ভূমিকার বদলে
এলিস এন মুনরো। কানাডার কথাসাহিত্যের বিশিষ্ট নাম ও যশস্বী ব্যক্তিত্ব। দ্য নিউ ইয়রকার, দি আটলান্টিক মান্থলি, দ্য প্যারিস রিভিউ-এর মতো প্রসিদ্ধ সাহিত্য পত্রিকার নিয়মিত লেখক; কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একাধিক সাহিত্য-সম্মাননায় সংবর্ধিত এই ছোটগল্পকার কানাডার সাহিত্যজগতের মধ্যমণি হয়েছিলেন এতদিন। কিন্তু ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের অভিনন্দনবার্তা যখন এলিস মুনরোর কাছে এলো, তখনই তিনি স্পর্শ করলেন সাহিত্যের বিশ্বখ্যাতির সর্বোচ্চ চূড়া।
মুনরোর জন্ম ১৯৩১ সালে। কানাডার অন্টারিওর ক্লিনটন নামক ছোট শহরের কাছে। বাবা ছিলেন পশু খামারের মালিক, শীতবস্ত্রে ব্যবহৃত মূল্যবান লোম ও পশম যেসব পশু থেকে পাওয়া যায়। মা ছিলেন শিক্ষিকা। মাত্র ১১ বছর বয়সেই মুনরো ঠিক করে ফেলেন, বড় হয়ে একজন লেখকই হবেন। সে মতোই এগিয়েছে সবকিছু। নিজের পেশা নিয়ে পরবর্তী সময়ে আর কখনো তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেননি।
মুনরোর মায়ের দিকের আত্মীয়রা শহরবাসী। বাবার জীবনজীবিকা গ্রামকেন্দ্রিক। মন-মানসিকতায়, অভিরুচিতে, জীবনযাপন পদ্ধতিতে দুই পরিবারে ছিল পার্থক্য। ছিল দ্বন্দ্ব। শহুরে শিক্ষাভিমানী ভদ্রসমাজের গ্রামের মানুষজনকে অবজ্ঞার চোখে দেখাটা আমাদের দেশের মতো সেই দেশেও আছে। এই দ্বন্দ্ব এলিস মুনরো আশ্চর্য কুশলতায় তাঁর গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর গল্পে কর্তৃত্বপরায়ণা অনেক মাসি, দিদিমার দেখা মেলে। গ্রাম-শহরের দ্বন্দ্ব এই সব চরিত্রের মধ্যে রূপায়িত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গল্পের উপাদান এসেছে তাঁর কৈশোর-যৌবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। খুব কাছে থেকে দেখা, নিবিড় অন্তরঙ্গভাবে জানা কানাডার বিশেষ অঞ্চল অন্টারিওর হিউরন কাউন্টি, যেখান পৈতৃক বাড়ি এবং দ্বিতীয় স্বামী গ্যারি ফ্রেম্লিনের বাড়ি, এই ভূখণ্ডই এলিস মুনরোর প্রিয় স্থান। এই ভূভাগের প্রেক্ষাপটে গল্পগুলি রচিত। লরেন্সের উপন্যাসে যেমন নটিংহাম, হার্ডির উপন্যাসে যেমন ওয়েসেক্স, ফকনার ও ফ্ল্যানারি ও কনরের উপন্যাসে আমেরিকার মধ্য দক্ষিণাঞ্চল যেমন বারবার ঘটনাস্থান হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, কানাডার অন্টারিওর হিউরন কাউন্টির নিসর্গ, ছোট শহর ও গ্রাম মেশানো অঞ্চলটি এলিস মুনরোর বহু গল্পে অবিস্মরণীয়তা পেয়েছে। ছোট শহর ও গ্রাম এলাকার রক্ষণশীল সংকীর্ণ মানসিকতার সমাজে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা, পরিবার ও সমাজের সাথে সংঘাত- এই বিষয়টি তাঁর অনেক গল্পের উপজীব্য। আরো একটা বিষয়, উল্লেখ করবার মতো। পুরুষ চরিত্রের চেয়ে তাঁর গল্পের নারীরা বহুমাত্রিক, বহুকোণিক জটিলতা ও গভীরতায় রূপায়িত হয়েছে। পরিণত বয়সের গল্পে বৃদ্ধা-মধ্যবয়সী নিঃসঙ্গ নারীদের আলেখ্য, যাদের সাধারণ, আটপৌরে, আপাততুচ্ছ দিনানুদৈনিক জীবন গভীর কোনো উপলব্ধি বা বোধের হঠাৎ উদ্ভাসনে অর্থময় হয়ে যায়। জেমস জয়েস যাকে বলেছেন, এপিফেনি, বোধের হঠাৎ উদ্ভাসন, সেই আলোয় এলিস মুনরোর গল্পের চরিত্রদের চেতনার জগৎ দীপ্যমান। প্লট ও ঘটনা নিতান্ত স্বল্প বা গৌণ। বোধের হঠাৎ আলোর উৎসারণই মুখ্য তাঁর গল্পে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে, সমালোচকরা তাঁকে রাশিয়ার গল্পকার আন্তন চেখভের সাথে তুলনা করেছেন।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে যেভাবে সংগ্রাম করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়, তেমন সংগ্রাম করেই এলিস মুনরোকে সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে। ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকের ছাত্রী ছিলেন। নানা ধরনের চাকরি করেছেন পড়ার খরচ জোগাতে। ১৯৫০ সাল, তখনো তিনি ছাত্রী, তাঁর গল্প ছাপা হয়। ১৯৫১-তে বিয়ে করেন সহপাঠী জেমস মুনরোকে। স্বামী ও এলিস মিলে বইয়ের দোকান দেন। এই দোকানই ছিল সংসারের আয়ের উৎস। এই সংসারে আসে চার কন্যা সন্তান। দশ বছর পর জেমসের সাথে বিচ্ছেদ ১৯৭২ সালে। অতঃপর ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখার শিক্ষকতা। এই বিশ্ববিদ্যালয় পরে তাঁকে ডি-লিট সম্মানে বরণ করেছিল। সেটা ১৯৭৬ সাল। সেই বছর জেরাল্ড ফ্রেমলিনকে বিয়ে করেন। জেরালডের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় জেরালড ছিলেন ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার। বিয়ের পর অন্টারিওর ছোট শহর ক্লিনটনের কাছে জেরাল্ডের খামার বাড়িতে তাঁরা নতুন সংসার পাতেন। এই বাড়িতে ৮৮ বছর বয়সে ২০১৩ এর ১৭ এপ্রিলে এলিস মুনরো দ্বিতীয় স্বামী জেরালড ফ্রেমলিনের মৃত্যু হয়। এলিস নিজে দুরারোগ্য ব্যাধির জটিলতায় আক্রান্ত। ২০০৯ সালের টরন্টো শহরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এলিস তাঁর হৃদপিণ্ডের বাইপাস অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি এবং ক্যানসার-চিকিৎসা গ্রহণের কথা জানিয়ে ছিলেন। রোগযন্ত্রণার নির্মম অভিজ্ঞতা এবং অনেক আপনজন, নিকটাত্মীয় (পিতা, মাতা, কন্যা, স্বামী ও অন্যান্য) জনের মৃত্যুর নিদারুণ আঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের এতটা বছর পার করে এসেছেন তিনি। আঘাত, শোক, প্রিয় মানুষের বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা প্রতিবিম্বিত হয়েছে তাঁর রচনায় বারবার। তাঁর জীবন ও রচনার এই বৈশিষ্ট্যকে আলোকপাত করে অনেক সমালোচক গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন।
১৯৯৪ সালের প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে অন্তরঙ্গভাবে নিজের সম্পর্কে তিনি অনেক কথা বলেছিলেন। বলেছেন পঠনপাঠন, প্রিয় লেখক, লেখালেখির অভ্যাস, সমকালীন সাহিত্য সমাজ নিয়ে নানা কথা। বলেছেন ত্রিশ বছর বয়স অবধি বই পড়াটাই এক অর্থে তাঁর জীবন। প্রিয় লেখক কারা? লেখিকাদের নাম উল্লেখ করেছেন বেশি। তাঁদের মধ্যে আছেন ফ্ল্যানারি ও কনর, ক্যাথারিন এন পোটার, কারসন ম্যাক কালার্স, ইউডোরা ওয়েলটি। অকপটে জানিয়েছেন ডিএইচ লরেন্সের লেখা ভালো লাগে না। বিশেষত, লরেন্সের উপন্যাসে যৌনতার বর্ণনা। ভালো লাগে জাদুবাস্তবতার রীতিতে লেখা উপন্যাস। বিশেষভাবে বলেছেন, উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েলের উপন্যাস সো লং, সিইউ টুমোরো-এর কথা। মার্কেজের ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউডকে বলেছেন অনন্য, অনণুকরণীয়, কানাডার সাহিত্য সমাজ, যাতে পুরুষ লেখকদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ, তাকে বরাবর এড়িয়ে চলেছেন। মনে হয়েছে, নামিদামি পুরুষ সাহিত্যরথীরা লেখিকাদের অবজ্ঞা ও কৃপার দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। বলেছেন, সাহিত্যিকদের সাথে অতি ঘনিষ্ঠ সংসর্গে হয়তো তাঁর লেখার ক্ষতিই হতো। তাঁদের বক্রোক্তি ও আক্রমণে তাঁর আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগত। তাই বেছে নিয়েছেন নিভৃতি। মমত্ব দিয়ে লিখেছেন নারীর চোখে দেখা নারী পৃথিবীর কুশীলবদের কথা। নারীর কুমারীজীবন, দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক সম্পর্কের বহু জটিল অভিজ্ঞতার কথা, যেন আমাদের সাহিত্যের আশাপূর্ণা দেবী। মূলধারার বড় বড় উপন্যাস লেখা- এ যেন কেবল পুরুষদের পক্ষেই সম্ভব। একজন নারী হয়ে নারীত্ব, মাতৃত্ব, কারো প্রেমিকা, কারো বা স্ত্রীর ভূমিকায় তিনি যেন কেবলই প্রান্তজন, নিম্নবর্গীয়, ব্রাত্য, প্রান্তিক বিষয়বস্তুর কথাশিল্পী।
কিন্তু তাঁর গল্প ও কথাসাহিত্যের বদৌলতে যে সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাতে তিনি আজ স্বদেশের ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূলধারার অন্যতম প্রধান সাহিত্য রচয়িতার আসনে অধিষ্ঠিত। সাহিত্যে প্রথম কানাডা-অধিবাসী নোবেল বিজয়ী। ১৯৬৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত সময়কালে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা চৌদ্দ। কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনবার। আমেরিকার, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া থেকে এক ডজনের বেশি সাহিত্য পুরস্কারে হয়েছেন সম্মানিত।
