ভর্তুকি মূল্যের ভারতীয় সুতা বাংলাদেশে কম দামে ডাম্পিং করা হচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই ভারতের সুতা রফতানিকারকরা এভাবে অবাধ অনৈতিক ব্যবসায় লিপ্ত রয়েছেন। অন্যদিকে অতি মুনাফার লোভে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী দেশে উৎপাদিত মানসম্পন্ন সুতার পরিবর্তে কম দামে ডাম্পিং করা মানহীন সুতা আমদানি করছেন। এতে করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে অকারণে ভারতে চলে যাচ্ছে। এর ফলে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন দেশীয় সুতাকল মালিকরা।
এ পরিস্থিতিতে বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছে দেশীয় বস্ত্রশিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কার্যকর ত্বরিত পদক্ষেপ হিসেবে তারা কম দামের ভারতীয় সুতা বাংলাদেশে আমদানি বন্ধে উচ্চহারের প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক বা অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করার দাবি তুলেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্যবসায়ীদের এ রকম দাবি সংবলিত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আমরা এখনও পাইনি। ব্যবসায়ীরা কোথায় কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা জানিয়ে ট্যারিফ কমিশনের কাছে আবেদন করলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব। যৌক্তিক দাবি প্রমাণিত হলে অবশ্যই সরকারিভাবেই করণীয় ঠিক করা হবে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অনেকে জানিয়েছেন, দেশ এখন সুতা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন। কিন্তু চাইলেই দাম কম রাখা যাচ্ছে না। কেননা, দেশীয় শিল্প টিকিয়ে রাখতে অন্যান্য দেশ যে ধরনের ইতিবাচক সাপোর্ট দিয়ে থাকে এখানে তার কিছুই নেই। সংকট উত্তরণে সরকার দেশীয় বস্ত্রশিল্প সুরক্ষায় নানামুখী পদক্ষেপ নিতে পারে। বিশেষ করে প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তা দিলে সুতা কলগুলো আরও সম্প্রসারিত হবে। এতে লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। এর ফলে বৃহত্তর পরিসরে অর্থনৈতিক উন্নতির সূচক দ্রুত উপরের দিকে ওঠে যাবে। তাদের মতে, দেশীয় শিল্প বাঁচাতে হলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে প্রটেকশন দিতে হবে। যেমন প্রতিটি ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত দেশীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য সব কিছু করছে।
তারা আরও বলেন, ভারত তামাক ও মদ ছাড়া সব পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশকে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধান অনুযায়ী, এলডিসিভুক্ত বাংলাদেশ ভারতের বাজারে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ঘোষিত সবক’টি পণ্যে এ সুবিধা পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারত তা করছে না। উল্টো পাটপণ্য রফতানির ওপর তারা অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে। বছর কয়েক আগে তারা বাংলাদেশের ব্যাটারি রফতানির ক্ষেত্রেও এ পদক্ষেপ নিয়েছিল। এর বাইরে অনেক পণ্য রফতানির ওপর ভারত শতকরা সাড়ে ১২ শতাংশ হারে কাউন্টার ভেলিং শুল্কও (সিভিডি) নিচ্ছে। এসব কারণে ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পণ্য রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে সুতা রফতানির ক্ষেত্রে ভারত বিনা বাধায় ডাম্পিং করে চলেছে। এ কারণে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে সুতায় অ্যান্টি ডাম্পিং বসানোর এখনই সময় বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন বলেন, সুতা উৎপাদনে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন। ইতিমধ্যে চাহিদার তুলনায় নিটওয়্যারে প্রায় শতভাগ, উইভিংয়ে ৬০ ভাগ এবং হ্যান্ডলুমেও প্রায় শতভাগ সুতা উৎপাদনে সক্ষম হচ্ছে। এ সক্ষমতা ভবিষ্যতে আরও বেড়ে রফতানি পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হবে যদি দেশে কম দামে ভারতীয় সুতার বাংলাদেশে ডাম্পিং বন্ধ হয়। কারণ ভারত যে সুতা বাংলাদেশে রফতানি করছে তা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষিপণ্য হিসেবে ভর্তুকি সুবিধা নিচ্ছে। পাশাপাশি রফতানির বেলায়ও ভর্তুকি সহায়তা পাচ্ছে। অথচ এখানে এর কিছুই নেই।
তিনি বলেন, ভর্তুকি সুবিধার পণ্য রফতানি হলে যে দেশে রফতানি হয় সে দেশে যদি ওই পণ্যটি উৎপাদন হয়, তাহলে তার সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয়। একইভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও কঠিন হয়ে পড়ে। এখন সেটিই হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত হবে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা, অবাধ সম্প্রসারণে ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর যত দ্রুত সম্ভব অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি বা প্রতিরক্ষামূলক শুল্ক ধার্য করে দেয়া।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারত সম্প্রতি দেশের পাটপণ্যের ওপর উচ্চহারে অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি আরোপ করেছে। পাট কৃষিপণ্য। সরকার পণ্যটির উৎপাদনে ভর্তুকি দিচ্ছে, এ অজুহাতে ভারত সরকার এ শুল্ক ধার্য করেছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এটি হয়ে থাকলে সুতাও তো কৃষিপণ্য। উৎপাদন এবং রফতানি দু’ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ফলে তারা এ দেশে কম দামে সুতা ডাম্পিং করতে পারছে। তাহলে ভারতীয় সুতা আমদানির ক্ষেত্রে সরকার কেন অ্যান্টি ডাম্পিং ডিউটি বসাচ্ছে না?
