বিশ্বের জন্য ২০১৬ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিস্ময়কর জয়। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে সাবেক ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নিউইয়র্কের এই ধনকুবের। ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ট্রাম্প তার বেফাঁস ও আক্রমণাত্মক কথাবার্তায় সারা বছর ধরেই আলোচনায় ছিলেন। কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চলতি বছরের শুরুর দিকেই শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া। ১ ফেব্রুয়ারি আইওয়া অঙ্গরাজ্যে প্রাইমারি ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। রিপাবলিকান দলের ১৭ জন এ প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে যান সাবেক টিভি ব্যক্তিত্ব ও ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক দলে মনোনয়ন লড়াইয়ে ছিলেন ছয়জন প্রার্থী। সবাইকে ছাড়িয়ে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে হোয়াইট হাউসের লড়াইয়ে চূড়ান্ত হলেন হিলারি ক্লিনটন।
জুলাইয়ে শুরু হওয়া চূড়ান্ত নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল ইতিহাসের নজীরবিহীন কাদা ছোঁড়াছুড়ি, ব্যক্তি আক্রমণ ও বিদ্বেষ ছড়ানো। এত বেশি তিক্ততা আর নোংরা বাক?যুদ্ধ এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রশ্নে ভোটারদের এতটা বিভক্তি এর আগে দেখা যায়নি মার্কিনিদের। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে ‘ন্যাস্টি উইমেন’ (জঘন্য নারী) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনটি টেলিভিশন বিতর্কের শুরুতে কেউ কারও সঙ্গে হাতও মেলাননি। দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের দু’দিন আগে নারীদের নিয়ে ট্রাম্পের একটি অশ্লীল অডিও টেপ ফাঁস হয়। এতে নারীদের প্রতি তার চরম অরুচিকর মন্তব্যে বিরক্তি
প্রকাশ করেন তার রানিং মেটও। ট্রাম্প বিচারপতি, বিশ্বসুন্দরী, টিভি উপস্থাপক, যুদ্ধ-নায়কের শোকাহত পিতা-মাতা, এমনকি নিজ দলের শ্রদ্ধেয় নেতাদের সম্পর্কে নোংরা কথা বলেছেন। মুসলিম ও হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছেন।
বলেছেন, মুসলিমদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করবেন, অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেবেন, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলবেন। আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর প্রতিও নেতিবাচক মন্তব্য করেন। নিজ আয়করের হিসাব গোপন রেখেছেন। তার কর্মকাণ্ডে চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাকে আর সমর্থন না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন রিপাবলিকান দলেরই বহু ডাকসাইটে নেতা। অন্যদিকে বিতর্ক হিলারিরও পিছু ছাড়েনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত সার্ভারে সরকারি ই-মেইল চালাচালি নিয়ে ভুগতে হয়েছে বহুদিন। একজন নির্ভরযোগ্য ও সৎ প্রার্থীর ভাবমূর্তি গড়ে তুলে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে হিলারিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। জুলাইয়ে হিলারিকে ই-মেইল কেলেংকারির দায় থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল তদন্ত সংস্থা এফবিআই। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র ১০ দিন আগে এ নিয়ে পুনরায় তদন্তের ঘোষণা দেন এফবিআই পরিচালক জেমস কমে। বেকায়দায় পড়েন হিলারি। আর এ সুযোগটাই লুফে নেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘হিলারির ই-মেইল বিতর্ক ওয়াটারগেট কেলেংকারির পর যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কেলেংকারি।’
এত কিছুর পরও সব জরিপে এগিয়ে ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। নির্বাচনের আগের দিনও বলা হচ্ছিল হিলারির জয়ের সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। তবে সব জরিপ, পূর্বাভাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে জয় ছিনিয়ে নেন ট্রাম্প। প্রয়োজনীয় ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের বিপরীতে তিনি পান ৩০৬ ভোট। অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটন পান ২৩২ ভোট। তবে সব রাজ্যের হিসাব শেষে পপুলার ভোটে ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখ ভোট বেশি পান হিলারি।
ট্রাম্পের জয় যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও পররাষ্ট্রনীতিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্প তার পরবর্তী প্রশাসনের জন্য দলের মধ্যেও কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিতদের বেছে নিয়ে সেই ধারণার পালে আরও হাওয়া দিয়েছেন। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, সিরিয়াসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে মিলে কাজ করতে গেলে বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগে দুই পরাশক্তির মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। ফলে ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৫ রুশ কূটনীতিক তাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওবামা।
নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ে পররাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের করা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় বাড়তে থাকে। ওবামার নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোকে বাতিল করবেন বলে নির্বাচনী প্রচারণায় ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে সর্বশেষ রুশ কূটনীতিক তাড়ানোর সিদ্ধান্তে সুর নরম করেছেন তিনি। ট্রাম্প বলেছেন, এখন সময় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের অভিষেকেই পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.