সাহিত্যে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কানাডার ছোটগল্প লেখক এলিস মুনরো। সাহিত্যের এ শাখা থেকে এর আগে খুব কম লেখকই নোবেল পেয়েছেন। ১০ অক্টোবর ২০১৩ বৃহস্পতিবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করে সুইডিশ নোবেল একাডেমি। মুনরোকে ‘সমকালীন ছোটগল্পের মাস্টার’ অভিহিত করে নোবেল কমিটি বলেছে, ‘তিনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারেন। তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট ও বাস্তববাদী। অনেকেই তাঁকে কানাডার চেখভ বলে থাকেন।’ কানাডার স্থানীয় সময় বুধবার (৯ অক্টোবর ২০১৩) দিবাগত গভীর রাতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবরটি পৌঁছায় ৮২ বছর বয়সী মুনরোর কাছে। এ খবর পেয়ে তিনি ‘চরম বিস্মিত’ হন। তিনি বলেন, ‘জানতাম তালিকায় আমার নাম আছে। কিন্তু কখনো ভাবিনি যে আমিই জিতব।’
ইউটিউবে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মুনরো তাই বলেছেন, ‘আমি মনে করেছিলাম, লেখালেখি করেই আমি কেবল সফল হতে পারি। কেননা, আমার মধ্যে অন্য কোনো গুণ ছিল না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি সত্যিই বুদ্ধিজীবী ধরনের কেউ নই, বরং একজন ভালো গৃহবধূ।’
মুনরোর বেশির ভাগ গল্পে উঠে এসেছে কানাডার গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ। অন্য বড় লেখকদের মতো তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হননি। স্বাভাবিকভাবেই নিজের চারপাশের গণ্ডির বাইরের বিষয় নিয়ে তাঁর লেখালেখিও কম।
নোবেল কমিটি বলেছে, ‘তাঁর প্রায় সব গল্পের উপজীব্য ছোট কোনো শহরের প্রেক্ষাপট। এতে উঠে এসেছে সম্পর্ক ও নৈতিকতার টানাপড়েন, যার সৃষ্টি এক প্রজন্মের সঙ্গে আরেক প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ও জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব থেকে।’
মুনরো নিজেও স্বীকার করেছেন সে কথা, ‘এখানকার পরিবেশের ভেতরেই জীবন-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। কাজেই এখানকার আবহ আমি যতটা গভীরভাবে অনুভব করতে পারি, অন্য কোনো নতুন জায়গা সম্পর্কে সেটা সম্ভব নয়।’
মুনরো গভর্নর জেনারেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিন তিনবার। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস, ১৯৭৮ সালে হু ডু ইউ থিংক ইউ আর এবং ১৯৮৬ সালে দ্য প্রোগ্রেস অব লাভ বইয়ের জন্য। তিনি কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। আর সাহিত্যে নোবেলের পর সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৯ সালে। দ্য বেয়ার কাম ওভার দ্য মাউন্টেন বইয়ের জন্য তিনি ওই পুরস্কার পান। তাঁর এই বই অবলম্বনে পরিচালক সারাহ পলি তৈরি করেছেন সিনেমা অ্যাওয়ে ফ্রম হার।
মুনরোর প্রকাশিত অন্যান্য ছোটগল্পের সংকলনের মধ্যে আছে লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইম্যান-১৯৭১, সামথিং আই হ্যাভ বিন মিনিং টু টেল ইউ-১৯৭৪, দ্য মুনস অব জুপিটার-১৯৮২, ফ্রেন্ড অব মাই ইয়োথ-১৯৯০, ওপেন সিক্রেটস-১৯৯৪, দ্য লাভ অব আ গুড উইম্যান-১৯৯৮, হেটশিপ ফ্রেন্সশিপ কোর্টশিপ লাভশিপ ম্যারিজ-২০০১, রানঅ্যাওয়ে-২০০৪, টু মাচ হ্যাপিনেস-২০০৯ এবং ডিয়ার লাইফ-২০১২।
নিচের সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন জেন ম্যাককুলোক ও মোনা সিম্পসন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের কথা
এলিস মুনরো বছরের বেশির ভাগ সময় কাটান কানাডার অন্টারিও রাজ্যের ছোট্ট শহর ক্লিনটনে। আর নিউইয়র্ক থেকে ক্লিনটনতক সরাসরি কোনো বিমান নেই। জুনের এক সকালে আমরা নিউইয়র্কের লা গার্দিয়া বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিয়ে টরন্টো যাই, ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে তিন ঘণ্টা চালিয়ে সড়কপথে আমরা ক্লিনটনে পৌঁছাই। আমরা যখন মুনরোর বাড়ির সামনে পৌঁছাই, তখন গোধূলি। ওই বাড়িতে মুনরো তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, গেরি ফ্রেমলিনের সঙ্গে থাকেন; মুনরোর ভাষ্যমতে, ফ্রেমলিন ওই বাড়িতেই জন্মেছিলেন। বাড়িটার পেছনে সুন্দর একটা উঠান আর একটা অদ্ভুত ফুলের বাগান আছে। আমরা যখন পৌঁছাই, রান্নাঘরে মুনরো তখন ক্রেমলিনের স্থানীয় সুগন্ধী লতাপাতা দিয়া হাল্কা খাবার রান্না করছিলেন। খাবার ঘরের একদিকটায় মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বই, একপাশে একটা ছোট্ট টেবিলে একটা সেকেলে টাইপরাইটার। মুনরো ওই টাইপরাইটারে লেখেন।
পৌঁছার কিছু পর মুনরো পাশের গোড্রিচ শহরে নিয়ে গিয়ে বেডফ্রড হোটেলে আমাদের ওঠান, হোটেলটার অবস্থান গোড্রিচের আদালত ভবনের উল্টা পাশের চত্বরে। হোটেলটা উনিশ শতকে তৈরি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণবিহীন দুই বেডের রুমগুলা ভালোই আরামদায়ক। মুনরোর একটা গল্পে এক লাইব্রেরিয়ান ও এক স্কুল শিক্ষকও এই রকম এক হোটেলে উঠেছিলেন। পরের তিনদিন আমরা মুনরোর বাড়িতেও কথা বলেছিলাম, কিন্তু টেপ রেকর্ডারটা অন করিনি। আর মুনরো সাক্ষাৎকারটা দিয়েছিলেন হোটেল রুমে আমাদের ছোট কক্ষে, কারণ উনি ব্যাপারটা বাড়ির ভেতরে নিতে চাননি। মুনরো আর মুনরোর স্বামী দুজনই তাঁদের বর্তমান আবাসস্থল থেকে বিশ মাইলের ভেতরে বেড়ে উঠেছেন; আশপাশের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ইতিহাস তাঁদের নখদর্পণে। গোড্রিচে একটা গ্রন্থাগার থাকলেও সবচেয়ে কাছের বইয়ের দোকানটা ক্রেমলিন থেকে ত্রিশ মাইল দূরে। আশপাশের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে জানতে আমরা তাঁর কাছে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলাম। ক্রেমলিনে আর কোনো লেখক বাস করে কি না জানতে চাইলে মুনরো আমাদের একটা জরাজীর্ণ বাড়ির পাশে নিয়ে গিয়েছিলেন, বাড়িটাতে একজন অর্ধনগ্ন লোক কয়েকটা বিড়াল পরিবেষ্টিত হয়ে একটা টাইপরাইটারের ওপর উপুড় হয়ে বসেছিলেন। ‘রোদ, কি বৃষ্টি লোকটাকে প্রতিদিন ওখানে দেখি’, মুনরো বলছিলেন, ‘লোকটাকে আমি চিনি না, কিন্তু উনি কী লিখছেন আমার জানার খুব খায়েশ।’
কানাডায় আমাদের শেষদিন সকালে আমরা মুনরোর কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নিয়ে মুনরো যে বাড়িতে বেড়ে উঠছিলেন সেখানে গিয়েছিলাম। বাড়িটা তাঁর বাবা বানিয়েছিলেন, ওখানে উনি শেয়াল আর ভোঁদড় পালতেন। একটা কাঁচা রাস্তার শেষ মাথায় ইটের সুন্দর বাড়িটার অবস্থান। বাড়িটার সামনে একটা খোলা মাঠ, মাঠটাতে একটা অবতরিত বিমান দাঁড়ানো ছিল। বিমানটা দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল বিমানচালক গ্রাম থেকে তাঁর বউকে নিয়ে যেতে বিমান দাঁড় করিয়ে রাখছেন, মুনরোর গল্প ‘হোয়াইট ডাম্প’-এর মতো বা ‘হাউ আই মেট মাই হাজবেন্ড’ গল্পের যুবক বিমানচালক স্টান্টম্যান যেন একটা মাঠে বিমান অবতরণ করিয়ে রাখছে।
অন্টারিওর প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি অনেকটাই আমেরিকার মিডওয়েস্টের মতো, তো অন্টারিওর প্রকৃতি বা তাঁদের বাড়িটার মাঝে আধিপত্যপরায়ণতার ছাপ থাকলেও মুনরোর মাঝে তা নেই। সৌজন্যে মুনরো অনন্য, রসবোধে পরিমিত। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণের আগেই সাতটি ছোটগল্পের ও একটি উপন্যাসের বই প্রকাশ হয়েছে তাঁর। তিনি তখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটা পুরস্কার পেয়েছেন, তার মাঝে আছে কানাডার সবচেয়ে সম্মানজনক সাহিত্য পুরস্কার ‘গভর্নর-জেনারেল পুরস্কার’, ‘ও-হেনরি পুরস্কার’ ইত্যাদি। তিনি দ্য নিউইয়র্কারের নিয়মিত লেখিকা। তাঁর গল্প নিয়মিত আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পসংগ্রহগুলোতে প্রকাশিত হয়। এত সব সম্মানজনক অর্জন সত্ত্বেও তাঁর কণ্ঠে সাহিত্যে নবাগতদের মতো অনিশ্চয়তা স্পষ্ট। তাঁর মাঝে বিখ্যাত লেখকসুলভ কোনো ঔদ্ধত্য বা উন্নাসিকতা নেই; তাঁকে দেখলে বিখ্যাত লেখক বলে মনেও হয় না। নিজের লেখা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে কঠোর পরিশ্রম করলে যে কারো পক্ষে এমন লিখতে পারা সম্ভব। কিন্তু এটা শুধু শুনতেই সহজ শোনায়; বস্তুত তাঁর লেখার সরলতা অত্যন্ত বিরল। সিন্থিয়া ওজিকের ভাষায় ‘তিনি আমাদের চেখভ এবং তিনি তাঁর আর সব সমসাময়িকদেরও ছাড়িয়ে যাবেন।’
কথোপকথন শুরু
প্রশ্ন : আপনি যে বাড়িটাতে বড় হয়েছিলেন আমরা আজ সকালে সেখানে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আপনি কি আপনার গোটা শৈশবকাল ওখানটায় কাটিয়েছেন?
এলিস মুনরো : আমার বাবা মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওই বাড়িতে ছিলাম। বাবা ওই বাড়িটির কাছেই একটি খামার গড়ে তুলেছিলেন। সেখানে শিয়াল পালতেন। আর পশম তৈরি হতো। এখন বাড়িটা সেরকম আর নেই। অনেকটাই পাল্টে গেছে। এখন সেখানে একটা বিউটি পার্লার হয়েছে। এটা কালের পরিবর্তন। আমার ধারণা, বাড়ির পিছনে যে রান্নাঘরটা ছিল তা ভেঙে ফেলা হয়েছে।
প্রশ্ন : তারপর কি আপনি সেখানে গিয়েছেন?
