদারতা দেখানো কোনো ইস্যু নয়। এটি আন্তর্জাতিক দুটি রাষ্ট্রের বিষয়। কিন্তু এই আইন কার্যকর হলে উর্দুভাষী বাংলাদেশি নাগরিকদের রাষ্ট্রহীনতার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রয়োজনের তাগিদে আইন তৈরি করতে হয়। আমরা আশা করবো সরকার এই আইন নিয়ে আরো বিচার বিশ্লেষণ করবে। বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সংগঠন ‘উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবেলিটেশন মুভমেন্টের (ইউএসপিওয়াইআরএম) সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু মানবজমিনকে বলেন, আমাদের অনেকেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েও বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন না। আবার অনেকে জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি। এ আইন পাস হলে আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা এ বিষয়ে সরকারের কাছে আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু সরকারের তরফে কোনো সাড়া পাইনি। আশা করি সরকার মানবিক দিক বিবেচনা করে বিষয়টি পর্যালোচনা করবে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী নূর খান লিটন মানবজমিনকে বলেন, অন্যান্য দেশের বেলায় যে নিয়ম প্রযোজ্য তা একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বেলায় যদি প্রযোজ্য না হয়, তবে মানবাধিকার বিবেচনায় তা সম-আচরণ নয়। তিনি বলেন, কোনো আইন দ্বারা কোনো গোষ্ঠীকে যদি তার সাংবিধানিক সুযোগ বা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় তবে তা ওই ব্যক্তির প্রতি সম-আচরণ নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মানবজমিনকে বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র কোনো কমিউনিটির সঙ্গে বৈষম্য করবে না। তিনি বলেন, কোনো অধিকারই নিরঙ্কুশ নয়। তবে, যদি কারো মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় তাহলে অনিবার্যভাবে ওই ব্যক্তি অপরাধপ্রবণতা ও জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হবে। শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, যে কোনো আইন পাস ও কার্যকর হবার আগে তা নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা করতে হয়। কিন্তু নাগরিকত্ব আইন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগে সরকার এ বিষয়ে কোনো আলোচনা, পর্যালোচনা করেনি। এটি নিয়ে কোনো প্রচার-প্রচারণাও হয়নি। বিষয়টি পলিসি মেকারদের বিবেচনা করতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.