খুব বড় কিছু ঘটে গেল। হঠাৎ কী যে হলো, আমাদের বিশ বছরের ব্যবসা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। আমার ছোটবাবা (চাচা) আর বাবা দুজন মিলে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ব্যবসা শুরুর পর মফস্বলের ছোট্ট একটা শহরে সেই প্রথম আমাদের পরিবারে এল সুখাভিজাত্যের আলো। তখন গ্রামীণ কোনো ঘরে হাতে টাকার সচ্ছলতা এলেই মহাসমারোহে সে ঘরের চৌকাঠ পেরোত আলমারি। আরেকটু সামলাতে পারলে তার সঙ্গেই বসবাসের উদ্যোগ নিত কাচ ঝনঝন শোকেস! কে জানে বাজার খরচ থেকে কিছু টাকা বেঁচে গেলে কারও কারও রান্নাঘরেও আয়েশ করে দাঁড়িয়ে থাকত অহংকারী মিটসেফ! কারও ঘরে নতুন সদস্যের আগমন হলে হইচই আনন্দে সে ঘরে প্রবেশ করত আবেগের দোলনা। আমরা দেখতাম আমাদের বাবা-চাচাদের বাণিজ্যের সুবাদে সেই সকল ক্রেতার সুখ মাখা মনভূমি। নানা অনুভবের বীজ রোপণ হলো। মানুষের জীবনে শুধু দোলনচাঁপার ঘ্রাণ দোলা দেয় না; এই সকল আনন্দও দেয়। জানলাম জীবননাট্যে সুখের অঙ্ক স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে জড়িত, এই কথাও তুমুল সত্য। এক দিন এও প্রথম বুঝলাম, কী যেন হয়েছে। আমাদের যৌথ ব্যবসাতে ভাঙনের ভায়োলিন বাজছে। জানলাম, প্রকৃতি শুধু সৌন্দর্যের রূপকার না। কখনো কখনো তুমুল ঝড়েরও কর্মকার। যা লন্ডভন্ড করে দেয় সব কিছু। তার গুমোট অন্ধকারে অস্পষ্ট করে দেয় সব স্পর্শের অনুভব। মুহূর্তেই মাটিতে মিশে যৌথ সুখের সাতকাহন। সাতকাহনের সাত–পাঁচ না বুঝলেও আমরা চাচাতো–জ্যাঠাতো ছোট ছোট সব ভাইবোনরা এটুক বুঝেছি, ঘরের আবহাওয়াটা ভালো না! ছোটবাবার বাসায় প্রতি শুক্রবার যে হইহই রইরই হয়, তা বোধ হয় আর হচ্ছে না। বড়দের কত কী হয়, তা তো আমরা তো বুঝি না। তবু কেন যেন খালি পানি এসে যাচ্ছিল শিশুর সারল্যে পূর্ণ আমাদের চোখের আঙিনায়। ওটা আসা অন্যায় কিনা তাও তো বুঝি না! বড়দের ব্যবসার অঙ্ক কোন অঙ্কে আটকালে বনিবনা হয় না, বুঝ আসে না আমাদের।
শুধু বুঝি, আমাদের পারিবারিক আবহাওয়াটা আবছায়াতে। আগের মতো সতেজ নয়। আমাদের আর যখন-তখন বাবাদের ঘরে বোধ হয় যাওয়া চলবে না। সময়ে অসময়ে বউমার (ছোটচাচি) কাছে চায়ের বায়না খুব সম্ভবত আর করা যাবে না। আবদারের আচার আগের মতো রৌদ্র থেকে লুটিয়ে খেয়ে খিলখিলিয়ে হাসা বোধ হয় আর কখনো শোভন হবে না। তবে কী শুনব না আর মধ্যরাতে আমার ছোট বাবার আদরের ডাক? চাচাতো বোনটা তখন অনেক ছোট। দুধভাত! আমাদের বংশের আদরের টুকরা। মণি আপু, মণি আপু বলে একদিন মধ্যরাতে কান্না উঠল, তখন ছোট বাবা আমাদের কাছে ওকে নিয়ে আসল। নে ধর! আদর করে করে মাথায় তুলেছিস; এখন রাখ। কান্না সামলা। সেই আদরের মণিকে কী আর আদর করা যাবে না? আদরের মণিটা কী আর গভীর রাতে আমাদের জন্য কান্না করবে না? ও কী বুঝবে কিছু একটা হয়েছে? আমরা ওদের কেউ না! এদিকে আশপাশের কেউ কেউ তো বলে, ওরা তোমাদের কেউ না। আপন মানুষেরা দূরে গেলে এসব পরের মতো দেখতে ‘আপন সাজা’ মানুষেরা কোথা থেকে আসে? তাও তো বুঝি না। আমাদের দ্বিধান্বিত লাগে। বইতে পড়েছি ঈদ–পূজা পার্বণ হয় সবাই মিলে আনন্দে থাকবার জন্য। তাহলে কী এবার ঈদে সবাই একসঙ্গে হব না? ছোট বউমা কী নতুন নতুন পাখিওয়ালা টাকা ব্যাংক থেকে এনে এবার আর আমাদের জন্য রাখবে না? ধুর! কী যে হবে…। এই সব নিরানন্দ দিনে, আনন্দের দিনের ভাবনাদের ব্যাঘাত হবে নাকি সেই ভাবনা করে করে পার করছি। বড়রা কত কী ভাবে। আচ্ছা, আমরা ছোটরা যে এসব