এলিস মুনরো : না। যাইনি। সুযোগ পেলে আবার ওই বাড়িটাতে যেতাম। গেলে বসার ঘরটা একটু দেখতাম। ওই ঘরটাতে আমার বাবা ঘর গরম করার জন্য একটা ফায়ার প্লেস বানিয়েছিলেন। ওটা আমার দেখার ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে ভাবি বাড়িটাতে একবার যাব।
প্রশ্ন : আমরা ওই বাড়ির সামনের মাঠটাতে একটা বিমান দেখেছিলাম। ওটা দেখে আপনার ‘হোয়াইট ডাম্প’ আর ‘হাউ আই মেট মাই হাজবেন্ড’ গল্পগুলোর কথা মনে পড়ছিল।
এলিস মুনরো : হ্যাঁ। মাঠটা কিছু দিনের জন্য বিমানবন্দর ছিল। ওইখানের খামারটার মালিকের বিমান ওড়ানোর শখ ছিল। তিনি একটা ছোট্ট বিমান কিনেছিলেন। চাষবাস ওনার পছন্দ ছিল না। তাই উনি চাষাবাদ বাদ দিয়ে ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর হন। উনি আমার দেখা সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন পুরুষদের একজন। উনি এখনো বেঁচে আছেন। পঁচাত্তর বছর বয়সে লোকটি অবসর নেন। সম্ভবত অবসরের তিন মাসের ভেতরে তিনি ভ্রমণে বের হন। তখন একটা সব অদ্ভুত রোগে পড়েছিলেন। গুহা-গহ্বরে যেসব বুনো বাদুড় থাকে, তারা এই রোগটি ছড়ায়।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম গল্পের বই ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’। এ বইতে আপনার শৈশবের স্মৃতি জড়ানো এই এলাকাটার খুব স্পষ্টভাবে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আপনার জীবনের কোন সময়কে নিয়ে এই গল্পগুলো লিখছিলেন?
এলিস মুনরো : ওই গল্পগুলো পনেরো বছর ধরে লিখছিলাম। এর মধ্যে প্রথম গল্পটির নাম ‘দ্য ডে অব দ্য বাটারফ্লাই’। ওটা লেখার সময় আমার বয়স ছিল একুশ। আমি বেশ ভালো মনে করতে পারি ‘থ্যাংকস ফর দ্য রাইড’ গল্পটি লেখার সময়টিকে। সে সময়ে আমার প্রথম সন্তান আমার পাশে একটি দোলনায় শুয়ে থাকত। তখন আমার বয়স মাত্র ২২। ‘দ্য পিচ অব উট্রেশট’ লিখেছিলাম ত্রিশের ভেতর। তারও অনেক পরে লিখেছিলাম ‘ইমেজ’। আমার বয়স যখন ৩০ পার হয়ে গেছে তখন লিখেছি ওয়াকার ব্রাদারস কাউবয় গল্পটি। এটা ওই বইয়ের শেষ গল্পটি। এই গল্পটি আসলে অনেক দিন ধরে লেখা হয়েছে।
প্রশ্ন : ওই গল্পগুলা এখন আপনার কেমন লাগে? ওই গল্পগুলো কি আবার মাঝে মাঝে পড়ে দেখেন?
এলিস মুনরো : ওই বইটাতে ‘দ্য শাইনিং হাউস’ নামে একটা গল্প আছে, ওটা আমার প্রথম দিকের লেখা। গল্পটি আমি পড়েছিলাম টরেন্টোতে বছর দু-তিন আগে। টরেন্টোর হারবার ফ্রন্ট থেকে বহু বছর ধরে একটি পত্রিকা বের হয়। নাম টামারাক রিভিউ। ওখানে আমি আগে লিখতাম। এই পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সেখানে ওই পত্রিকায় সেই বহু বছর আগে প্রকাশিত আমার ‘দ্য শাইনিং হাউস’ গল্পটি পড়েছিলাম। গল্পটি এতদিন পরে পড়া ছিল আমার জন্য খুব কঠিন কাজ।
আমার ধারণা, আমার বয়স যখন মাত্র ২২ বছর তখন গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি পড়ার সময় ধীরে ধীরে আমি একটু একটু করে গল্পটি সংশোধন করছিলাম। আমার চোখে পুরোনো দিনের লেখার শৈলীটি ধরা পড়ছিল। মনে হয়েছিল এই লেখার শৈলী সেকেলে এবং অতি সাধারণ। এক একটা প্যারাগ্রাফ পড়ছিলাম আর ঠিক করছিলাম। কিন্তু একটি অনুষ্ঠানে গল্প পড়ার সময়ে পুরোটা সংশোধন করা সম্ভব নয়। অত সময় পাওয়া যায় না। আমি যখনই পুরোনো লেখা পড়ি, তখনই এরকম অনেক কিছু দেখতে পাই, যা আমি এখন আর লিখি না। বাতিল করে দিয়েছি। লোকজন পঞ্চাশের দশকে এই ধরনের শৈলী ব্যবহার করত।
প্রশ্ন : আপনি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর তা কি ফের সংশোধন করেন? পুনর্লিখন করেন? যেমন প্রুস্ত তাঁর ‘রিমেম্ব্রান্স অব থিংস পাস্ট’ বইটির প্রথম খণ্ডটি মরার আগে নতুন করে আবার লিখেছিলেন।
এলিস মুনরো : হ্যাঁ। এটা আমি করি। ধরুন হেনরি জেমস তাঁর পুরোনো লেখাগুলি খুঁটে খুঁটে পড়তেন। কোনো লেখাতে যখনই তিনি কোনো ধরনের অস্পষ্ট ভাব দেখতেন বা মনে করতেন- তিনি যা বলতে চাইছেন তা সহজ করে বলতে পারছেন না, খুব পেঁচালো ও জটিল হয়ে উঠছে। পাঠক তাঁর লেখাটির ভাব ধরতে পারবেন না। তিনি তখন এগুলো ঠিক করে দিতেন। সহজ সাধারণ স্পষ্ট করে আবার লিখতেন।
এ ধরনের কাজ আমিও করি। আমার ছোটো গল্প ‘ক্যারিড অ্যাওয়ে’ গল্পটা ১৯৯১-এর সেরা মার্কিন ছোটগল্প সংগ্রহে প্রকাশ হয়েছিল। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে গল্পটি বারবার পড়ে দেখছিলাম। ওটা পড়ার পর মনে হয়েছিল একটা অনুচ্ছেদ বদলানোর দরকার। অনুচ্ছেদটি খুবই ছোট। মাত্র দুই লাইনের। তবে ছোটো হলেও তা ছিল গল্পটির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। চোখে পড়ামাত্র আমি কলম ধরে অনুচ্ছেদটি নতুন করে লিখেছিলাম। লিখেছিলাম বইটির মার্জিনে। তখন তখনই এই সংশোধন কাজটি করে ফেলেছিলাম যাতে করে বইটির নতুন সংস্করণে ভুলটি পাঠকের চোখে আর না পড়ে। মাঝে মাঝে আমি এরকম করে আমার গল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। বুঝতে পারি আমি যখন গল্পগুলো লিখেছিলাম তখন এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থেকে লিখেছি। ফলে কিছু কিছু ফাঁক ফোকর থেকে গেছে। কিন্তু এখন যখন গল্পগুলো পড়েছি তখন তো আর ঘোরের মধ্যে নেই। গল্পের সেই নির্মাণ সময়ের উত্তেজনার মধ্যেও নেই। নতুন একজন পাঠক অথবা সমালোচকের চোখে নতুন করে দেখতে পাই। ভুল ধরা পড়ে।
প্রশ্ন : আপনি একবার বলছিলেন যে আপনার লেখা শেষ না হলে তা কোনো বন্ধুকে দেখান না।
এলিস মুনরো : ঠিকই বলেছেন। যখন আমি লিখছি কোনো গল্প— যতক্ষণ না পর্যন্ত আমার গল্পটি সম্পূর্ণভাবে লেখা না হয় ততক্ষণ অবধি কাউকে দেখাই না।
প্রশ্ন : সম্পাদকদের ওপর আপনি কতটা নির্ভর করেন?
এলিস মুনরো : সম্পাদনা নিয়ে আমার প্রথম বড় অভিজ্ঞতা হয় দ্য নিউইয়র্কার পত্রিকায় কাজ শুরু করার পর থেকে। এর আগে সম্পাদকদের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপির তৈরি করার সময়ে টুকটাক পরামর্শ নিতাম। এর বেশি নয়। সম্পাদকদের সঙ্গে কাজ করার আগে তাদের সঙ্গে লেখকদের একটা বোঝাপড়া থাকা দরকার। সেটা না হলে সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। একজন সম্পাদক মনে করেছিলেন উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েলের গল্পগুলো কিছুই হয়নি। এ ক্ষেত্রে যিনি কথাটি বলছেন, সমালোচনাটি করছেন, তার তীক্ষ্ণ চোখ থাকতে হবে। আমার কাছে তার কথা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে।
চিফ ম্যাকগ্রাথ আমার প্রথম সম্পাদক। তাঁকে পেয়েছিলাম নিউইয়র্কার থেকে। তিনি খুব দক্ষ সম্পাদক। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়েছি— আমি আমার লেখাতে যা লিখতে চেয়েছি এই লোকটি তা বুঝতে পেরেছেন। আমার লেখা যে সব সময় খুব বেশি কাটাছেঁড়া করতে হতো তা নয়। তিনি আমাকে অনেক পরামর্শ দিতেন। তাঁর পরামর্শ মোতাবেক আমি ‘দ্য টার্কিশ সিজন’ গল্পটা আবার নতুন করে লিখেছিলাম। আমার সঙ্গে আলোচনার আগে বইটি তিনি আগেই কিনে পড়ে নিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম যে রকম করে আমি গল্পটি লিখেছি নতুন সংস্করণে ঠিক সেইভাবেই প্রকাশিত হবে। তিনি গল্পটিতে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পাবেন না। কোনো সংশোধন করার পরামর্শ দেওয়ার মতো কিছু নেই। তিনি আমার লেখাটিকেই মেনে নেবেন। সেটা তিনি করেননি। তিনি বলেছিলেন আমাকে, ওকে, ঠিক আছে। তোমার গল্পের বইটি নতুন করে বের হোক। কিন্তু বের হলে একজন পাঠক হিসেবে গল্পটির মধ্যে এই জিনিসগুলো ভালো দেখতে পাচ্ছি। আবার এই জিনিসগুলো বদলালে গল্পটি আরো ভালো হবে। এই এই জিনিস আমি দেখতে চাই একজন সৎ পাঠক হিসেবে। তুমি আমার কথা মেনে নেবে তা কিন্তু আমি বলছি না। তবে আমি যে কথাগুলি তোমাকে বলছি সেগুলো নিয়ে তুমি আমি কথা বলতে পারি। তিনি কখনোই আমাকে বলেননি যে আপনার এগুলো অবশ্যই বদলাতে হবে। আমরা খোলা মনে গল্পটি নিয়ে বিস্তর আলাপ করেছি। এভাবে আমি অনেক ভালো গল্প পেয়েছি বলেই আমার মনে হয়।
প্রশ্ন : সম্পাদকের সঙ্গে এই বোঝাপড়া কীভাবে হতো? ফোনে না মেইলে? আপনি কখনো সরাসরি দ্য নিউইয়র্কারের অফিসে গিয়েছিলেন?
এলিস মুনরো : মেইলে হতো। ফোনেও আলাপ হতো; কিন্তু সরাসরি কয়েকবার মাত্র দেখা হয়েছে।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরুর আগে থেকেই কি আপনি একজন সিরিয়াস লেখক ছিলেন?
