ড্রাইভার সাহেব একটু জোরে চালান প্লিজ। খান সাহেব চালকের পাশের সিটে বসে তাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। উত্তেজনায় তিনি গাড়ির পেছনের সিটে না বসে চালকের পাশের সিটে বসেছেন। কারণ তিনি দ্রুত ঢাকা পৌঁছাতে চাচ্ছেন। তার ধারণা পেছনের সিটে বসলে ঢাকায় পৌঁছতে ওনার দেরি হয়ে যাবে। সম্ভব হলে তিনি পাখির মতো উড়ে চলে যেতেন। কিন্তু আফসোস, পাখির মতো ওড়ার কৌশল তার জানা নেই। এই মুহূর্ত কেন জানি পক্ষীকুলের প্রতি তার খুবই হিংসা হচ্ছে। খান সাহেবের পুরো নাম আলমাস আলী খান। টগবগে তরুণ এক সরকারি কর্মকর্তা। ঢাকার বাইরে কর্মরত। ঢাকার এক ক্লিনিকে তার তরুণী স্ত্রী আগের দিন একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। খান সাহেব তার সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকতে পারেননি। যার কারণে তিনি নিজের প্রতি প্রচণ্ড বিরক্ত ও হতাশ। যদিও এ ব্যাপারে তার কোনো দোষ নেই। তিনি সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকবেন বলে আগেই ছুটি নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তার রাজকন্যার বোধ হয় মায়ের পেটে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। তাই সময়ের আগেই চলে এসেছে। খান সাহেব তার রাজকন্যার মুখ দেখার জন্য ছটফট করছেন। তিনি সবাইকে আগেই জানিয়ে রেখেছেন, ডাক্তার-নার্স ছাড়া কেউ যেন তার সন্তানকে কোলে না নেয়। কারণ তিনি চান তার সন্তান আগে তার কোলে উঠবে।
খান সাহেব ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি ক্লিনিকের কেবিনে ঢুকলেন। সেখানে তার আত্মীয়স্বজন অনেকেই জড়ো হয়েছেন। তিনি কারও দিকে তাকালেন না। কারও সালামের উত্তরও দিলেন না। এমনকি মুরব্বিদের কাউকে সালামও দিলেন না। কোনো সৌজন্যতা দেখানোর সময় তখন তার নেই। এই মুহূর্তে তার সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে তার রাজকন্যা। যে চুপচাপ মায়ের পাশে শুয়ে আছে। তার মনে হলো পুরোটা রুম জুড়ে আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আর এই অলৌকিক আলো ঠিকরে বের হচ্ছে তার রাজকন্যার শরীর থেকে। তিনি বিছানার পাশে গিয়ে রাজকন্যার মুখের দিকে তাকালেন। অতি সতর্কতার সঙ্গে রাজকন্যাকে কোলে তুলে নিলেন। কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। দেখলেন রাজকন্যা তার দিকে তাকিয়ে আছে। খান সাহেবের চোখ দুটো জলে ভরে গেল। একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল রাজকন্যার গায়ে। খান সাহেব মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন, আম্মাজান আপনে সারা জীবন আমার বুকের মাঝে থাকবেন। আপনাকে আমি কখনো চোখের আড়াল করব না। খান সাহেবের স্ত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, তার স্বামীর মতো এত কঠোর কঠিন একটা মানুষ কাঁদছে। গত দেড় বছর ধরে এই মানুষটার সঙ্গে তিনি সংসার করছেন। এই সময় তিনি দেখেছেন তার স্বামীকে এই পরিবারের সবাই খুবই মান্য করে এবং ভয় পায়। খুবই একরোখা একটা মানুষ। বয়সের তুলনায় বেশ গুরুগম্ভীর। নিজের আবেগকে কখনই প্রকাশ করেন না। সেই মানুষটি শিশুর মতো আনন্দে কাঁদছেন। খান সাহেবের স্ত্রী ইশারায় রুমের সবাইকে বাইরে যেতে বললেন। কারণ তিনি চান না, ওনার স্বামীর চোখের পানি আর কেউ দেখুক। একে একে সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেল। তিনি