রুমি ম্রো। পাহাড়ে ছুটতে ছুটতে পাখি হতে চেয়েছে বহুবার। উড়োজাহাজের পিঠে চড়ে ওড়ার বায়না তার। আকাশ থেকে নিজের গ্রামকে দেখতে চায়। অনেক বারণ উপেক্ষা করে একদিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি বাজারে উড়োজাহাজের ছবি কিনতে গিয়েছিল বাবার হাত ধরে। বাজারের পাশের স্কুল থেকে তখন ভেসে আসছিল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মোহনীয় সুর। বাবা মেন্থিন ম্রোকে নিয়ে স্কুলের কাছে যায় রুমি। এরপর তার প্রশ্নবাণে খানিকটা বিরক্ত হন বাবা। রুমি জানতে চায়, সোনার বাংলা কী? সবাই একসঙ্গে এ গান গায় কেন? বাবার নীরবতায় অনেকটা কালক্ষেপণ হয়। পুনরায় এসে উড়োজাহাজের ছবির খোঁজে এ দোকান–সে দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাবার হাত ছেড়ে দৌড়ে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে রুমি ম্রো। তখন শিক্ষক পড়াচ্ছেন ‘বাংলার খোকা’। চতুর্থ শ্রেণির বাংলা পাঠের গল্পটি তাকে মুগ্ধ করে। রুমি ম্রোর মুগ্ধতা তখন বাংলা ভাষার প্রতি। তার মনের ফ্রেমে আটকে যায় শিক্ষকের উপকরণে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর ছবি। তখন সে বাবার কাছে বায়না ধরে বাংলা স্কুলে পড়ার। বাবা আগ্রহী হন না। কারণ, দুর্গম পাহাড়ি পথের দূরত্ব আর দারিদ্র্য তার শিক্ষার আনন্দ ব্যাহত করে। যেখানে একদিন বড়বাজারে আসতেই তার খরচের ক্ষতিপূরণ হয় না, সেখানে প্রতিদিন গিয়ে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা তার সাধ্যের বাইরে। এভাবেই কেটে যায় আরও একটি বছর। পাশের বাড়ির দিদিরা যখন বছরে একবার তেজন মডেল স্কুল থেকে ছুটিতে বেড়াতে আসে। তখন রুমি স্কুলের গল্প শোনে। কালো ফ্রেমের চশমা পরা বঙ্গবন্ধুর কথা জানতে চাইলে দিদি বলে, উনি তো জাতির জনক। রুমি ম্রো জনক শব্দের অর্থ বুঝতে পারে না। তখন দিদি তাকে তার বাবার দিকে দেখিয়ে বলে, ওই যেমন তোর বাবা। এরপর এক শীতের সকালে পাহাড়ের কুয়াশা চিরে যাত্রা শুরু, বাংলা শেখার স্কুলে। নাম তেজন মডেল স্কুল। দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার ওসমানপুরে। এ দিকটা সমতল। পাহাড় ছেড়ে সমতলে এসে তার সামান্য মন খারাপ হলেও বাংলা শেখার আনন্দটাই রুমির কাছে বেশি। ২০০১ সালে ১৫ বিঘা জমিতে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠা করেন রেভারেন্ড আর টি ময়া ছাকছুয়াক। তাঁর বাড়ি কোরিয়ায়। একবার বাংলাদেশের পাহাড়ে বেড়াতে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো দেখতে না পেয়ে তাঁর ইচ্ছে হয় সমতলে ক্ষুদ্র জাতির মানুষদের জন্য একটা স্কুল করার। তাই কোরিয়ায় তাঁর গ্রামের নাম অনুসারে স্কুলের নাম রাখেন তেজন মডেল স্কুল। বিদ্যালয়টির উদ্দেশ্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিমেষ চাকমা মনে করেন, বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করলে এই শিশুরা বড় হয়ে সহজেই চাকরি পেয়ে যাবে। পাহাড়ে বাংলা শিক্ষক খুব কম। তাই বাংলা শিক্ষা নিতে অনেক অভিভাবক শিশুদের এখানে পাঠান। দ্বিতল ভবনের এই বিদ্যালয়ে ১০টি শ্রেণিকক্ষ, ১১ জন শিক্ষক ও ৯৫ জন শিক্ষার্থী আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ৩৬ জন। দুটি আলাদা ছাত্রাবাস আছে ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য। নিজেদের জিনিসপত্র সুন্দরভাবে সাজানো সেখানে। হোস্টেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা বিনা মূল্যেই। পড়াশোনার জন্য কোনো বেতনও দিতে হয় না। যেহেতু শিশুদের মা-বাবা সঙ্গে থাকেন না। তাই তাদের সব দায়িত্ব শিক্ষকদের ওপর। মেয়েশিশুদের শারীরিক পরিবর্তনের সময় পরামর্শ ও সহযোগিতা করেন বড় দিদিমণিরা। দিদিমণিরা এখানে থেকেই কলেজে পড়ে। শিশু থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর পর এই শিক্ষার্থীরা চলে যায় স্থানীয় উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে। সে খরচও দেয় এই কর্তৃপক্ষ। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ছোটদের সহযোগিতা করে ও হাতে-কলমে নানা প্রকার কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে। তেজন মডেল স্কুলে ছাত্রছাত্রীরা সাধারণত রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম এলাকা থেকে এসেছে। এ ছাড়া স্থানীয় সাঁওতাল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা এ বিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ করে। বম, চাক, ম্রো, খুমি, পাংখোয়া, ওঁরাও, মালো ও সাঁওতাল এই আট গোষ্ঠীর শিশুরা মূলত এই বিদ্যালয়ে পড়ে। সহকারী শিক্ষকÿ প্রজ্ঞারত্ন চাক বলেন, ‘২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাঁচ-সাত বছর পর পর্যন্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অফিস-আদালত ও হাটবাজারে গেলেই নানা প্রকার মন্তব্য ছুড়ে দিত অনেকেই। সুখের কথা হলো, সেসব দিন শেষ। বর্তমানে অনেক সম্মান দেয় এলাকার লোকজন।’ রুমি এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। এখন প্রতিদিনই সে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে থাকে— আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.