এলিস মুনরো : হ্যাঁ। আমার টাকা পয়সা ছিল না, তাই আর কিছু হওয়ার সুযোগও ছিল না। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই বছরের জন্য বৃত্তি দেওয়া হতো, তাই আমি জানতাম ওখানে আমি মাত্র দুই বছর থাকতে পারব। এই সময়টা আমার জীবনে ছোট্ট একটা অবকাশ যাপনের মতো, জীবনের একটা অসাধারণ সময়। কৈশোরে নিজ বাড়িটা দেখাশোনার দায়িত্বটা ছিল আমার ওপর। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম, বাড়ির কাজটা আর আমাকে করতে হলো না।
প্রশ্ন : এই দুই বছর শেষেই কি আপনি বিয়ে করলেন?
এলিস মুনরো : বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দ্বিতীয় বর্ষের পরেই আমি বিয়ে করি। আমার বয়স তখন বিশ। আমরা ভ্যাঙ্কুভার গেলাম। বিয়ে করা একটা দারুণ ব্যাপার– একটা বিরাট অভিযান, অভিযাত্রা। আমরা দেশের ভেতরেই দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাই। আমার বিশ আর তাঁর বাইশ বছর বয়স। আমরা এরই মধ্যে নিজেদেরকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো করে তৈরি করে ফেলি। আমরা একটি বাড়ি কেনার কথা ভাবি এবং ভাবি একটি সন্তান নেওয়ার কথা। এ জিনিসগুলো তাড়াতাড়িই হয়ে যায়। প্রথম সন্তান হয় আমার একুশ বছর বয়সে।
প্রশ্ন : আপনি কি সংসারের সব কিছুর মাঝেই লিখতে থাকেন?
এলিস মুনরো : অন্তঃসত্ত্বাকালে পুরো সময়টাতেই আমি মরিয়া হয়ে লিখি, কারণ আমি জানতাম এর পরে আর আমি লিখতে পারব না। প্রতিটি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাই আমাকে একটা শক্তির জোগান দিত, যাতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই আমি বিরাট একটা কিছু শেষ করতে পারি। আসলে আমি তেমন মহৎ কিছুই করতে পারিনি।
প্রশ্ন : শহরের এক হৃদয়হীন বালকের পটভূমিতে আপনি ‘থ্যাংকস ফর দ্য রাইড’ বইটি লিখেছেন। ছেলেটি নিজ শহর থেকেই রাতে কোনো একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে আসে। এবং মেয়েটির সাথে রাত কাটায়। কখনো মেয়েটির প্রতি আকৃষ্ট হয়, কখনো বা মেয়েটির দারিদ্র্য তাকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এটা লক্ষণীয়, যে সময়টাতে এই গল্পটি আপনার মাথায় আসে তখন আপনার নিজের জীবনটি কিন্তু স্বচ্ছলভাবে গুছিয়ে এনেছেন।
এলিস মুনরো : যে গ্রীষ্মে আমার বড় মেয়েটি আমার পেটে, আমার স্বামীর এক বন্ধু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তিনি প্রায় মাসখানেক থাকেন। তিনি ন্যাশনাল ফিল্ম বোর্ডে কাজ করতেন এবং তখন তিনি একটি ছবি বানাচ্ছিলেন। তিনি আমাদেরকে অনেক কিছু বলতেন– আমরা স্বভাবতই তাঁর সাথে আড্ডা দিতাম। কখনো কখনো আমাদের নিজেদের কথাও যোগ করতাম। জর্জিয়ান বে এলাকার একটা ছোট শহরে যখন তিনি থাকতেন সেই তখনকার একটা গল্প বলছিলেন, একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে মেলামেশা করতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা সাধারণত কী করে সে সম্পর্কে আমার স্বামীর বন্ধুর ধারণা ছিল না। কিন্তু আমি ভালোভাবেই পরিচিত ছিলাম। কাজেই তাৎক্ষণিকভাবে আমি মেয়েটি, তার পরিবার এবং তার অবস্থান বেশ ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছিলাম। মনে হয়, ঠিক এর পরই আমি গল্পটি লিখে ফেলি। ওই সময়টাতে আমার মেয়েটি দোলনা থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।
প্রশ্ন : প্রথম বইটি প্রকাশের সময় আপনার বয়স কত ছিল?
এলিস মুনরো : আমার বয়স তখন প্রায় ছত্রিশ। কয়েক বছর ধরে আমি এই সব গল্প লিখতে থাকি। পরিশেষে রেয়ারসন প্রেস নামে কানাডার এক প্রকাশনা সংস্থার একজন সম্পাদক আমাকে চিঠি লিখেন। ম্যাকগ্র-হিল পরে অবশ্য প্রকাশনাটি কিনে নেয়। তিনি জানতে চান একটা বইয়ের জন্য যথেষ্ট গল্প আমার আছে কি না। শুরুতে তিনি আমার গল্প এবং অন্য দু-তিনজন লেখকের গল্প নিয়ে একটা বই বের করতে চেয়েছিলেন। তিনি সেটা বাদ দিয়ে আমাকে অন্য যে সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তিনি বললেন, ‘আপনি যদি আরো তিনটি গল্প লিখতে পারেন তাহলে তা দিয়েই একটা বই বের করতে পারি।’ কাজেই বইটি বের হওয়ার আগের বছরই আমি ‘ইমেজ’, ‘ওয়াকার ব্রাদারস কাউবয়’ এবং ‘পোস্টকার্ড’ লিখে ফেলি।
প্রশ্ন : এই গল্পগুলো কি আপনি কোনো সাময়িকীতে প্রকাশ করেছিলেন?
এলিস মুনরো : বেশির ভাগই টামার্যাক রিভিউতে প্রকাশিত হয়েছে। এটা একটি ছোট্ট কিন্তু সুন্দর এবং সাহসী সাময়িকী। সম্পাদক বলেছিলেন যে একমাত্র তিনিই সাময়িকীটির সমস্ত পাঠকদের প্রথম নামে চেনেন।
প্রশ্ন : কখনো কি আপনি কোনো বিশেষ সময়ে লিখেছেন?
এলিস মুনরো : বাচ্চারা স্কুলে গেলেই আমি লেখার সময় পেতাম। কাজেই ওই বছরগুলোতে আমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমার স্বামী এবং আমার একটি বইয়ের দোকান ছিল। দোকানের কাজ ছাড়াও আমি দুপুর পর্যন্ত বাড়িতে কাজ করতাম। কাজের ফাঁকে আমি লিখতাম। পরে প্রতিদিন আমি দোকানে কাজ করতাম না। সবাই লাঞ্চে আসার আগ পর্যন্ত আমি লিখতাম। লাঞ্চ সেরে তারা চলে গেলে আমি আবার লিখতাম, প্রায় আড়াইটা নাগাদ। তারপর একটু কপি এবং বাড়ির কাজ। এসব করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত।
প্রশ্ন : মেয়েরা যখন ঘুমাত, তখন আপনি লিখতেন?
এলিস মুনরো : হ্যাঁ। দুপুরের পর ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত। আমি অনেক কিছু লিখতাম যা তেমন ভালো কিছু নয়। কিন্তু সেগুলো অবশ্যই ছিল সৃষ্টিশীল। যে বছর আমি আমার দ্বিতীয় বই, ‘লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন’ লিখি। আমি খুবই সৃষ্টিশীল ছিলাম। আমার এক মেয়ের বন্ধু আমাদের সাথেই থাকত। তাই সব মিলিয়ে আমার চার চারটি মেয়ে ছিল তখন; এবং আমাকে সপ্তাহে দুদিন কাজ করতে হতো। আমি প্রায় মধ্যরাতের পর ১টা পর্যন্ত কাজ করতাম। তারপর আবার সকাল ৬টাতেই উঠে যেতাম। আপনি হয়তো বুঝতে পারবেন, আমার মনে পড়ে, আমি প্রায়ই কী সব বীভৎস কিছু ভাবতাম, আমি বুঝি মরেই যাব বা আমার হার্ট অ্যাটাক হবে। আমার বয়স তখন মাত্র ঊনচল্লিশের মতো। অথচ এসব আমার মাথায় চেপে থাকত। তারপর আমি ভাবলাম, বেশ, এসব যদি হয়ও, তাতে কী? আমি তো এর মধ্যে অনেকই লিখে ফেলেছি। সবাই এসব লেখার মূল্যায়ন করতে পারবে! এটা এক ধরনের মরিয়া হয়ে ওঠার মতো ছিল। এত শক্তি এখন আর আমার নেই।
প্রশ্ন : ‘জীবন’ নিয়ে লেখার উপায়টা কী?
এলিস মুনরো : এ বিষয়ে লেখার দিনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। দিনটা ছিল জানুয়ারি মাসের রোববার। ওই দিন দোকান খোলা থাকে না। তা সত্ত্বেও আমি দোকানে গেলাম। তারপর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার স্বামী বলেছিলেন তিনি ডিনার সেরে নেবেন, তাই বিকেলটা আমার হাতে ছিল। মনে পড়ে আমার চারপাশের সব বিখ্যাত সাহিত্য গ্রন্থগুলোর কথা। আমি নিজেকে নির্বোধ ভাবলাম – ‘তুমি কী করছ এখানে!’ তারপর আমি অফিস কক্ষে গেলাম। আমার মাকে নিয়ে যে অংশটা লিখতে শুরু করলাম তার নাম, ‘প্রিন্সেস আইডা’। আমার মাকে নিয়ে লেখা অংশটা আমার জীবনে মুখ্য বিষয়। আমার অন্তরে সারাক্ষণ এটাই ঘুরাফেরা করত। আমি হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছি, তখনো এটাই আসবে। কাজে বিরতি নিয়ে আমি একদিন এটাই লিখতে শুরু করলাম। তারপর আমি একটা বিরাট ভুল করলাম। আমি এটাকে বাচ্চা বয়সীদের মতো করে একটা সাধারণ উপন্যাস হিসেবে লিখতে চেষ্টা করলাম। মার্চ মাসের দিকে দেখলাম এটা ঠিক পথে এগুচ্ছে না। এটা আমার কাছে ঠিক মনে হলো না। আমি ভাবলাম এটা বাদই দিতে হবে। আমি খুবই বিমর্ষ হলাম। তারপর আমার মাথায় এলো আমি এটাকে বিভক্ত করে যদি গল্পাকারে লিখি, তাহলেই আমি এটাকে সঠিক করে লিখতে পারব। এ থেকে আমি শিখলাম আমি সত্য ঘটনা নিয়ে কোনো দিন উপন্যাস লিখতে চাইনি, কারণ আমি ওভাবে ভাবতে পারিনি।
প্রশ্ন : কিছু গল্পের সমষ্টি হওয়ার কারণে, ‘দ্য বেগার মেইড’ও একটা উপন্যাসের মতোই।
এলিস মুনরো : বেশি করে দ্বিতীয়-অনুমান করতে চাই না। কিন্তু আমি প্রায়ই অন্য আর একটা গল্পের সিরিজ লিখতে চাইতাম। আমার নতুন বই, ‘ওপেন সিক্রেট’ এ অনেক চরিত্র আছে যা পুনরাবৃত্ত হয়েছে। ‘ভ্যান্ডালস’-এর বিলি দাউদকে ‘ক্যারিড এওয়ে’তে ছোট একটি মেয়ে হিসেবে রূপায়িত করা হয়েছে; এই কালেকশনে এটাই প্রথম গল্প।
বিলি দাউদ লিবারিয়্যানের ছেলে। এদের সবাইকে ‘স্পেস শিপস হ্যাভ লান্ডেড’-এ উপস্থাপন করা হয়েছে। এই গল্পগুলোতে এ রকম পুনরাবৃত্তি করা হয়তো ঠিক হয়নি। একটা গল্পের কাঠামো নিয়ে ভাবতে গেলে তা অন্য আরেকটা গল্পের সাথে মিলে যেতে পারে, একটা প্রচ্ছন্ন শক্তি বা প্রবণতা কাজ করে। এটা হতে দেওয়া ঠিক নয়। আমার মনে হয় না আমি এ রকম সিরিজ আবার লিখব। ধারণাটা কিন্তু আমার ভালোই লাগে। ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড একটি চিঠিতে এরকম কিছু একটা বলেছিলেন– আমার উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে, আমি চাইব এসব লিখে যাওয়ার আগে যেন আমার মৃত্যু না ঘটে। বিক্ষিপ্ত বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে গেলে এসব ছোটখাটো অনুভূতিমুক্ত থাকা কষ্টকর হতেই পারে। আমি নিশ্চিত, তারপরেও আপনি চেখভ বা অন্যদেরকে ভাবতে পারেন।
প্রশ্ন : চেখভ সব সময়ই একটা উপন্যাস লিখতে চাইতেন। তিনি নাম দিতে চেয়েছিলেন, ‘স্টরিস ফ্রম দ্য লাইভস অব মাই ফ্রেইন্ডস।’
এলিস মুনরো : আমি তা জানি। এবং সব কিছুর একটা অবয়ব দিতে পারার অনুভূতিটা যে কী বৃহৎ তা আমি জানি।
প্রশ্ন : যখন একটা গল্প লিখতে শুরু করেন তখনই কি আপনি জানেন গল্পটা কী হবে?