ভাবি এগুলো কী পচা ভাবনা? এসব ভাবতে ভাবতে একদিন আমরা দুই বোন ভুল করে ছোট বাবাদের বাড়ির কাছে চলে গেছি। বউমার ঘরে। আমাদের যৌথ পরিবারের আনন্দ নিকেতনে। আসলে ভুল করে যাইনি। ইচ্ছে করেই গেছি। বুদ্ধি করেছি কেউ যদি বকা দেয় বলব, ক্যামনে যে ভুল করে গেছি গা! ঘরের কাছে যেতেই ছোট বউমার সামনে পড়লাম। বউমা আবার আমাদের স্কুলের শিক্ষক। আমরা তো ভয়েই শেষ। বউমার কৃষ্ণচূড়া লাল চোখ। দেখেই বললেন, এই কাছে আয়। তোদেরকে একদম মেরে ভূত বানাই ফেলব। বজ্জাত মেয়ে কতগুলা। এ শিক্ষা দিয়েছিলাম তোদের? আজকে কেন আসছিস, অ্যাঁ? আজকে কইদিন হলো? এই বলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই জড়িয়ে ধরা সময়ে বউমার তীব্র ব্যক্তিত্বের কণ্ঠ বেয়ে ঝরছে কথা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোমলতা। আমাদের রাগ রাগ অথচ নরম স্বরে বলছেন, বড়দের মধ্যে অনেক কিছুই হয়। ছোটদের তা বুঝতে হয় না। তোরা কেন তার জন্য দূরে থাকবি? কাছে আসবি না? তোদেরকে এইগুলা শিখাইছিলাম আমরা? এই শিক্ষা পাইছিস কখনো মা–চাচিদের কাছ থেকে? নাহ। পাই নাই তো! কথাটা বলতেই পারলাম না। ছোট বোনটার গালে অনেক দিনের জমে থাকা আদর মেখে দিতে গিয়ে তা বলাই হলো না আর। তারপর আমরা অনেক মজা করে ভাত খেয়েছিলাম, বউমা খাইয়ে দিয়েছেন। এদিকে আম্মু–আব্বু তো এসব জানেন না। আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণে ভয়ে ভয়ে আমরা ঘরে ঢুকলাম। ঘরটা নিঝুম দ্বীপ হয়ে আছে। পিনপতন নীরবতা। সন্ধ্যা ডুব মেরেছে রাতের গভীরে। এদিকে রাতের খাবারের সময় ঘনিয়ে আসছে। আর আসছে অজানা আতঙ্ক। কীরে বাবা, আম্মু তো আজ আমাদের ভাত খাওয়ার কথাও কিছু বলছেন না। তবে কী জেনে গেছেন আমরা চুপি চুপি বউমার হাতে ভাত খেয়েছি। জানলে মারবে? তাহলে এখনো মারতে আসছেন না কেন? রাত হয়ে যাচ্ছে তো, দিলে দিয়ে দিক। মার খেয়ে ঘুমাই। ততক্ষণে রাত আরও আঁধার হলো। আম্মু সেই আঁধারে হারিকেনের আলোর মতো কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমরা প্রস্তুত! কৈফিয়তের কাবিননামায় স্বাক্ষর করতে। কিন্তু নাহ, আবহাওয়াটা মনে হচ্ছে ভিন্ন। আম্মু এসে বউমার মতো ভঙ্গিতে বললেন, তোর বউমা স্কুলে আসে না? টিফিন কোথায় করে? ছোট মণিকে নিয়ে আসলি না? কত দিন দেখি না…। অন্ধকারে দেখা যায় না। আম্মুর চোখও কী কৃষ্ণচূড়া লাল হয়ে আছে? তাহলে আম্মুর কণ্ঠ ছোট বউমার কণ্ঠের মতো কান্না কান্না শোনাচ্ছে কী জন্য? আম্মু কী কাঁদছেন? বড়রা কি ছোটদের মতো কাঁদে? সেই বিস্ময় নিয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আকাশটা আজ আগের থেকে পরিষ্কার। আবহাওয়াটা ঝড়ের পরে জেগে ওঠা প্রকৃতির মতো স্বচ্ছ। মায়াময়। সে স্বচ্ছ আবহাওয়াতে আমাদের না বোঝা পৃথিবীতে এই বুঝ প্রোথিত হলো, দিন শেষে স্নেহ, মায়া, মমতার কাছে বৈষয়িক বিষয়ের হয় পরাজয়। আনন্দ-বেদনা, রাগ কিংবা অভিমান থাকতেই পারে যেকোনো যৌথ নিকেতনে। কিন্তু সব শেষ হলেও এই বোধ যেন নিঃশেষ না হয় ছোটদের নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধ। তারা অন্যায় করলে ঘরের যে সদস্যই হোক তাকে সুশাসন করবার অধিকার দেওয়া। এসব যেন ঠিক থাকে পরিবার থেকেই। অতপর আমাদের ছোট্ট পৃথিবী জানল, এই সকল পারিবারিক প্রকৃতি কাননে ফুল আছে, কাঁটাও আছে। শুধু কাঁটাকে সরিয়ে ফুলের সুবাসটুকু নিতে জানতে হয়।
সূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.