নিয়ম ভেঙে গাড়ি চালানোর জন্য মামলা হয়। কিন্তু নিষ্পত্তি হয় না। মামলা মাথায় নিয়েই মাসের পর মাস চলছে ফিটনেসবিহীন বা বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত গাড়ি। মামলা নিয়ে সারা দেশে চলছে অন্তত এমন ৯০ হাজার ৯৭৪টি গাড়ি। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালে বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা পরিচালিত মোবাইল কোর্টের খসড়া প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ের এনফোর্সমেন্ট শাখায় সারা দেশ থেকে আসা রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৪ সালে যে কয়টি গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল তার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি ২৬ হাজার ২৪টির। ২০১৫ সালে ২৯ হাজার ৫৭৭টি এবং ২০১৬ সালে ৩৫ হাজার ৩৭৩টি গাড়ির মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। এ নিয়ে গত তিন বছরে মামলা নিয়ে চলা গাড়ির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ৯৭৪। তবে বিআরটিএ’র এই হিসেবের সঙ্গে ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে করা গাড়ির মামলাগুলো যোগ হলে এর পরিমাণ অনেক বেশি হবে। ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশ (ট্রাফিক) এর অ্যাডিশনাল কমিশনার মো. মোসলেহ উদ্দিন আহম্মেদ মানবজমিনকে বলেন, ঢাকার ভেতরে প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৪০০০ হাজার মামলা হয়। এই মামলাগুলোর জরিমানা দেয়ার সময় দেয়া হয় ২১ দিন। এর মধ্যে কেউ জরিমানা পরিশোধ না করলে মামলাটি অটোমেটিক আদালতে চলে যায়। তবে প্রতি বছর কি পরিমাণ মামলা পড়ে থাকছে বা কি পরিমাণ গাড়ি মামলা নিয়ে চলাচল করে তার হিসাব নেই তাদের কাছে। রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় মোহাব্বত হোসেন নামের এক সিএনজি চালক বলেন, কয়েকদিন আগে রাস্তার পাশে যাত্রী নামিয়ে ভাড়া নেয়ার সময় ট্রাফিক পুলিশ একটি মামলা দেয়। তার জরিমানা ছিল ২৫০ টাকা। পরের সপ্তাহে যানজটের ভেতর অন্য গাড়িকে ওভারটেক করতে গেলে ট্রাফিক পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় আরেকটি মামলা দিয়েছে। এখন দুটি মামলার জরিমানা একসঙ্গে দিতে হবে। তবে সময় সুযোগের অভাবে জরিমানা দিতে যাওয়া হচ্ছে না। আব্দুল্লাহপুর টু গুলিস্তান রুটের ৩ নম্বর গাড়ির চালক মো. সিরাজ মিয়া জানান, রাস্তায় কেউ নিয়ম মেনে গাড়ি চালায় না। তাই কয়েকদিন পরপরই মামলা দেয় সার্জেন্ট। গত ছয় মাসে আমার গাড়ি নিয়ম ভাঙার দায়ে দুই বার মামলা খেয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। একটি মামলা রয়ে গেছে। খুব শিগগিরই মামলার জরিমানাটা দিয়ে আসব। না হলে মেয়াদ শেষে আদালতে পাঠালে অনেক ঝামেলা হবে। তিনি বলেন, সার্জেন্ট একবার ধরলেই মামলা দেয়। তবে একটি ধারায় একবার মামলা হলে নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে আর কেউ মামলা দেয় না। আর এসব মামলার জরিমানা কম হওয়ায় অনেকে জরিমানা দেয়। আবার কেউ না দিয়েই গাড়ি চালায়। ট্রাফিক পুলিশ ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষ বলছে, মোটর যান আইন ভঙ্গ করা হলে মামলা দেয়া হয়। মামলা অনুসারে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জরিমানা জমা দিলে তা নিষ্পত্তি হয়। যারা জরিমানা দেয়নি তাদের মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। মামলা নিষ্পত্তির জন্য সর্বোচ্চ ছয় থেকে আট মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। পরে আদালত এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। বেশির ভাগ মামলা হয় মোটরযান আইন ১৯৮৩-এর ১৫৭ ও ১৪০ ধারায়। ১৫৭ ধারায় অবৈধভাবে রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও নির্দিষ্ট লেন পরিবর্তনের দায়ে মামলা করে পুলিশ। ১৪০ ধারায় কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করা, তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি ও বাধা সৃষ্টি করার জন্য মামলা করা হয়। রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে প্রতিবন্ধকতা বা লেন পরিবর্তনের দায়ে যে মামলা হয় তার জরিমানা মাত্র ২৫০ টাকা। এরকম অধিকাংশ মামলার জরিমানার পরিমাণ ১ হাজার টাকার ভেতরে। যে কারণে চালকরা মামলাকে কেয়ার করে না। নিয়মিতই আইন অমান্য করে রাস্তায় গাড়ি চালায়। বিআরটিএ’র সচিব মো. শওকত আলী বলেন, ফিটনেসবিহীন বা বিভিন্ন ভাবে অভিযুক্ত গাড়ি ধরে যে মামলা দেয়া হয় তার জরিমানার পরিমাণ কম থাকায় গাড়ির মালিক বা চালক কেয়ার করে না। তাই নতুন আইন তৈরি করা হচ্ছে। এই আইনে জরিমানা বা শস্তির পরিমাণ ৫ থেকে ১০ গুণ বৃদ্ধি করা হবে। বিআরটিএ’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, এখনও ১৯৮৩ সালের আইন দিয়ে চলছে বিআরটিএ। এতে জরিমানার পরিমাণ অনেক কম। যে কারণে মামলা খাওয়ার পর গাড়ির চালক বা মালিক গুরুত্ব দেয় না। পুলিশ বা বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেট ধরলে জরিমানা কম হওয়ায় অনেক গাড়ির চালক ইচ্ছা করেই মামলা নেয়। এই জন্য আমরা খুব শিগগিরই নতুন আইন তৈরি করব। নতুন এই আইনে জারিমানা বা শাস্তির পরিমাণ বেশি থাকবে। এতে আশা করা যায় সবাই খুবই গুরুত্ব দেবে। এ ছাড়া, আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করছি। এমনকি চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য ওয়ার্কশপেরও ব্যবস্থা করছি। বিআরটিএ’র হিসাব মতে, রাজধানীতে নিবন্ধিত যান্ত্রিক পরিবহনের সংখ্যা ২৮,৭৯,৭০৮। এর মধ্যে নিবন্ধিত অটোরিকশা রয়েছে ২,৩৭,৪৯৮, মোটরসাইকেল ১৭,২৪,৩৬৯। ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট কার ৩০৮৫৪১, ব্যক্তিগত গাড়ি ৮৩০৮, ট্যাংকার ৪৫২৪ ও ট্যাক্সি ক্যাব ৪৫১৮৪। অন্যদিকে বাস রয়েছে ৩৯৭৯৭ এবং মিনিবাসের সংখ্যা ২৭,৩৬৮। নিবন্ধিত জিপ রয়েছে ৪৭,৬৬৬ টি। অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে ৪৬৩২টি। অটো টেম্পোর সংখ্যা ১৮,৩৭৯টি, কার্গো ভ্যান ৭,০০৪টি, কাভার্ড ভ্যান ২০,২৬৭টি ও ডেলিভারি ভ্যানের সংখ্যা ২৪,৮১১টি। হিউম্যান হলারের সংখ্যা ১৩,৬২৬টি ও ট্রাকটরের সংখ্যা ৩৬,৯৭৬টি। পিকআপ ভ্যান ৮৮,০৬০ টিসহ অন্যান্য গাড়ির সংখ্যা ৯৯৪৩টি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.