এলিস মুনরো : সব সময় না। যে গল্পটা ভালো হবে তা সাধারণত পরিবর্তন এবং পরিমার্জনের মধ্য দিয়েই হয়। এই মুহূর্তে আমি ‘কোল্ড’ নিয়ে একটা গল্প লিখছি। প্রত্যেক দিন সকালেই আমি এটা নিয়ে কাজ করছি। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগার মতো। কিন্তু আমি ঠিক যেন পছন্দ করি না, কিন্তু তবু মনে হয়, কোনো একসময় আমি এটাকে সিরিয়াসলি নেব। সাধারণত লেখা শুরুর আগে গল্পের চরিত্রগুলো সমন্ধে আমার সম্যক পরিচিতি হয়ে যায়। কোনো লেখাতে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারলে, গল্পটা আমার মাথায় অনেক সময় ধরে ঘুরপাক খেতে থাকে। তারপর যখন লিখতে শুরু করি তখন আমি গল্পের গভীরে চলে যাই। এই মুহূর্তে আমি সব নোটবুকে সব ভরে রাখছি।
প্রশ্ন : আপনি নোটবুক ব্যবহার করেন?
এলিস মুনরো : আমার প্রচুর নোটবুক আছে, যা বিচ্ছিরি লেখায় ভর্তি। নোটবুকগুলোতে সাধারণত যেকোনো জিনিস টুকে রাখি। অনেক সময় অবাক হই, আমি আমার প্রথম পাণ্ডুলিপির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবি– এসব টোকাটুকির কি আদৌ প্রয়োজন ছিল! আপনি জানেন, আমি অন্য লেখকদের চেয়ে আলাদা। অন্যরা আশীর্বাদপুষ্ট, তরতর করে ওপরে উঠে যায়। আমি যা কিছুই করতে চেষ্টা করি না কেন, আমার জন্য অত সহজে কিছুই হয় না। আমি অনেক সময় ভুল দিকে চলে যাই এবং তারপর নিজেকেই ফিরিয়ে আনতে হয়।
প্রশ্ন : আপনি কীভাবে অনুধাবন করেন যে আপনি ভুলে দিকে আছেন?
এলিস মুনরো : একদিন আমি হয়তো লিখে ভাবলাম আমি খুব ভালোই লিখেছি; আমি দিনে সাধারণত যে পরিমাণ লিখি তার চেয়ে অনেক বেশিই লিখলাম। কিন্তু পরের দিন সকালে উঠেই আমি অনুধাবন করি আমি এটা নিয়ে কাজ করব না। যখন কাজটার ধারেকাছে যেতে আমার দারুণ বিরক্তি লাগে তখন নিজেকে জোর করেই চালিয়ে নিতে হয়, তখন আমি বুঝি মারাত্মক ভুল একটা কিছু হচ্ছে। প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় যা হয়, আমি একটা পর্যায়ে পৌঁছার যথেষ্ট আগেভাগেই বুঝতে পারি আমি গল্পটা বাদ দিতে যাচ্ছি। একদিন কি দুদিন আমার বিষণ্ণতা বা বিমর্ষতায় কাটে। আমি তখন অন্য কিছু লেখার চেষ্টা করি। এটা যেন প্রেম-ভালোবাসার মতো আপনি রাগে-অভিমানে সব অবসাদ কাটিয়ে উঠতে, না ভেবে-চিনতে অজানা নতুন কারো সাথে সম্পর্ক করলেন যাকে আপনি আদৌ পছন্দ করেন না। এরপর, হঠাৎ করেই কোনো বাতিল করা গল্পের জন্যই নতুন আঙ্গিক আমার মাথায় আসে, আমি দেখতে পাই গল্পটার নতুন রূপ। কিন্তু এরকম তখনই হয়, যখন একটা গল্পকে বাতিল করে দিই। আমি বলি, নাহ্, এটা দিয়ে কিছু হবে না; এটা বাদ।
প্রশ্ন : সব সময় কি এ রকম করতে পারেন?
এলিস মুনরো : অনেক সময় আমি তা পারি না, এবং আমার সারা দিন কাটে বাজে মেজাজে। এ রকম সময়টা আমার জন্য বেশ বিরক্তিকর। জেরি যদি আমাকে কিছু বলে বা ঘর এবং বাইরে বারবার আসা-যাওয়া করে অথবা বেশি শব্দ করে আমি ভীষণ বিরক্ত বোধ করি। যদি সে কোনো গান ধরে বা এরকম কিছু করে তা খুবই অসহনীয় মনে হয়। আমি একটা কিছু ভাবতে চেষ্টা করি এবং দেওয়ালে মাথা ঠুকতে যাই; আমি এতসব সহ্য করতে পারি না। আমার এরকম বেশ কিছুক্ষণ চলে, তারপর ঠিক হয়ে যায়। ব্যাপারটি এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে, পুরো ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করি, তারপর ভুলতে চেষ্টা করি, বা অন্য কিছু ভাবতে চেষ্টা করি, যখন আমি মুদি দোকানে যাই অথবা গাড়িতে কোথাও যাই তখন সহসাই স্বাভাবিকতায় ফিরে আসি। আমি অবশ্যই ভাবব, স্বচ্ছভাবে আমাকে ভাবতেই হবে, আমার এই অভ্যাসটা অবশ্যই পরিহার করতে হবে, আর এসব লোকেরা তো বিবাহিত নয়। এটা হবে একটা বড় মাত্রিক মৌলিক পরিবর্তন।
প্রশ্ন : এটা হলো প্রায় বিশ বছর পরে?
এলিস মুনরো : হুম। বিশ বছরের বেশি পরে, এবং এর মধ্যে আমাদের কখনো দেখাও হয়নি। আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তাকেও দেখে একটু এমন মনে হলো না। একদিন হঠাৎ সে ফোন করে বলল- ‘আমি গ্যারি ফ্রেমলিন। আমি ক্লিনটন এ আছি, ভাবছিলাম একদিন আমরা একসাথে লাঞ্চ করতে পারি কি না!’ আমি জানতাম ওর বাড়ি ক্লিনটনে, ভাবলাম ও হয়তো বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে এসেছে। তখন আমি জানতাম সে অটোয়াতে থাকে, কারো কাছ থেকে শুনেছিলাম। ভাবলাম, তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে হয়তো অটোয়াতেই আছে, এখানে সে বাবা-মাকে দেখতে এসেছে, এর মাঝে হয়তো ভেবেছে পুরোনো কোনো বন্ধুর সাথে বসে লাঞ্চ করবে। সে আসার আগে পর্যন্ত আমি তাই ভাবছিলাম। আসার পর জানলাম সে ক্লিনটনেই থাকে, স্ত্রী-পুত্র বলে কিছু নেই। আমরা একটা ক্লাবে দেখা করলাম, তিনটা করে মার্টিনি খেলাম লাঞ্চেই। হয়তো, আমরা দুজনই কিছুটা নার্ভাস ছিলাম। তবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। সম্ভবত দুপুর শেষ হতে না হতেই আমরা একসাথে থাকার ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলাম। এটা খুব দ্রুতই হয়ে গেল। খুব সম্ভবত, আমি ওয়েস্টার্ন ওই সময়ের শিক্ষকতা শেষ করেই ক্লিনটনে এলাম এবং যে বাড়িতে সে মায়ের দেখাশোনা করার জন্য ফিরে এসেছে ওই বাড়িতেই একসাথে থাকতে শুরু করলাম।
প্রশ্ন : আপনি লেখালেখির উদ্দেশ্যে সেই সিদ্ধান্তটা নেননি?
এলিস মুনরো : আমি লেখালেখির কথা চিন্তা করে কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। এবং এখন পর্যন্ত এটা ছেড়ে দেব এ কথাও ভাবিনি। লেখালেখির জন্য আলাদা কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রয়োজন আছে কি না এটা আমি এখনো বুঝতে পারিনি। একমাত্র চাকরিগুলোর সময়ে, যখন আমাকে লেখক হিসেবে অফিস-টেবিল-চেয়ার দিয়ে দেওয়া হলো তখন আমি লিখতে পারিনি।
প্রশ্ন : এ ব্যাপারটা উঠে এসেছে আপনার শুরুর দিককার গল্প দি অফিস-এ। একজন ভদ্রমহিলা অফিস ভাড়া নেয় লেখালেখির জন্য, এরপর বাড়ির মালিকের কারণে মন দিতে পারে না এবং শেষে সে ওখান থেকে সরে চলে আসে।
এলিস মুনরো : ওটা বাস্তবের অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছি। আমি একটা অফিস নিয়েছিলাম এবং সত্যিকার অর্থেই একমাত্র ওই গল্পটা ছাড়া আমি আর কিছু লিখতে পারিনি। বাড়ির মালিক সব সময়ই ব্যাঘাত ঘটাত এবং যখন সে ব্যাঘাত ঘটনা বন্ধ করত তখনো আমি কাজ করতে পারতাম না। এবং এ ছাড়া যখনই আমার লেখালেখির জন্য কোনো অফিস ছিল তখনো আমি লিখতে পারিনি। যখন আমি ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডে ‘আবাসিক লেখক’ হিসেবে কাজ করতাম, সেখানে আমার একটা অফিস ছিল, ইংরেজি বিভাগে, একটা খুবই অভিজাত-সুন্দর অফিস। কেউ আমাকে চিনত না সেখানে, কেউ দেখাও করতে আসত না। সেখানে অবশ্য কেউ লেখক হতে চায়ওনি। এটা ছিল অনেকটা ফ্লোরিডার মতো, ওরা বিকিনি পরে সব সময় ঘুরে বেড়ায়। সুতরাং আমার তখন প্রচুর সময় ছিল, অফিস ছিল, আমি বসে বসে শুধুই ভাবতাম। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না, আমার করার কথা- কিন্তু সে এক নিথর দশা।
প্রশ্ন : ভ্যাংকুভারে কি উপকরণের অভাব ছিল?
