সদ্য সমাপ্ত ২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পণ্য মূল্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ক্যাব-এর হিসাবে ২০১৫ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ২০১৫ সালের চেয়ে শূন্য দশমিক ০৯ পয়েন্ট বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি পণ্য ব্যতীত বিগত বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে দ্রব্যমূল্য বহুলাংশে স্থিতিশীল ছিল। ঢাকা শহরের ১৫টি বাজার ও বিভিন্ন সেবা-সার্ভিসের এর মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের তথ্য এ পর্যালোচনায় বিবেচনা করা হয়েছে। এই হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় বহির্ভূত। ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেসব পণ্য বা সেবা পরিবারের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য বা সেবার ওজনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের এই হিসাব করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে: ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সব ধরনের চাল ও ডালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। চালের দাম বৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, অন্যদিকে ডালের দাম বৃদ্ধি হয়েছে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। আমদানিকৃত মসুর ডালে বেড়েছে ৩৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং দেশি মসুর ডালে ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সবচেয়ে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে আমদানিকৃত রসুনে ৭২ দশমিক ০৬ শতাংশ। দেশি রসুনে বেড়েছে ৪৭ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৪৬ দশমিক ০৫ শতাংশ, লবণে বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং চা পাতায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রতি লিটার গরুর দুধে বেড়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং মাংসে দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। দেশি থান কাপড়ে দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ, শাড়িতে বেড়েছে ১২ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং গেঞ্জি, তোয়ালে ও গামছায় বেড়েছে ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ক্যাব-এর প্রতিবেদনের মতে, সারা বছর প্রায় স্থিতিশীল থাকলেও বছরের শেষ প্রান্তিকে পাইকারি ও খুচরা বাজারে সব ধরনের চালের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। নিম্নআয়ের মানুষের ব্যবহৃত মোটা চালের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সরকারের এক অনন্য সাফল্য। কৃষককে ধান উৎপাদনে উৎসাহিত এবং ন্যায্যমূল্য প্রদানের উদ্দেশ্যে সাধারণত ধান কাটা শুরুর আগেই সরকার ধান-চালের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও সংগ্রহ মূল্য স্থির করে। তবে নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধান-চাল সংগ্রহ প্রতি বছরই বিলম্বে শুরু হয়। এ প্রেক্ষাপটে কৃষক সরকারের নায্য মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়, লাভবান হন মিল-মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়িক শ্রেণি। অনেক সময় রাজনৈতিক সুবিধাভোগী শ্রেণি মৌসুম-ভিত্তিক কৃষক ও ব্যবসায়ী সেজে সরকার নির্ধারিত মূল্যের সুবিধা ভোগ করে। পদ্ধতিতে কৃষকের নিকট থেকে ধান কাটার পরপরই ধান-চাল সংগ্রহের মাধ্যমে কৃষককে লাভবান করার উদ্যোগ এবং সরকারের গুদামে পর্যাপ্ত মওজুদ গড়ে তোলা সময়োপযোগী হবে বলে মনে হয়। সরকারের গুদামে চালের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলে মিলার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের পক্ষে সরবরাহ অস্থিতিশীল করে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে না। এতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই লাভবান হবেন। যেসব পণ্যের দাম কমেছে: এ সময়ে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে আমদানিকৃত পিয়াজে ৫০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দেশি পিয়াজে দাম কমেছে ৩৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ, ধনিয়ায় কমেছে ৩৮ দশমিক ২০ শতাংশ, কাঁচা মরিচে কমেছে ২২ দশমিক ৪২ শতাংশ। আমদানিকৃত আদায় কমেছে ২২ দশমিক ৯৩ শতাংশ, দেশি আদা ১৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, পান-সুপারিতে ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ, গুড়া দুধে ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ, শাক-সবজিতে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, কাপড় কাঁচার সাবানে ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, মাছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ডালডা ও ঘিতে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ ও আটায় কমেছে ২ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে সব ধরনের ভোজ্য তেলের দাম কমেছে। এর মধ্যে খোলা পাম তেলে কমেছে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং খোলা সয়াবিন তেলে কমেছে ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হয়নি। তবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ কোম্পানিসমূহ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে মূল্যবৃদ্ধির আবেদন করেছে। কমিশনের গণশুনানিতে তা যুুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত প্রমাণিত হয়নি, তবে কমিশন এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদ্যুৎ খাতে গ্রাহক পর্যায়ে দুর্নীতি কমেছে। অন্যদিকে গ্যাস খাতে সরবরাহ পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে এবং দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা আগের মতই অব্যাহত আছে। বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষাপটে ক্যাব বিইআরসি বরাবর কমিশনের আইন অনুযায়ী জ্বালানি তেল ও এলপিজি গ্যাসের মূল্য গণশুনানি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কমানোর আবেদন করে। কমিশন এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে পেট্রোল, অকটেন, কেরোসিন, ডিজেল ও ফারনেস অয়েলের দাম কিছুটা কমানো হয়। ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। তবে এই মূল্যহা্রস আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যহ্রাসের তুলনায় বেশ কম। ক্যাব আশা করছে অচিরেই জ্বালানি তেলের দাম আরো কমানো হবে ও বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হবে। ২০১৬ সালে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। গেলো বছরে গণপরিবহনে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। ঢাকায় যানজটের অবনতি হয়েছে। শিক্ষা খাতের ধারাবাহিক অগ্রগতি অব্যাহত ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেলেও তা এখনও অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে রয়েছে। শিক্ষার মানের অগ্রগতিও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। ক্যাবের বিবেচনায় মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ এবং কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও দেশের স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের ধারাবাহিকতা জোরদারর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষার মান ইউজিসি ও সরকারের নিবিড় তত্ত্বাবধায়নের আওতায় আনা প্রয়োজন। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষা আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি। নিম্নমানের নকল ও ভেজাল ভোগ্যপণ্য বরাবরের মতই বাজারে বিক্রি হচ্ছে এবং ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই-এর কার্যপরিধি আরো জোরদার করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ক্যাব- ১৩টি সুপারিশ করেছে। এগুলো হলো- ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে পড়হঃৎধপঃ মৎড়রিহম পদ্ধতি অনুসরণ করে ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ করা; আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অচিরে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, ফারনেস অয়েল এবং এলপিজি গ্যাসের মূল্য হ্রাস করা; বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য অপরিবর্তিত রাখা। ভোক্তাদের অর্থে বিইআরসি কর্তৃক সৃষ্ট গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়ন তহবিলের ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা; বাড়ি ভাড়া আইন ১৯৯১ অনতিবিলম্বে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করে ভাড়াটেদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিয়ে নগরে বসবাসরত নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য ফ্ল্যাট তৈরি করা ও বরাদ্দের ব্যবস্থা করা। অবিক্রীত সকল ফ্ল্যাট বাড়ি অবিলম্বে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রির উদ্যোগ নেয়া; নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের ওপর কোনো রূপ শুল্ক-কর বা ভ্যাট আরোপ না করা ইত্যাদি। ক্যাব একটি অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ক্যাব ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা ও অধিকার সংরক্ষণে কাজ করছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি বছর বছরের প্রারম্ভে বিগত বছরের জীবনযাত্রার ব্যয় এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিগত ২০১৬ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করলো সংস্থাটি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.