পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) সঙ্গে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের সম্মেলনে আসামি গ্রেফতারসহ রুটিন কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি জানিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবিও করা হয়েছে। আসামি গ্রেফতার ও পুলিশের দৈনন্দিন কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। দেখা যায়, পুলিশের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধের দাবি তোলা হয়ে থাকে সাধারণত সচেতন নাগরিক, বিশেষত সুশীল সমাজ এবং বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। এবার পুলিশ নিজেই সেই দাবি তুলেছে, এটি প্রশংসনীয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে পুলিশ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না- এ অভিযোগ দীর্ঘদিনের। পুলিশের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ইত্যাদি প্রশাসনিক কাজেও এ দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতারা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে থাকেন। এতে অনেক দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাও বিশেষ কোনো রাজনৈতিক নেতার আস্থাভাজন না হওয়ায় বা তাদের কথামতো কাজ না করায় হয়রানির শিকার হন। বস্তুত পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যত অভিযোগ ওঠে, এর বেশিরভাগই সংঘটিত হয় পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ফলে। পুলিশের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পেতে এ বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা অত্যন্ত জরুরি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা পুলিশকে নিজেদের স্বার্থে, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের কাজে ব্যবহার করে। সরকারদলীয় বা সরকারের সমর্থক কোনো অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলে তাকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা চলে। এ জন্য থানাগুলোয় রাতের বেলায় নেতাকর্মীদের ভিড় লেগেই থাকে। এ ক্ষেত্রে মফস্বলের থানাগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুলিশের ওপর এ ধরনের হস্তক্ষেপ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
আমরা মনে করি, পুলিশের ভূমিকা হবে আইনের রক্ষক তথা জনগণের সেবকের। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তবতা এর বিপরীত। এর অন্যতম কারণ, আমাদের পুলিশবাহিনী ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। ব্রিটিশ শাসকরা ওই নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল পরাধীন জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহাকে দমিয়ে রেখে নির্বিঘেœ শাসনকাজ পরিচালনার উদ্দেশ্যে। আজকের যুগে এ আইন অচল। কাজেই আইনটির আমূল পরিবর্তন ছাড়া পুলিশকে জনগণের সেবকে পরিণত করা প্রায় অসম্ভব।
অস্বীকার করা যাবে না, পুলিশের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পর্যাপ্ত যানবাহন নেই তাদের। অনেক ক্ষেত্রে লোকবলেরও সংকট রয়েছে। অপরাধ দমন ও আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পুলিশকে জঙ্গিবাদ দমনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করতে হয়। এ জন্য পুলিশকে ঝুঁকিভাতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদানের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সেইসঙ্গে পুলিশ বিভাগে যোগ্যতা ও দক্ষতারও যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ক্ষেত্রবিশেষে উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসব পদক্ষেপে পুলিশের কাজে গতি আসবে ও হ্রাস পাবে দুর্নীতি। বৃহস্পতিবার তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকা হরতালে সাংবাদিকসহ অন্যদের ওপর চালানো নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমরা বলব, পুলিশের আচরণে মানবাধিকার ও মানবিক দিকগুলো যাতে বিশেষ গুরুত্ব পায়, প্রশিক্ষণকালেই সে শিক্ষাটা তাদের দেয়া দরকার। আমরা চাই, পুলিশ যথার্থই জনগণের বন্ধু হয়ে উঠুক। সরকারের সদিচ্ছা এবং পুলিশবাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বশীলতায়ই তা সম্ভব হতে পারে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.