নুরুল হুদা পলাশ, সাস্কাটুন, সাস্কাচুয়ান, কানাডা।
কানাডার প্রেইরি হিসেবে খ্যাত সাস্কাচুয়ান অঙ্গ রাজ্যর আয়তন প্রায় ৬ লক্ষ ৫০হাজার বর্গ কিলোমিটার যা কিনা বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৫ গুন্ অথচ সাস্কাচুয়ানের সর্বমোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জন সংখ্যার প্রায় ১৫০ ভাগের একভাগ। এই বিশাল আয়তনে ছড়িয়ে আছে এক লক্ষেরও বেশি সুপেয় পানির হ্রদ, নদী এবং রিজার্ভয়ার। সবচেয়ে বড় হ্রদের মধ্যে আথাবাস্কা হ্রদ এবং রেড ডিয়ার হ্রদ অন্যতম। প্রায় ছয়মাস দুর্বিসহ ঠান্ডায় মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে যায় ঠিক গ্রীষ্ম আসার সাথে সাথেই সবাই বেরিয়ে পরে পরিবার পরিজন বন্ধু বান্ধব নিয়ে ছুটির দিনগুলো কাটানোর জন্যে। আর বেড়ানোর জায়গা বলতে সাস্কাচুয়ান এর অভ্যন্তরে এই লেক গুলোর পাড়ে বেড়ানোই মূলত বুঝায়। হ্রদে বেড়ানো মানে হ্রদের ধারে সবুজ ঘাসে বসে সময় পার করা, খেলা ধুলা করা , বারবিকিউ করা, হ্রদের শীতল জলে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে বনভোজন করা এসবই বুঝায়। কিন্তু সাস্কাচুয়ান এ লেক বেড়ানো মানে সবচেয়ে যেটা বেশি উপভোগের সেটা হলো মাছ ধরা। প্রতিবছর পুরো উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা হয় সাস্কাচুয়ান এ। মাছ ধরতে শুধুযে এখানকার বাসিন্দারাই যান তা না। আমেরিকা সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সৌখিন মৎস্য শিকারীরা গ্রীষ্মকালে সাস্কাচুয়ানে মাছ ধরতে আসেন।
শনিবার এবং রবিবার আমার সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। এই দুইদিন সকাল বেলা যতটা পারি ঘুমাতে চাই। যদিও আমার মাছ ধরার নেশা আছে কিন্তু গত কয়েক বছরে সেভাবে মাছ ধরতে যাওয়া হয়নি। অনেকবার পরিকল্পনা করেও ঘুমের কারণে সেটাকে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এইবার সবাই মিলে পরিকল্পনা করলাম মাছ ধরতে যাবো এবং সেই মাছ লেক এর ধারেই খাওয়া হবে। যে কথা সেই কাজ। কয়েকটি পরিবার মিলে গত মাসে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। সাস্কাটুন এর কাছেই। ব্রাইট ওয়াটার রিজার্ভয়ার। মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। আমাদের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেলো। কিন্তু সাস্কাটুন এর অন্যতম মৎস্য শিকারী কাজল ভাই (ওনার স্ত্রী মিরা ভাবী) এবং কামাল ভাই (এবং ওনার স্ত্রী তামান্না ভাবী) আমাদের আগেই সেখানে পৌঁছে গেলেন। এর অবশ্য একটা কারণ ছিল।
আট কেজি ওজনের নর্দার্ন পাইক শিকারী কামাল ভাই
ওনারা যেহেতু সব সময় মাছ ধরে থাকেন, আর আমরা সবাই লেক এর ধারে মাছ খাবো বলে সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়ে যাচ্ছি, তাই উনারা খুব টেনশনে ছিলেন যদি আবার কোনো মাছ না পাই। এখানে বলে রাখা ভালো, সাস্কাটুন এ যিনি সবচেয়ে বেশি মাছ শিকারের খ্যাতি ইতি মধ্যেই অর্জন করেছেন, তিনি আমাদের মির্জা গালিব (এবং ওনার স্ত্রী হোসনেয়ারা) সেদিন সস্ত্রীক অন্য একটি হ্রদে মাছ ধরতে যাবার কারণে আমাদের সাথে যোগ দিতে পারেননি। মৎস্য শিকারী মুশফিক ভাইও সেদিন আমাদের সাথে যোগ দেননি।
প্রায় চৌদ্দ কেজি ওজনের রুই মাছ ধরেছেন কাজল ভাই
আমাদের মোশারফ ভাই (এবং ওনার স্ত্রী তন্দ্রা ভাবী) ব্রাইট ওয়াটার রিজার্ভয়ার এ পৌঁছেই তাড়াহুড়ো করে তাবু টাঙানো এবং চুলা জ্বালানোর কাজে লেগে গেলেন(যেহেতু তিনি মাছ ধরায় সিদ্ধহস্ত নন তাই) । মিরা ভাবি (কাজল ভাইয়ের স্ত্রী) মাছ ভাজির সকল উপকরণ নিয়ে হাজির হলেন। বাকিরা যে যার মতো তাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব যথারীতি পালন করলেন।
পাঁচ কেজি ওজনের বিরল রেইনবো ট্রাউট ধরে গর্বিত গালিব
আমরা দুইজন (আমি এবং আমার সহধর্মিনী পুতুল) ধীরে সুস্থে যখন পৌঁছলাম তখন একটা বড় আকৃতির নর্দার্ন পাইক তারা ইতি মধ্যেই ধরে ফেলেছেন। আমাদের ওপরে খিচুড়ি রান্নার দায়িত্ব ছিল। আমাদের ফাতিমা আপা অত্যন্ত যত্নের সাথে মাছ কাটা এবং ভাজির কাজ শুরু করে দিলেন। ইতিমধ্যে আরো আরো কয়েকটা বড়োসরো পাইক ধরা হলো, সেগুলো ভাজি করা হলো, এবং সবাই মিলে নির্মল পানির ধারে বসে তাঁবুর নিচে মাছ রান্নার প্রস্তুতি চলছে।
ভুনা খিচুড়ি সহ তৃপ্তি সহকারে ভুরি ভোজন করলাম। বলাই বাহুল্য আশেপাশে যেসব মৎস্যশিকারী (বাংলাদেশী এবং বিদেশী) দুর্ভাগ্য বশতঃ কোনো মাছ ধরতে পারেননি, তারাও সানন্দে আমাদের সাথে খাবার খেলেন। বন্ধুজনেরা মিলে, পরিবার পরিজন সহ, একটি সুন্দর রোদ্র করোজ্জল দিনে সুন্দর একটি হ্রদের ধারে বসে, নিজের হাতে মাছ ধরে সেই মাছ আবার ভাজি করে খাওয়ার চেয়ে আরো মজার কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। সেদিন পাইক এর পাশাপাশি আমরা বেশ কয়েকটি হলুদ পারচ ও ধরেছিলাম। সারাদিন মজা করে সবাই মিলে ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। মনে গেথে রইলো মৎস শিকার আর ভোজনের সেই দিনটি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.