এখন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন তার ছোট্ট রাজকন্যার জন্য ক্রন্দনরত রাজার পাগলামিময় ভালোবাসা। যে রাজা তার মেয়ে পাওয়ার আনন্দে স্ত্রী কেমন আছে জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছেন। এ ঘটনা অনেক বছর আগের কথা। খান সাহেব এখন চাকরি জীবন শেষে অবসর জীবনযাপন করছেন। প্রথম রাজকন্যা সুমির পরে একে একে ওনার আরও চারটি সন্তান হয়েছে। সবাই বলে বাবা-মা নাকি সব সন্তানকে একই রকম ভালোবাসেন। কিন্তু তথ্যটি খান সাহেবের বেলায় সঠিক হয়নি। তিনি দুনিয়ার সবকিছু থেকেই তার প্রথম রাজকন্যাকে বেশি ভালোবাসেন। খান সাহেবের এই একচোখা ভালোবাসার কথা পরিবারের সব সদস্যই জানে। তবে এ ব্যাপারে অন্য সন্তানদের কোনোই আপত্তি নেই। অবশ্য আপত্তি করেও লাভ নেই। কারণ খান সাহেবের সামনে গিয়ে কথা বলার সাহস সুমি ছাড়া পরিবারের আর কারও নেই। ৫ ডিসেম্বর রাজকন্যা সুমির জন্মদিন। এ দিনটি খান সাহেবের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এ বছর দিনটিতে সকাল থেকেই বাসায় বিভিন্ন ধরনের খাবার দাবারের আয়োজন হচ্ছে। বড় একটা কেক আনা হয়েছে। খান সাহেব সকাল থেকেই ব্যর্থ চেষ্টা করছেন নিজেকে হাসি-খুশি রাখার জন্য। কিন্তু পারছেন না। কারণ তিনি অভিনেতা নন। অভিনয় জানা থাকলে ভালো হতো। ওই মুহূর্তে কেন জানি তার অভিনেতাদের খুবই হিংসা হচ্ছিল। তিনি তখন নিজের বাসার দোতলার বেলকনিতে চেয়ারে বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। বুকের মাঝে জমানো কষ্টগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে বারবার বের হয়ে আসছে। কারণ তার আদরের সুমি এখন আর তার সামনে নেই। অথচ সুমির জন্মের পর তিনি শপথ করেছিলেন মেয়েকে তিনি বুক দিয়ে আগলে রাখবেন। চোখের আড়াল করবেন না। সেই সুমি আজ অনেক অনেক দুরে। চাইলেই বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন না। ছুঁয়ে দেখতে পারেন না। গল্পের মতো করে বললে বলতে হয়, তার বুকের মানিক এখন থাকে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। খান সাহেব তার রাজকন্যার জীবনে ছোটবেলা থেকেই অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করেছেন। ওনার রাজকন্যা যাই আশা করে আল্লাহ কীভাবে জানি তা পূর্ণ করে দেন। সুমির যখন বোঝার বয়স হয়েছে, তখন থেকেই বলত, সে আমেরিকা যাবে এবং সেখানেই থাকবে। খান সাহেব মেয়ের মুখে যখনই এ কথা শুনতেন, ভয় পেতেন। তখন তার বুকের ভেতর কষ্টগুলো দৌড়াদৌড়ি করত। কারণ মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে তিনি থাকতে পারবেন না। যে কারণে উনি মেয়েকে বিয়ের পরও নিজের কাছে রেখেছিলেন। কিন্তু যখন আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ হলো, তখন আর মেয়েকে আটকাতে পারেননি। চেয়েছিলেন মেয়েকে বোঝাতে। কিন্তু মেয়ে হয়েছে তারই মতো জেদি। সে তো তখন আর সেই ছোট্ট রাজকন্যাটি নেই। সব বাধা পেছনে ফেলে সুমি একদিন উড়াল দিল আমেরিকার পথে। খান সাহেবের অভিমানী মন কষ্ট পেয়েছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে বুকে। ডুকরে কাঁদতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চোখের জল ফেলে মেয়ের যাত্রা পথে অমঙ্গল ডেকে আনতে চাননি। কিন্তু সেদিন মেয়ের জন্মদিনে চোখ দুটো বারবার ভিজে উঠেছে। খান সাহেব হঠাৎ করেই তখন কাঁধে কারও