সিডনি, ১১ এপ্রিল- পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। এদিন থেকেই শুরু হয় বাংলা সনের গণনা। বাঙালি তার নিজস্ব জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতগুলো উৎসব পালন করে তার মধ্যে বৈশাখবরণ অন্যতম । বৈশাখ বরণের সঙ্গে যে অনুষ্ঠানটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত তা হল বাঙলির ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা।
বৈশাখী মেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যাত্রা, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, লাঠি ও হাডুডু খেলার কথা। সেইসঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগসূত্র।
গত ৯ এপ্রিল (শনিবার) বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি, অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে টেম্পি পার্কে অনুষ্ঠিত হোল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটির প্রাণের মেলা ঐতিহ্যবাহী ‘বৈশাখী মেলা’। সিডনির এই বৈশাখী মেলা অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালি ও অন্যান্য ভাষা-ভাষীদের এক মহামিলন মেলা। গত ১৬ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি অস্ট্রেলিয়া এই বৈশাখী মেলার আয়োজন করে আসছে। তার মধ্যে টেম্পি পার্কে এই বছর ছিল তাদের ১১তম আয়োজন। এলইডি স্ক্রিন, লেজার লাইটিং দিয়ে এবারের মেলার সুবিশাল স্টেজেটিকে সাজানো হয়েছিল ভিন্ন আঙ্গিকে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সিডনিতে মূলত দু’টি বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। অপর মেলাটিতে প্রবেশের জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ ডলার দিয়ে টিকিট ক্রয় করতে হয়। টেম্পি পার্কের এই বৈশাখী মেলায় রয়েছে বিনা টিকেটে প্রবেশর সুযোগ। তাই এবারের মেলাপ্রাঙ্গণ দর্শক-অতিথিতে ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। শুধু অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিরাই নয়, অন্যান্য ভাষা-ভাষী অতিথিদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য।
সিডনির দূর দূরান্ত ছাড়াও ক্যানবেরা, মেলবোর্ন থেকেও মেলায় অগনিত দর্শকদের সমাগম ঘটে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রবীণরাও বৈশাখী সাজে সজ্জিত হয়ে মেলাতে অংশগ্রহণ করতে ও মেলা প্রাঙ্গণে মুখরোচক দেশীয় খাবার নিয়ে পাটি বিছিয়ে অনেককে খেতে দেখা যায়। আবার অনেককে বলতে শোনা গেছে ‘মেরিকভিলের টেম্পি রিজার্ভ নয়, এ যেন প্রবাসে এক বাংলা মায়ের কোল’।
অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেয়া ও বেড়ে উঠা বাঙালি প্রজন্মকে জাতির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও এর ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াই এই মেলার প্রধান উদ্দেশ্য।
বিকেল ৪টায় কমিউনিটি বাংলাস্কুলের ক্ষুদে শিল্পীদের একক ও দলীয়মনোরম নৃত্যের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়। ক্ষুদে শিল্পীদের নৃত্যে পুরো মেলা প্রাঙ্গণে ছিল মুহুর্মুহু করতালি।
এরপর শুরু হয় কবিতা আবৃত্তি পর্ব। এ পর্বে অংশগ্রহণ করেন ড. কাইয়ুম পারভেজ, ড. রতন কুণ্ডু, শাহীন শাহনেওয়াজ, এম এ জলিল, লরেন্সে ব্যারেল, অনিয়া মতিন প্রমুখ। মাগরিবের নামাজের বিরতির পর শুরু হয় অতিথিদের আসনগ্রহণ ও আলোচনা পর্ব।
আলোচনা পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ এমপি। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন এমপি, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল পারলামেন্টের এমপি টনি বার্ক, ম্যাট থিসেলথওয়েইট, লরি ফারগুয়েশন, লিনডা বার্নি, ম্যারিকভিল সিটি কাউন্সিলের মেয়র স্যাম ইসকান্দার, ডেপুটি মেয়র রোজানা টেইলর, ক্যান্টারবারি সিটি কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র কার্ল সালেহ, কাউন্সিলর মরিস হান্না, রাজ দত্ত, ড. মাসুদুল হকসহ অন্যান্য নেতারা।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও অস্ট্রেলিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হকের উপস্থাপনায় এই বৈশাখী মেলা আলোচনা অনুষ্ঠানের সভপতিত্ব করেন ম্যাক্যায়রি ইউনিভার্সিটির প্রফের রফিকুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ সিডনি, অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ সম্পাদক এবং মেলা কমিটির আহ্বায়ক গাউসুল আলম শাহজাদা তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে ম্যারিকভিল সিটি কাউন্সিলের সার্বিক সহযোগিতার কথা গভীর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। মেলা কমিটির আহ্বায়ক গাউসুল আজম শাহাজাদা সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে মেলার আলোচনা পর্বের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
এছাড়াও মেলায় উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশি রাজনৈতিক, সামাজিক ওসাংস্কৃতিক নেতারা, সিডনি থেকে প্রকাশিত অনলাইন ও পেপার পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বৈশাখী মেলার উম্মুক্ত মঞ্চে ছিল শিশু কিশোর শিল্পীদের অংশগ্রহণে দেশাত্মবোধক গান, ছড়া, কবিতা, নাচের সুবিশাল আয়োজন।
আলোচনা পর্বের পর সঞ্জয় টাবুর মিউজিক, লাইটিং ও সাউন্ড তত্ত্ববধায়নে শুরু হয় মূল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং চলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। বিশেষ এই সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন পিয়াসা বড়ুয়া, অভিজিত বড়ুয়া, সুজন, রুহুল আমিন, অমিয়ামতিন প্রমুখ। নাচের অপূর্ব ঝংকারে মাতিয়ে রাখেন অর্পিতা সোম ও ঋতুপর্ণা। সবশেষে স্থানীয় ব্যান্ড কৃষ্টি, স্পর্শ, লাল সবুজ ও ঐক্যতান। ব্যান্ড সংগীত পরিবেশন করে মেলার দর্শকদেরসুরের মুর্ছনায় মাতিয়ে রাখে।
ঐতিহ্যবাহী এই ‘বৈশাখী মেলা’ প্রাঙ্গণে চারিদিক ঘিরে ছিল বাঙালি খাবার ওদেশীয় পোশাকের নানাবিধ স্টল। খাবারের স্টলগুলিতে ছিল নানা ধরনের মুখরোচক দেশীয় খাবারসহ পুরি, চটপটি, পিঁয়াজু, হালিম, জিলাপি, সিঙ্গারা বিরানি, রকমারি পিঠা ও মিষ্টি। আর তৈরি পোশাকের স্টলগুলোতে ছিল সালোয়ার কামিজ, জামদানি ও অন্যান্য তাঁতের শাড়ির বিপুল সমাহার। মেলায় বিভিন্ন রকমের রাইড বড় দর্শকদের যেমন গ্রাম্য নাগরদোলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে তেমনি ছোট ছোট বাচ্চাদের সারাবেলা আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিল। এ মেলায় নামাজের জন্যও তৈরি করা হয়েছিল আলাদা প্যান্ডেল।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.