ইয়েমেনের আবস শহরের একটি হাসপাতাল। ভোরের আলো সেখানে দুসংবাদ বয়ে নিয়ে এলো ১৯ বছরের মোহাম্মদ আলীর কাছে। তার দু’বছর বয়সী এক কাজিন ক্ষুধায় কাতর হয়ে মারা গেছে। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর শোকার্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে শক্ত থাকতে হবে নিজের ছোটভাই মোহান্নাদের (৫) জন্য। কারণ একই পরিণতির শিকার হতে পারে সেও। মোহাম্মাদ তার ছোটভাইয়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছেন। মোহান্নাদের অপুষ্টিতে ভোগা কঙ্কালসার শরীর লেগে আছে বিছানার সঙ্গে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। মোহাম্মদ আলী বললেন, ‘আজকে আমার এক কাজিনকে হারিয়েছি পুষ্টিহীনতায়। আমার ছোট্ট ভাইটিকে হারাতে চাই না।’ বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মোহাম্মদ আলী ও তার পরিবারের ঘটনা। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহাম্মদ আলীদের মতো এমন অসংখ্য ইয়েমেনি নিজেদের খাবার জোটাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। চলমান গৃহযুদ্ধ আরব বিশ্বের দরিদ্রতম এই দেশটিকে দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। উত্তর ইয়েমেনে শিয়া হুতি বিদ্রোহী নিয়ন্তিত একটি এলাকায় মাটির কুঁড়েঘরে বসবাস করে মোহাম্মদ আলীর পরিবার। হুতি বিদ্রোহীরা দেশটির সরকারি বাহিনী ও সৌদি আরব নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত। এই জোটে সমর্থন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আকাশপথে জোরালো অভিযান চালাচ্ছে জোট বাহিনী। রাজধানী সানা ও দেশের উত্তরের বেশিরভাগ এলাকা থেকে বিদ্রোহীদের হঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর অনুমান, হুতিদের হাতে নতুন করে অস্ত্র পৌঁছানো ঠেকানোর লক্ষ্যে জোট বাহিনী আরোপিত একটি নিষেধাজ্ঞার ফলে খাবারের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। নিজেদের সর্বোত্তম সময়েও অনেক ইয়েমেনিকে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সংগ্রাম করতে হতো। আর এখন তাদের কোনরকম অন্নের সংস্থান করতে বেগ পেতে হচ্ছে। মোহাম্মদের পিতা মৌসুমি কৃষিকাজ করেন যেখানে প্রতিদিন হাতে গোনা কয়েক ডলার পরিমাণ অর্থ পান। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্কুল ছেড়ে দিতে হয় মোহাম্মদকে। কদাচিত নির্মান আর কৃষিকাজের সুযোগ মেলে তার। যুদ্ধের আগে সপ্তাহে একদিন গরু বা মুরগির মাংস কপালে জুটতো। এখন একবেলায় মাছ জোটা রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার। এখন তাদের খাবারের তালিকায় রয়েছে রুটি, ভাত আর চা। এ মাসের শুরুতে মোহাম্মদ ও তার ভাই অমসৃণ, ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় ঘণ্টাখানেকের যাত্রা করে নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছায়। মোহান্নাদের অসুস্থতা শুরু হয়েছিল ডায়রিয়া দিয়ে। গত দু’বছরে স্বাস্থ্যের আরো অবনতি হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসা খরচ বহন করার সামর্থ্য তাদের নেই। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যমতে, ইয়েমেনজুড়ে আনুমানিক ২২ লাখ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। এর মধ্যে মোহান্নাদের মতো ৪ লাখ ৬২ হাজার শিশু রয়েছে তারা সিভিয়ার অ্যাকিউট ম্যালনিউট্রিশনে (এসএএম) ভুগছে। এর ফলে তারা ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার মতো প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতায় আক্রান্ত হওয়ার অধিকতর ঝুঁকিতে রয়েছে। ইয়েমেনে ইউনিসেফের মুখপাত্র রজত মাধোক জানান, এসএএম-এ আক্রান্ত ২ রাখ ১৫ হাজার শিশুর চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ। এছাড়া আরো কয়েক লাখ শিশুকে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট সরবরাহ করেছে সংস্থাটি। তবে, ‘অর্থায়নের ঘাটতি এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকায় প্রবেশের সীমিত সুযোগের ফলে শিশুদের প্রাণ বাঁচানোর প্রচেষ্টা ব্যাহত হচ্ছে।’ যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দেশটির স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে। বোমার আঘাতে ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে কয়েকটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। অন্যরা চলমান লড়াইয়ের কারণে দরজায় তালা দিতে বাধ্য হয়েছে। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ইয়েমেনের ২ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও কমসংখ্যক মানুষের এখন স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, প্রতিরোগযোগ্য রোগ থেকে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১ হাজার ইয়েমেনি শিশু মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় মোহাম্মদ আলি শুধু প্রত্যাশাই করতে পারেন যে তার ভাই পরবর্তী ভুক্তোভোগীদের তালিকায় থাকবে না। তিনি বললেন, ‘আমি দেখতে পাচ্ছি যে আমার ভাইয়ের অবস্থার অবনতি ঘটছে প্রতিদিন। কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.