এ খাতে ব্যবসায়ীদের অপর সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ও মেসার্স জনি টেক্সটাইল মিলের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুজ্জামান খান এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, সুতা তো বাংলাদেশে উৎপাদন হচ্ছেই। সেটা এখন স্বনির্ভরতাও অর্জন করেছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো অবস্থাতেই ভারতীয় সুতার বাংলাদেশে অবাধ আমদানি বহাল রাখা কিংবা কম দামে ভারতীয় সুতা ডাম্পিং করতে দেয়া উচিত হবে না। তিনি বলেন, ভারত প্রায়ই আমাদের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অহেতুক জটিলতা তৈরি করছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশেরও উচিত একটা পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া। যার প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে ভারতীয় সুতার ওপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসানো।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, তৈরি পোশাক উৎপাদনে সাধারণত আমরা এ খাতের ফিনিশড পণ্যই অর্থাৎ থান কাপড় ব্যবহার করি। এর সরবরাহকারী হচ্ছেন দেশের বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা। রফতানিকৃত পোশাকে এখন আমরা বড় অংশই মূল্য সংযোজন করি। তারা কম দামে বিক্রি করলে আমরা লাভবান হই। সে দৃষ্টিকোণ থেকে আমরাও বলছি, ভর্তুকি মূল্যে ভারতীয় সুতার অবাধ আমদানি বন্ধের সুযোগ থাকলে সেটি করা উচিত।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সবার আগে দেশের স্বার্থ দেখা উচিত। তারপর ব্যক্তিস্বার্থ। সে ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা দিতে যদি সুতা আমদানির ওপর কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় সেটি করতেই পারে। তবে আমি মনে করি, বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবেন, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, নানা কারণে দেশীয় পণ্য উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে করে প্রতিযোগী দেশগুলোর পণ্যের দামের সঙ্গে দেশীয় পণ্যের নির্ধারিত হওয়া দাম প্রতিযোগিতামূলক করা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে শিল্পে ব্যবহার করা গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে অনেক উদ্যোক্তা দেশে স্পিনিং মিল সম্প্রসারণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এটি তৈরি পোশাকসহ টেক্সটাইল খাতের জন্য উদ্বেগজনক। তিনি ব্যবসায় ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ভারতীয় কম দামের সুতার দাপটে বর্তমানে দেশী সুতার বাজারে মন্দা চলছে। দেশী স্পিনিং মিলে উৎপাদিত ৬০ বা ৮০ কাউন্টের সুতার সমান দামে ভারতের সুতা দেশে বিক্রি হচ্ছে। দেশীয় স্পিনিং মিল মালিকদের অভিযোগ, ভারত তার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ দেশের সুতার বাজার দখল করে নিতে চাইছে। এছাড়া তারা বাংলাদেশে তুলা বিক্রিতে টালবাহানা করছে। এ কারণে বেশি দাম দিয়ে অন্য দেশ থেকে তুলা আমদানি করতে হচ্ছে।
অপরদিকে সুতা রফতানিতেও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের তারা ৬ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে সেখানে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও কম ধার্য করে দেয়া হয়েছে। যার হার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। তাদের সক্ষমতা বেশি হওয়ায় উৎপাদন এবং রফতানি সক্ষমতাও বেশি হচ্ছে। ফলে এ দেশে বৈধ-অবৈধ উভয়পথেই বিপুল পরিমাণ সুতা আমদানি হচ্ছে। আর তাদের সহযোগিতা করছে এ দেশীয় অনেক নীতিনির্ধারক। এ কারণে সুতা উৎপাদনে ভর্তুকি সহায়তা তো দেয়া হচ্ছেই না, উল্টো এ খাত সচল রাখতে ব্যাংকের পেছনেও ২২ শতাংশ পর্যন্ত চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দিতে হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.