এলিস মুনরো : আমি শহরতলির দিকে ছিলাম। প্রথমে উত্তর ভ্যাংকুভার, এরপর পশ্চিম ভ্যাংকুভার। উত্তর ভ্যাংকুভারে পুরুষরা সকালে উঠে চলে যেত, ফিরত রাতে, সারা দিন এটা ছিল শিশু আর গৃহিণীদের আবাসস্থল। সবার মধ্যে মিলেমিশে থাকার মতো একটা ব্যাপার ছিল, একা থাকাটাই বরং কঠিন ছিল। ভ্যাক্যুয়াম-ক্লিনিং ইত্যাদি নিয়ে প্রতিযোগাতামূলক আলোচনা হতো, আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। যখন আমার একটামাত্র বাচ্চা ছিল, তখন আমি তাকে স্টলার এ করে নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে বেড়িয়েছি কফি পার্টিগুলো এড়িয়ে চলার জন্য। এটা আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি এর চেয়ে অনেক ভিন্নরকম ছিল। কিছু ব্যাপারে ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা- যেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো আলোচনা। অনুমোদিত আনন্দ, অনুমোদিত মতামত, নারী হয়ে থাকার অনুমোদিত উপায় এমন কিছু অনুমোদন এ আবদ্ধ ছিল জীবন। একমাত্র বেরিয়ে আসার উপায় ছিল পার্টিতে অন্য নারীর স্বামীদের সাথে ঠাট্টা-মশকরা। এ ছাড়া পুরুষরা নারীদের সাথে তেমন একটা কথা বলত না, যদিও বলত- বলত অবজ্ঞার সাথে। পুরুষরা মেয়েদের কথা বলা পছন্দ করত না, করত না মেয়েরাও। সুতরাং পৃথিবী বলতে ছিল মেয়েলি আড্ডা, খাবার নিয়ে অথবা উলের সংরক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে। পশ্চিম ভ্যাংকুভার ছিল কিছুটা মিশ্র ধরনের, আমার কিছু ভালো বন্ধু হয়েছিল। আমরা বই নিয়ে, কুৎসা নিয়ে গল্প করতাম, হাসাহাসি করতাম হাইস্কুলের মেয়েদের মতো। এটা নিয়ে আমি লিখতে চাই, লেখা হয়নি এখনো, সেই কম বয়সী নারীদের শহরতলি, যেখানে তারা একে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখে। তবে ভিক্টোরিয়ায় গিয়ে বইয়ের দোকান খুলে বসাটা ছিল সবচেয়ে চমৎকার একটা ব্যাপার। চমৎকার ছিল কারণ, শহরের সব লোক বইয়ের দোকানে আসত আর আমাদের সাথে গল্প করত।
প্রশ্ন : বইয়ের দোকান শুরু করার আইডিয়া কীভাবে পেলেন?
এলিস মুনরো : জিম শহরের বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর ইটন ছেড়ে যেতে চাচ্ছিল। কী ধরনের ব্যবসা করা যায় এটা নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা- আমি বললাম, ‘দেখো! আমরা যদি একটা বইয়ের দোকান দেই তাহলে আমিও তোমাকে সাহায্য করতে পারি!’। সবাই ভাবছিল এই বুঝি আমরা শেষ! অনেকটা তাই-ই হয়েছিল। আমি খুবই দরিদ্র হয়ে পড়েছিলাম। তবে তখন আমার দুটো মেয়েই স্কুলে যেতে শুরু করে, সুতরাং পুরোটা সময় আমি দোকানে কাজ করতে পারতাম। বিয়ের পরে ওটাই ছিল আমার সবচেয়ে আনন্দের সময়।
প্রশ্ন : আপনার এই ভাবনা ছিল যে বিয়েটা আসলে টিকবে না?
এলিস মুনরো : আমি ভিক্টোরিয়ান যুগের মেয়েদের মতো ছিলাম- বিয়ে করার চাপ ছিল, একজনের মনে হলো এটাই হয়তো মুক্তির উপায়- মানে আমি নাচলাম, বিয়ে করলাম, এরপরই আসল জীবন শুরু হলো। আমার মনে হয় আমি বিয়ে করেছিলাম লেখালেখি করার জন্য, থিতু হয়ে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকে মন দেওয়ার জন্য। এখন মনে হয়, তখন আসলে আমি অনেক কঠিন হৃদয়ের ছিলাম। এখন বরং আমি অনেক বেশি গতানুগতিক।
প্রশ্ন : যেকোনো তরুণ শিল্পীকেই কি কঠিন হৃদয়ের হতে হয় না?
এলিস মুনরো : মেয়ে হলে সমস্যাটা বেশি হয়। সারাক্ষণই ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করতাম- তোমরা ঠিক আছো তো? ছেলেমেয়েদের দিকে পূর্ণ মনোযোগ আমি দিতে পারিনি। এমন না যে আমি ওদের অবজ্ঞা করেছি। কিন্তু পুরোপুরি আমি দিতে পারিনি! আমার বড় মেয়েটা যখন দুই বছর বয়স, আমি যখন টাইপরাইটারে বসে লিখতাম, মেয়েটা হয়তো কাছে আসত, আমি এক হাতে দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে লিখতাম। যখন বাচ্চাদের আমাকে প্রয়োজন ছিল, তখন আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। আর এখন যখন আমাকে ওদের প্রয়োজন, আমি কী যে ভালোবাসি ওদেরকে। আমি ঘরের মধ্যে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াই আর ভাবি- এখানে একসময় অনেক পারিবারিক ডিনার হতো।
প্রশ্ন : প্রথম বইয়ের জন্য আপনি গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পেলেন যেটা আপনার দেশের পুলিৎজারের মতো। প্রথম বইয়েই এত বড় পুরস্কার পাওয়ার মতো ব্যাপার আমেরিকায় খুব কমই হয়েছে। যখন হয়েছে এরপর লেখকের ক্যারিয়ার নিয়েই বরং সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
এলিস মুনরো : আমি ঠিক তরুণ ছিলাম না তখন, এটা হলো একটা বিষয়। তবে, এটা কঠিন সময় ছিল। প্রায় এক বছর আমি কিছুই লিখতে পারিনি এটা ভাবতে ভাবতে যে আমাকে একটা উপন্যাস এ কাজ করতে হবে। বড় কোনো বেস্ট সেলার লেখার মতো চাপ আমার ছিল না, যেমনটা এমি ট্যান-এর ক্ষেত্রে হয়েছে তার প্রথম বইয়ে। যদিও আমার বইটা গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পেয়েছে- কেউ এটা সম্পর্কে জানতও না। তুমি যদি দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে, ওরা দিতে পারত না।
প্রশ্ন : সমালোচনা আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? আপনার কি মনে হয় আপনি ওদের কাছ থেকে কিছু শিখতে পেরেছেন? কখনো ওদের কাছ থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন?
এলিস মুনরো : হ্যা এবং না, কারণ আসলেই সমালোচনা থেকে তুমি আসলেই খুব বেশি শিখতে পারবে না, তবে আঘাত পেতে পারো। একটা খারাপ সমালোচনা জনসম্মুখে অপমানিত হওয়ার মতো ব্যাপার। যদিও এটা কোনো ব্যাপার না, স্টজে দাঁড়িয়ে অপমানিত হওয়ার চেয়ে হাততালি পাওয়া নিশ্চয়ই ভালো।
প্রশ্ন : এখন কেমন পড়ছেন? এমন কোনো বই আছে যা আপনার জীবনে খুব প্রভাব ফেলেছে?
এলিস মুনরো : ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়া আসলেই আমার জীবন ছিল। আমি বইয়ের মধ্যেই বাস করতাম। দক্ষিণ আমেরিকার লেখকরা আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে যে আমি আসলে, ছোট শহর, মফস্বলের লোকজন ইত্যাদি যা আমি দেখেছি তা নিয়ে লিখতে পারি। তবে দক্ষিণের লেখকদের মধ্যে নারী লেখকরাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বেশি। ফকনার আমার খুব একটা পছন্দ ছিল না। আমার বরং পছন্দ ছিল এডোরা ওয়েল্টি, ফ্লেনারি ও’কনার, ক্যাথরিন এন পর্টার, কার্সন ম্যাকক্যুলারস। একটা অনুভূতি কাজ করত যে মেয়েরা আসলে প্রান্তিক, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে লিখতে পারে।
প্রশ্ন : যেটা আপনিও সব সময় করেছেন।
এলিস মুনরো : হুম। আমার কাছে মনে হয়েছে ওটাই আমার জগৎ, যেখানে মূলধারার বাস্তব জীবনের বড় উপন্যাসগুলো ছিল পুরুষ লেখকদের জগৎ। আমি জানি না এমন প্রান্তিক নিয়ে পড়ে থাকার ধারণা আমি কোথা থেকে পেলাম। হতে পারে আমি এমন পরিবেশে বড় হয়েছি। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি প্রথম যখন আমি ডি এইচ লরেন্স পড়ি। আমি বিরক্ত হয়েছি নারীদের যৌনতা বিষয়ে লেখকদের মনোভাব দেখে।
প্রশ্ন : উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু দেখাতে পারবেন যা নিয়ে আপনি বিরক্ত হয়েছেন?
এলিস মুনরো : এটা অনেকটা- আমি নিজে যখন অন্য লেখকদের লেখার উপকরণ তখন আমি কীভাবে নিজে লেখক হব?
প্রশ্ন : জাদুবাস্তবতা নিয়ে আপনার মনোভাব কী?
এলিস মুনরো : ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড’ আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু ঠিক আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মতো আমার কাছে মনে হয়নি। এটা সহজ মনে হয় কিন্তু আসলে তা না। পিঁপড়েরা বাচ্চা বহন করে নিয়ে যায়, কুমারী আকাশের সীমানা ছোঁয়, প্যাট্রিয়ার্চ মারা গেলে ফুলবৃষ্টি হয় এগুলো চমকপ্রদ। কিন্তু উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল-এর ‘সো লং, সী ইয়ু টুমরো’র মতো চমকপ্রদ এবং অবোধ্য, যেখানে কুকুর একটা চরিত্র। সে এমন একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে লিখছে কিন্তু কত অসাধারণ করে!
প্রশ্ন : আপনার নতুন কিছু গল্পে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
এলিস মুনরো : পাঁচ বছর আগে যখন আমি যখন আমি ‘ফ্রেন্ড অব মাই ইয়ুথ’-এর গল্পগুলো নিয়ে কাজ করছিলাম তখন ভিন্ন-বাস্তবতা নিয়ে একটা গল্প লেখার কথা ভাবছিলাম। আমি লিখিনি কারণ আমার মনে হয়েছে শেষে হয়তো আমি ট্যোয়েলাইট জোন ধরনের কিছু একটা করে বসব। খুব মূল্যহীন কিছু একটা। আমি ভয় পেলাম, তবুও আমি লিখলাম ‘ক্যারিড এওয়ে’ আমি ওটা নিয়ে কী কী করলাম এবং এরপর ও রকমভাবে শেষ করলাম। হয়তো বয়সেরও কোনো ব্যাপার আছে। কী ঘটেছে তা নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির একটা পরিবর্তন, কী ঘটতে পারত তা না বরং কী ঘটেছে আসলে। এমন অসংলগ্ন বাস্তবতা আমার নিজের জীবনে আছে, আমি অন্যদের জীবনেও দেখি। এটা একটা সমস্যা ছিল- আমি কেন উপন্যাস লিখতে পারি না, একসাথে এতকিছু জড়াজড়ি করে থাকতে আমি কখনো দেখিনি।
প্রশ্ন : আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারে কী বলবেন? এত বছরে কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে?
