ধানমন্ডি সাত নম্বর সড়কের ফুটপাত। অনেকগুলো পরিবার খোলা আকাশের নিচে সংসার পেতেছে। ঢাকায় খুব অস্বাভাবিক নয় এমন দৃশ্য। তবে দেখা গেল, সেখানে এক মা তাঁর মেয়েকে পড়াচ্ছেন। মেয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়ছে অ, আ, ই…। গত সোমবার সন্ধ্যার আগ দিয়ে এ দৃশ্য দেখে থামতেই হলো। মেয়ের নাম ফাতেমা। কাছে এসে বলল, ‘ম্যাডাম, আমি সুরভি স্কুলে পড়ি।’ সাড়ে চার বছরের ফাতেমার বড় মায়াভরা নিষ্পাপ কচিমুখ। তাতে ধুলো-ময়লার ছোপ। গায়ের ফ্রকটিও। স্কুলে যায় বলে কথা একটু শুদ্ধ করে বলা শিখেছে সে। ফাতেমার মা শেফালির বয়স বড়জোর বছর কুড়ি হবে। দেড় বছর বয়সী তাঁর আরেকটি ছেলে আছে। এই দুই সন্তানকে নিয়ে ফুটপাতেই তাঁর সংসার। স্বামী খোঁজ নেন না প্রায় এক বছর হলো। শেফালি বললেন, মেয়েকে ধানমন্ডি পাঁচ নম্বরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুল সুরভিতে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি নিজেও সুরভি স্কুলে একটু পড়ালেখা শিখেছিলেন। সেই বিদ্যা দিয়েই তিনি মেয়ের পড়া তৈরিতে সহায়তা করেন। দিনের আলো না থাকলে রাস্তার বাতির আলোতেই চলে মা ও মেয়ের পড়াশোনা। সুরভি স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করাতে কোনো টাকাপয়সা লাগেনি। বই, পোশাকও স্কুল থেকেই দিয়েছে। তবে পরীক্ষার সময় টাকা লাগবে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। ফুটপাতে এখন আর ঝুপড়ি তুলতে দেওয়া হয় না। তাই খোলা আকাশের নিচেই থাকেন শেফালিরা। একটি রাজনৈতিক দলের বড় আকারের একটি ডিজিটাল ব্যানার সংগ্রহ করা হয়েছে। ধানমন্ডির রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উল্টো পাশের ফুটপাতে সেই ব্যানার বিছিয়েই রাতে তাঁরা ঘুমান। এটিই তাঁদের সংসার। পাশেই ছোট একটি পুঁটলি, তাতে সংসারের টুকিটাকি জিনিস। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত মেয়ের স্কুল। তারপর স্কুলের পোশাক ও বই কাছেই একটি অফিসে একজনের কাছে জমা রাখা হয়। আপনাদের চলে কী করে—জানতে চাইলে শেফালি বললেন, ‘দুই ছেলেমেয়ে নিয়া কেউ কামে নেয় না। জোয়ান মানুষ, তাই কেউ ভিক্ষাও দিবার চায় না। তবে দুই ছেলেমেয়ে সঙ্গে থাকলে মানুষের একটু মায়া হয়। দিন শেষে এক-দেড় শো টাকা পাই। ছেলেমেয়েরা কলা, বিস্কুট খাইতে চায়, আর তিনজনের খাওন এই দিয়াই চলে।’ শেফালির বাড়ি বিক্রমপুরে। তবে ছোটবেলা থেকে তিনি ঢাকার ফুটপাতেই বড় হয়েছেন। তাঁর বাবা-মা ভিক্ষা করতেন এখানে থেকেই। ফুটপাতেই স্বামীর সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে। তারপর ব্র্যাকের একটি হাসপাতালে দুই সন্তানের জন্ম। বাবা-মা মারা গেছেন। স্বামীও চলে গেছেন। শেফালির এক ভাইও এ ফুটপাতে সংসার পেতেছেন। ভাইয়ের ছেলে পলাশকে সুরভি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন বলে জানালেন শেফালি। বৃষ্টির দিন ফুটপাতের সংসারে দুই সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন শেফালি। তখন পলিথিন দিয়ে একটু ছাউনি তৈরি করে নেন। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চলে। তখন সন্তান নিয়ে দৌড়াতে হয় শেফালিকে। মেয়ে বড় হচ্ছে, তাই মেয়েকে একা ফুটপাতে রেখে যেতে ভরসা পান না। তাই প্রায় সময় বলতে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই রাখেন। আর ভিক্ষা করার সময়ও সঙ্গে থাকে মেয়ে। ফাতেমার সারা শরীরে ময়লা লেগে থাকলেও হাসে খুব মিষ্টি করে। কথা বলার প্রায় শেষ পর্যায়ে ফাতেমা মুখটা একটু মলিন করে প্রতিবেদককে বলল, ‘ম্যাডাম, দুইটা টাকা দিবেন?’ পাশ থেকে মা খানিকটা লজ্জা পেয়েই বললেন, ‘এহন টাকা চাইতে হইবো না।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.