হাতের চাপ অনুভব করলেন। তিনি জানেন এটা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত। কিন্তু তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন না। কারণ তিনি চান না তার স্ত্রী তার চোখের জল দেখে ফেলুক। আর স্ত্রীও চায় না এই কঠিন মানুষটার চোখে জল দেখতে। তাই তিনি চেয়ারের পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর পেছন থেকেই স্বামীকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা দিলেন। নীরবতা ভেঙে বললেন, আমেরিকায় রাত বারোটা বেজে গেছে। মেয়েকে ফোন দেবে না? ধর ফোন দাও। খান সাহেব জানেন তার মেয়ে এখন হাতে ফোন নিয়ে বাবার ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে। পাগলি মেয়েটা চায়, তার জন্মদিনের প্রথম শুভেচ্ছা বাবাই জানাবে। এ অধিকার আর কারও নেই। খান সাহেব মেয়েকে ভিডিও কল দেন। এক রিং হতেই পর্দায় তার রাজকন্যার ছবি ভেসে ওঠে। ফোনের পর্দায় আঙুল দিয়ে মেয়েকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেন খান সাহেব। তিনি ঠিক করেছেন মেয়ের সামনে কাঁদবেন না। কণ্ঠকে স্বাভাবিক রেখে বলেন, শুভ জন্মদিন মা। কেমন আছিস? কেক এনেছিস? আমি তোর জন্য অনেক বড় একটা কেক এনেছি। তোর মা আজ সব তোর পছন্দের খাবার রান্না করছে। এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেন খান সাহেব। সুমি একদৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। বাবার কণ্ঠ শুনেই বুকের ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বাবার সামনে কাঁদতে চাচ্ছে না সুমি। স্বাভাবিক গলায় বাবাকে বলে, বাবা তুমি কেমন আছ? আমি ভালো আছি মা। আয় তোকে দেখাই তোর মা আজ তোর জন্মদিনে কী কী রাঁধছে। না বাবা লাগবে না। আগে প্রাণ ভরে তোমাকে দেখতে দাও। বাবা আমার জন্মদিনে কিছু দেবে না? তুই শুধু বল মা, তোর কি চাই। আমার কিছুই লাগবে না বাবা। শুধু ছোটবেলার মতো একটু আদর করে দাও, প্লিজ। খান সাহেব ফোনের পর্দায় মেয়ের কপালে চুমু দেন। সুমি আমেরিকা বসেই কপালে বাবার ছোঁয়া অনুভব করে। খান সাহেব বুঝতে পারছেন, তিনি আর কান্না দমিয়ে রাখতে পারছেন না। তাড়াতাড়ি ফোনটা স্ত্রীর হাতে দিয়ে দেন। স্ত্রীর হাতে ফোনটা দিয়েই ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। এদিকে খান সাহেবের স্ত্রী ফোনের পর্দায় তাকিয়ে দেখেন মেয়েও অঝোরে কাঁদছে। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন তিনি নিজেও কাঁদছেন। বোকার মতো ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। বুঝতে পারছেন না কী করবেন, কাকে সান্ত্বনা দেবেন। মেয়েকে, স্বামীকে নাকি নিজেকে। বি. দ্র. এই রাজকন্যাকে বিয়ে করার পর রাজকন্যার স্বামী ভেবেছিল রাজকন্যার হৃদয় রাজ্যে সে আধিপত্য করবে। কিন্তু সে দেখল আসলে সেটা খান সাহেবের দখলে। প্রথম প্রথম তার অভিমান হতো, খারাপ লাগত, খান সাহেবের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন তার নিজের রাজ্যে দুটো রাজকন্যা এল তখন বুঝল, মেয়েদের হৃদয় জয় করতে সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা যায়, বাবার সঙ্গে নয়। এ এক অসম প্রতিযোগিতা। যেখানে আপনি কখনই জিতবেন না। খান সাহেবের রাজকন্যার জন্মদিনে রাজা ও রাজকন্যার জন্য রইল অনেক অনেক শুভ কামনা ও শুভেচ্ছা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.