এলিস মুনরো : লেখালেখিতে আমার সব সময়ই আত্মবিশ্বাস ছিল, এর সাথে এমন একটা ধারণা ছিল যে, সেই আত্মবিশ্বাসটা আসলে ঠিক যুতসই হচ্ছে না পুরোপুরি। আমার মনে হয় বোকা হওয়ার কারণেই আমার এতটা আত্মবিশ্বাস। যেকোনো মূলধারা থেকে আমি এতটাই দূরে সরে থেকেছি যে আমি অনুধাবন করতে পেরেছি মেয়েরা পুরুষদের মতো এত সহজেই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না, যেমন পারে না, নিচু শ্রেণির লোকজন। যদি তুমি জানো যে তুমি এমন একটা শহরে মোটামুটি লিখতে পারছ যেখানে কেউ পড়েই না, তোমার কাছে মনে হতেই পারে এটা হয়তো অলৌকিক কোনো পুরস্কার!
প্রশ্ন : সত্যিই কি এমন কোনো নার্স ছিল?
এলিস মুনরো : না, নার্সকে আমি তৈরি করেছিলাম কিন্তু তার নামটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল। এখান থেকে প্রায় দশ কি.মি দূরে, ব্লাইদ থিয়েটারে একটা অর্থ-সংগ্রহের আয়োজন হয়েছিল। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু দিয়েছিল নিলাম থেকে অর্থ সংগ্রহের জন্য। একজন এই আইডিয়াটা দিয়েছিল যে আমার পরের গল্পের কোনো একটা চরিত্রের নাম সংগ্রহের জন্য আমি নিলাম ডাকতে পারি এবং সর্বোচ্চ অর্থদাতার নামই আমি ব্যবহার করব। টরন্টোর একজন ভদ্রমহিলা একটি চরিত্র হওয়ার জন্য চারশো ডলার দিলেন। তাঁর নাম ছিল এড্রে অ্যাটকিনসন। হঠাৎ করেই আমার মনে হলো যে, ইনিই সেই নার্স। তাঁর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি। আশা করি তিনি কিছু মনে করেননি।
প্রশ্ন : গল্পের শুরুটা কেমন ছিল?
এলিস মুনরো : গল্পটা যখন আমি লিখতে শুরু করি, আমি অন্টারিও থেকে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পথে আমাদের অজস্র ট্রিপগুলোর একটায় ছিলাম; প্রত্যেক বছর ফল-এ আমরা ড্রাইভ করে বেরিয়ে যাই আর স্প্রিং-এ ফিরে আসি। ফলে আমি তো লিখছিলাম না। কিন্তু আমি রাত্রে মোটেলে এমন একটা পরিবার সম্পর্কে ভাবছিলাম। তখনই আমার মায়ের পুরো গল্পটা জমাট বাঁধে, তারপর মাকে ঘিরে আমার গল্প বলাটা, আর আমি দেখতে পাই যে এটা আসলে কী নিয়ে। আমি বলব যে গল্পটা সহজেই এসেছিল। আমার কোনো সমস্যাই হয়নি। আমি আমার মায়ের চরিত্র এতবার এঁকেছি– তাঁর প্রতি আমার অনুভূতি, যে সে সব নিয়ে আমাকে ভাবতেই হয়নি।
প্রশ্ন : আপনার কাজের মধ্যে অনেক মা আছেন। এই বিশেষ মা’টি অন্য গল্পেও এসেছেন এবং তাঁকে খুবই আসল মনে হয়। আবার ‘দ্য বেগার মেইড’ গল্পে রোজ-এর সৎ মা ফ্লো-কেও তাই-ই মনে হয়।
এলিস মুনরো : কিন্তু ফ্লো কোনো আসল চরিত্র ছিল না। আমার পরিচিত মানুষদের মতোই ছিল সে, এমন একটা মিশ্র চরিত্র যাকে নিয়ে লেখকরা কথা বলেন। আমার মনে হয় ফ্লো জোর করে করা একটা চরিত্র কেননা ওই গল্পটা আমি সেই সময় লিখি যখন আমি তেইশ বছর দূরে থাকার পর আবার এখানে ফিরে এসে থাকতে শুরু করেছিলাম। এখানকার সম্পূর্ণ সংস্কৃতিটা আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়িয়ে দেয়। এখানে ফিরে বাস্তবের দুনিয়ার সাথে সংস্পর্শে এসে আমার মনে হলো, যে পৃথিবীটা আমি ব্যবহার করছিলাম, আমার শৈশবের পৃথিবী, তা শুধুই আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা এক পৃথিবী। ফ্লো সেই বাস্তবেরই এক প্রতিচ্ছবি– আমার স্মৃতির তুলনায় অনেক বেশি কর্কশ।
প্রশ্ন : আপনি প্রচুর ঘোরেন, কিন্তু আপনার কাজে যেন মূলত গ্রাম্য একটি সংবেদনশীলতা ফুটে ওঠে। আপনার কি মনে হয় যে আপনি এখানে যে গল্পগুলো শোনেন, তা আপনার জন্য অনেক বেশি সমৃদ্ধ, নাকি আপনি যখন শহরে থেকেছেন তখনো আপনার জীবন থেকে এভাবেই রসদ সংগ্রহ করেছেন ?
এলিস মুনরো : মফস্বলে থাকলে অনেক বেশি কিছু কানে আসে, সব রকম মানুষের সম্পর্কেই। সে ক্ষেত্রে শহরে নিজের মতো মানুষদের সম্পর্কেই বেশি কথা শোনা যায়। নারী হলে বান্ধবীদের থেকে অনেক কথা জানা যায়। ভিক্টোরিয়ায় কাটানো দিনগুলো থেকে আমি পেয়েছিলাম ‘ডিফারেন্টলি’, আর ‘হোয়াইট ডাম্প’-এরও অনেকটা। ‘ফিট্স’ গল্পটা পেয়েছিলাম এখানে ষাটের ঘরে থাকা এক দম্পতির খুন-আত্মহত্যার বাস্তব এবং সাংঘাতিক ঘটনাটা থেকে। শহরে থাকলে, আমি এ সম্পর্কে শুধু কাগজে পড়তে পেতাম; সমস্ত সুতাগুলো ধরতে পারতাম না।
প্রশ্ন : নানা কিছু তৈরি করা বা মিশ্রণ ঘটানোটা কি আপনার পক্ষে সহজ?
এলিস মুনরো : আগের থেকে এখন অনেকই কম ব্যক্তিগত লেখালেখি করি আজকাল, খুবই সহজ একটা কারণে। নিজের শৈশব তো ব্যবহার করে ফেলতেই হয়, যদি না, উইলিয়াম ম্যাক্সওয়েল-এর মতো, পেছনে বারবার ফিরে গিয়ে আরো সুন্দর নতুন মাত্রা তাতে যোগ করার ক্ষমতা থাকে। পরবর্তী জীবনের গভীর ব্যক্তিগত উপকরণ হলো আপনার সন্তান। বাবা-মা চলে গেলে তাদের সম্পর্কে লেখা যায়, কিন্তু তারপরেও আপনার সন্তানরা থেকে যায় এবং আপনি চাইবেন যে তারা যেন নার্সিং হোমে এসে আপনার সাথে দেখা করে যায়। পরামর্শযোগ্য হয়তো এই যে, লক্ষ্য করে গল্প লেখার দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া উচিত।
প্রশ্ন : আপনার পারিবারিক গল্প বাদ দিলে, আপনার অনেক গল্পকেই ঐতিহাসিক মনে হয়। আপনি কি এই ধরনের উপকরণ খোঁজেন নাকি অপেক্ষা করে থাকেন এসবের দেখা পাওয়ার জন্য?
এলিস মুনরো : উপকরণ সংগ্রহ করা নিয়ে আমার কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। তা সামনে আসার জন্য আমি অপেক্ষা করি এবং তা সব সময়ই সামনে আসে। সেই উপকরণের সমস্তটা সামলে নিয়ে ব্যবহার করাটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ঐতিহাসিক গল্পগুলোর জন্য আমাকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে। বউ বছর ধরে একজন ভিক্টোরিয় লেখিকাকে নিয়ে গল্প লেখার কথা আমার মাথায় ছিল, তিনি এই অঞ্চলেরই একজন লেখিকা। শুধু আমার যা চাই সেই রকম কবিতা খুঁজে পাচ্ছিলাম না; পুরোটাই হাস্যকর রকমের অবাস্তব ছিল। তার থেকে একটু ভালো জিনিস দরকার ছিল আমার। সুতরাং আমি লিখতে আরম্ভ করলাম। ওই গল্পটা লেখার সময় প্রচুর পুরোনো খবরের কাগজ দেখেছি, আমার স্বামীর যে সব জিনিস চারপাশে রয়েছে– অন্টারিওতে যেখানে আমরা থাকি, সেই হিউরন কাউন্টি নিয়ে তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা করেন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত ভূতত্ত্ববিদ। ‘ওয়ালি’ নামে যে শহরটা আমি লেখায় এনেছি, তার সম্পর্কে আমি খুব পরিচ্ছন্ন ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম। খবরের কাগজের ক্লিপিংস থেকেও খুব ভালো ইমেজ আমি পেয়ে যাই। তারপর, যখন আমার সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য দরকার হলো, গ্রন্থাগারের লোকটিকে দিয়ে আমি মাঝে মাঝে সেইসব কাজগুলো করিয়ে নিতাম। পুরোনো গাড়ি বা ওই ধরনের কিছু বা ’৫০-এর দশকের প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি। উনি ভীষণ ভালো। উনি এসব কাজ করতে পছন্দ করেন।
প্রশ্ন : আর সেই সব আন্টিরা, যে অসাধারণ আন্টিরা গল্পে আসেন।
এলিস মুনরো : আমাদের জীবনে আমার আন্টি আর আমার ঠাকুমা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। যতই হোক, আমার পরিবার শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত অঞ্চলে একটা প্রায় ভেঙে পড়া ফক্স-মিঙ্ক ফার্মের রোজগারের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল, আর তারা থাকতেন আসল শহরে, সুন্দর একটা বাড়িতে এবং বনেদিয়ানাটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। ফলে সব সময়ই তাদের আর আমাদের বাড়ির মধ্যে সব সময়েই একটা চাপ থাকত, কিন্তু ওই চাপটা পাওয়াটা আমার জন্য খুবই দরকার ছিল। যখন ছোট ছিলাম আমার এসব ভালোই লাগত। কিন্তু কৈশোরে পৌঁছে এটা জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময়ে পৌঁছে আমার জীবনের মুখ্য ভূমিকায় আর আমার মা ছিলেন না, যদিও তিনি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন; মান যিনি স্থির করবেন সেই মানুষটির ভূমিকায় তিনি আর ছিলেন না। সুতরাং এই বয়স্ক নারীরা সেই জায়গাতে এলেন এবং যদিও তারা এমন কোনো মান নির্ধারণ করেননি যাতে আমার আগ্রহ ছিল, একটা চাপের পরিস্থিতি অনবরতই ছিল যা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন : ‘লাইভ্স অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন’-এ মা ও মেয়ে যেভাবে শহরে থাকতে আসে, সেভাবে আপনি তাহলে আসলেই থাকেননি?
এলিস মুনরো : একবার শীতের সময় সে রকমই হয়েছিল। এক শীতে আমার মা স্থির করেছিলেন যে তিনি শহরে একটা বাড়ি ভাড়া নিতে চান, এবং তিনি তাই করলেন। তিনি নারীদের জন্য লাঞ্চ পার্টি রাখলেন, সোসাইটিতে নিজের একটা জায়গা করে নিতে চেষ্টা করলেন যা তার পক্ষে একেবারেই অগম্য ছিল। ফলে তিনি সেটা পারলেন না। ওখানে কোনো বোঝাপড়ার ব্যাপারই ছিল না। ফার্মহাউসে ফিরে আসার কথা আমার মনে পড়ে, যেখানে শুধু পুরুষেরাই ছিল, আমার বাবা এবং আমার ভাই। ওখানে কোনোকিছুর কোনো প্যাটার্ন আর দেখা যেত না। যেন বাড়ির মধ্যে কাদা ভর্তি হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : এমন কোনো গল্প আছে যা আপনার পছন্দ কিন্তু অন্যদের পছন্দ না?
এলিস মুনরো : দ্য মুন ইন দ্য অরেঞ্জ স্ট্রিট স্কেটিং রিংক’ গল্পটা আমার বেশ পছন্দের ছিল, কিন্তু গেরির ওই গল্পটা পছন্দ হয়নি। ওর শৈশবের কথা যা ও আমাকে বলেছিল, তার সূত্র থেকেই এই গল্পটা লেখা। ফলে ও হয়তো ভেবেছিল যে গল্পটা অনেক অন্যরকম হবে। আমি ভেবেছিলাম ওর গল্পটা পছন্দ হবে, আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। আর তখন ও বলল, ‘তোমার সেরা গল্পগুলির একটা এটা নয়।’ সেবারই কেবল আমার লেখা কোনো কিছু নিয়ে আমাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছিল। সেই থেকে, আমার সামনে কোনো কিছু পড়ার ব্যাপারে ও রীতিমতো সতর্ক থাকে, আর তারপরে যদি ওর পছন্দ হয় তবে ও সেটা বলে, আবার হয়তো কিছু বললই না। আমার মনে হয় বিয়েতে এভাবেই হয়তো সব সামলাতে হয়।
প্রশ্ন : আপনি যেখানে বড় হয়েছেন, তার থেকে বিশ কিলোমিটারও কম দূরত্বে গেরির বাড়ি ছিল। ওনার কথাসূত্র এবং শৈশবস্মৃতি কি আপনার কাছে আপনার প্রথম স্বামী জিম-এর জীবনস্মৃতির তুলনায় বেশি ব্যবহারযোগ্য?
এলিস মুনরো : না, জিম ছিলেন টরন্টোর কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু তাঁর জীবনের প্রেক্ষাপট খুবই আলাদা ছিল। তিনি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ধরনের একটি শহরের বাসিন্দা ছিলেন যেখানে অধিকাংশ লোকই টরন্টোয় কাজ করত এবং পেশাদার ছিল। চিভার নিউইয়র্কের আশপাশে ওই ধরনের মফস্বল সম্পর্কে লিখেছিলেন। এই শ্রেণির মানুষদের সাথে আমার আগে কখনো পরিচয় ছিল না, ফলে তাদের ভাবনাচিন্তা আমার কাছে অসম্ভব আগ্রহের বিষয় ছিল, কিন্তু তা গল্পের সূত্র তৈরি করতে পারেনি। আমি বোধহয় অনেকদিন ধরেই ওই ধরনের যাপনকে গ্রহণ করার ব্যাপারে খুবই আক্রমণাত্মক ছিলাম; ওই সময় আমি অনেকটা বামপন্থী ভাবাপন্ন ছিলাম। আর গেরি আমাকে যা বলে তার অনেকটাই আমি আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলি থেকেও মনে করতে পারি– যদিও মফস্বলের একটা ছেলের জীবন আর ফার্মে একটা মেয়ের জীবনের মধ্যে চূড়ান্ত তফাত রয়েছে। গেরির জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় বোধহয় ছিল ওর সাত থেকে চৌদ্দ বছর বয়সের মাঝখানের সময়টা, যখন ছেলেরা দল বেঁধে এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। তারা সমাজবিরোধী ছিল না, তবে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াত, যেকোনো মফস্বল শহরের মধ্যকার আরেকটা উপসংস্কৃতির মতো। মেয়েরা কখনই এসব ব্যাপারের অংশ ছিল না। আমাদের বান্ধবীদের সব সময়ই ছোট দল থাকত, আমাদের অত স্বাধীনতা ছিল না। ফলে এসব শুনতে ভালোই লাগত।
প্রশ্ন : এই অঞ্চলের বাইরে আপনি কতদিন ছিলেন?
এলিস মুনরো : ১৯৫১-এর শেষ দিকে আমার বিয়ে হলো। ভ্যাংকুভারে থাকতে গেলাম, ১৯৬৩ অবধি সেখানে ছিলাম, তারপর আমরা ভিক্টোরিয়াতে চলে আসি যেখানে আমাদের বইয়ের দোকানটা খোলা হলো– মুনরো’জ। আমি ফিরে আসি, সেটা বোধহয় ১৯৭৩-এর সামার। সুতরাং আমি ভিক্টোরিয়াতে দশ বছর মাত্র কাটিয়েছি। কুড়ি বছর ধরে আমি বিবাহিত ছিলাম।
প্রশ্ন : আপনি গেরির সাথে দেখা হওয়ার পরে ইস্টে চলে এলেন, নাকি কাজের জন্য?
এলিস মুনরো : কাজের জন্য। তা ছাড়া ভিক্টোরিয়াতে আমার প্রথম স্বামীর সাথে দশ বছর ধরে থাকছিলামও। এক বা দুই বছর ধরে বিয়েটা কার্যকরী হচ্ছিল না। ছোট শহর ছিল। পরিচিত একদল বন্ধুবান্ধব থাকে যেখানে সবাই সবাইকে চেনে, আর আমার মনে হচ্ছিল যে একটা বিয়ে যদি ভেঙে যেতে থাকে, সেই একই পরিবেশে থেকে যাওয়া খুবই কঠিন। আমার মনে হলো আমাদের জন্য ওটাই ভালো হবে, আর ও আসতে পারল না যেহেতু ওর বইয়ের দোকানটা ছিল। টরন্টোর বাইরে ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে আমি সৃষ্টিশীল লেখালেখি শিখানোর একটা কাজের প্রস্তাব পেলাম। কিন্তু কাজটা আমি করতেই পারিনি। আমার বিরক্তি লাগত। ফলে, টাকা-পয়সা একেবারে না থাকা সত্ত্বেও আমি কাজটা ছেড়ে দিই।
প্রশ্ন : আপনার ফিকশন পড়াতে ভালো লাগত না?
এলিস মুনরো : না! ভয়ানক ব্যাপার ছিল। সেটা ১৯৭৩। ইয়র্ক ক্যানাডার অন্যতম প্রগতিশীল ইউনিভার্সিটি ছিল। তা সত্ত্বেও, আমার ক্লাসে শুধু ছাত্রই ছিল, একটি মেয়ে ছাড়া যে কখনো বলার সুযোগই পেত না। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যা ফ্যাশনেবল মনে হতো ওরা তাই করছিল– একই সাথে দুর্বোধ্য এবং খুবই সাধারণ হওয়ার মতো একটা ব্যাপার; অন্য কিছু মেনে নেওয়ার ক্ষমতা ওদের ছিল না। আমার জন্য চেঁচিয়ে পালটা উত্তর দেওয়া এবং কিছু ধারণা যাতে আমি তখনো শান দিইনি, সেসব নিয়ে কথা বলার বিষয়টা খুবই আগ্রহের ছিল; কিন্তু আমি জানতাম না কীভাবে ওদের ভেতরে পৌঁছাতে পারি, কীভাবে ওদের প্রতিপক্ষ না হতে পারি। হয়তো এখন জানি। কিন্তু তার সাথে লেখালেখির কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হতো না– বরং টেলিভিশন বা ওই রকম কোথাও চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে ভালো একটা প্রশিক্ষণ, ক্লিশেগুলিতেই ভালো রকম মানানসই হয়ে ওঠা। আমার সেই সব পাল্টানোর ক্ষমতা থাকা উচিত ছিল, কিন্তু আমি তা পারিনি। আমার এক ছাত্র ছিল যে ওই ক্লাসে ছিল না, আমার কাছে একটা গল্প নিয়ে এসেছিল। আমার মনে আছে, গল্পটা এত ভালো ছিল যে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। কেননা আমার ছাত্রদের কোনো ভালো কিছু লিখতে আমি বহুদিন দেখিনি। মেয়েটা জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি আপনার ক্লাসে কীভাবে ভর্তি হতে পারি? আমি বলেছিলাম, হয়ো না। আমার ক্লাসের ধারেকাছেও এসো না, আমায় শুধু তোমার কাজগুলি দেখিয়ে যেও। সে পরে লেখিকা হয়েছে। একমাত্র সেই হতে পেরেছে।
প্রশ্ন : ক্যানাডার মতো ইউএসএ-তেও কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং স্কুল বেড়েছে?
এলিস মুনরো : না, ততটাও নয়। আইওয়ার মতো কিছু আমাদের এখানে নেই। তবে রাইটিং ডিপার্টমেন্টগুলোতে পড়ানোর পেশা রয়েছে। আমার এদের জন্য খারাপ লাগত কেননা এদের বই বেরোয় না। আমি যা রোজগার করতে পারব তার অন্তত তিন গুণ টাকা ওরা রোজগার করছিল, এই বিষয়টা আমার মধ্যে তেমনভাবে প্রভাব ফেলেনি।
প্রশ্ন : আপনার গল্পের বেশির ভাগই অ্যান্টারিওর পটভূমিকায় লেখা বলে মনে হয়। আপনি কি এখন এখানে থাকার ব্যাপারটা বেছে নিতেন, নাকি এটা পুরোই পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত ছিল?
এলিস মুনরো : যেহেতু এখানে থাকা হয়ে গেছে, আমি বেছে নিতাম। এটা গেরির মায়ের বাড়ি, আর ও এখানে ওর মায়ের যত্ন নেওয়ার জন্য থাকছিল। আর আমার বাবা আর সৎ মাও এই এলাকাতেই ছিলেন; আমরা মনে করেছিলাম যে অল্প কিছু সময়ের জন্য হলেও আমরা এই বৃদ্ধ মানুষগুলোর যত্ন নেব, আর তারপরে আমরা অন্য কোথাও যাব। তারপরে, বিভিন্ন কারণে, সেই সব আর হয়ে ওঠেনি। ওরা চলে গেছে অনেক দিনই, তবু আমরা এখানে রয়ে গেছি। এখনো থেকে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এই ল্যান্ডস্কেপ আমাদের দুজনের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভীষণ বড় একটা বিষয় যা আমাদের দুজনের মধ্যে রয়েছে। গেরিকে ধন্যবাদ– আমি ভীষণভাবে এই বিষয়ে কৃতজ্ঞ থাকি। অন্য কোনো ল্যান্ডস্কেপ, দেশ, লেক বা শহর আমি এভাবে গ্রহণ করতে পারতাম না। আর সেটা আমি এখন বুঝতে পারি, তাই আমি কখনো এখান থেকে যাব না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.