শেয়ারবাজারের সব বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরতে বিশেষজ্ঞদের সঞ্চালনায় এনটিভি আয়োজন করেছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মার্কেট ওয়াচ’। দ্বিতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে শেয়ারবাজারের সঙ্গে রাজস্বের সম্পর্ক নিয়ে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সিনিয়র প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশীদ লালী। অতিথি ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন, এফসিএ। স্কাইপের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে আলোচনায় যোগদেন আইসিএবির চেয়ারম্যান মাসিহ মালিক চৌধুরী। আলোচনা সংক্ষেপে তুলে ধরো হলো :
লালী : এনবিআর পুঁজিবাজারের জন্য অনেক কিছু করেছে, আরো করবে। পলিসিগতভাবে আপনি কী মনে করেন যে, পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত বিষয় যেমন : ডিভিডেন্ডের ওপর একটা ট্যাক্স কেটে রাখা হয়। আমরা হিসাব করে আরো দেখেছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারের কর পরিশোধের যে প্রক্রিয়া এখন চালু রয়েছে সেক্ষেত্রে দুইগুণ বা তিন গুণ কর পরিশোধ করতে হচ্ছে । হিসাব করলে যার পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আপনার ভাবনা বা কীভাবে এসব বিষয়কে নতুন করে সাজানো বা পরিবর্তন করা যেতে পারে।
মাসিহ মালিক চৌধুরী : প্রতিবছরই ট্যাক্স পলিসিতে কিছু কিছু পরিবর্তন আসে। পুঁজিবাজারের করপোরেট ট্যাক্স যত কম হবে, বণ্টনযোগ্য মুনাফা তত বেশি হবে। তার মানে যারা বিনিয়োগকারী তাদের আয় বাড়বে, তাদের রিটার্নের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী আসার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে এই নিয়মগুলো খুব সহজেই বদলায়। ফলে মানুষের মধ্যে সাসটেইনেবিলিটি (স্থায়িত্ব) থাকে না।
এবার যে অর্থ বিলটা হলো হয়েছে, এটা গত বছরের বিল। কিন্তু এটা যদি চলতি বছরের হতো এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারের ওপর একটা সরাসরি প্রভাব পড়তো। সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসতো বিনিয়োগ করত এবং ট্যাক্স পরিশোধ করতে পারত। আমাদের দেশে এটা হয় না।
আবার আমাদের দেশে যখন কোনো পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ট্যাক্স প্রোভিশন করা হয়, তখন তারা একটি অনিশ্চয়তায় থাকে । এর কারণ হলো, যখন কোনো কোম্পানির মূল্যায়ন হবে, তখন সেভাবে যে ট্যাক্সটা দেওয়া হলো বা একটা ইউনিভার্সাল ট্যাক্স দেওয়া হলে ধরে নেওয়া যায় যে এটাই নির্দিষ্ট থাকবে। ট্যাক্স বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখানেও একটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। ফলে এর একটি খারাপ প্রভাব পড়ে। এবারের আইনের কারণে সামনের বছরেও এর প্রভাব থাকবে।
আমাদের যে বিনিয়োগ হয় তা কিন্তু এখন ফান্ডামেন্টাল বেইজ ইনভেস্ট হচ্ছে না। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রিউমার (গুজব) এবং মিসস্পেক্যুলেশন থেকে ম্যানুপুলেশন করার চেষ্টা করে। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
আরেকটা বিষয় পোর্টফোলিও বিভিন্ন সাইজের থাকে। ছোট পোর্টফোলিও যেসব ঝুঁকি নিতে পারবে বড়গুলো আরো বেশি নিতে পারবে। আর সে ক্ষেত্রে তাদের আয়, প্রতিযোগিতা আর কর প্রদান সব কিছুর সঙ্গে ছোট পোর্টফোলিওধারীরা পারবে না। ফলে বিভিন্ন সাইজের পোর্টফোলিওর ওপর নির্ভর করবে প্রোস্পেক্ট।
আমাদের দেশে বিশেষ করে মিউচুয়াল ফান্ড যেগুলো ভালোভাবে কাজ করতে পারছে না, তা দেখা উচিত। সরকার শেয়ারবাজারকে দেখার জন্য একটা অন্যতম মূল মাধ্যম হলো ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন বাংলাদেশ (আইসিবি)। তবে গতানুগতিক ধারার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে এভাবে নজর দেওয়া উচিত। গ্রাচুইটি পেনশন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড শেয়ারবাজারে আনলে ভালো হতো। ব্যাংকগুলোর জন্য যে বিশেষ সুবিধা প্রদান করার ফলে মিউচুয়াল ফান্ড এবং অন্যান্য যারা আছে তারা একটি বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনি এনবিআরের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। আজাকের বিষয় নিয়ে আপনার মতামত তুলে ধরুন।
আবদুল মজিদ : পুঁজিবাজারকে একটা সহযোগী হিসেবে দেখতে হবে। কারণ দেশে যত ব্যবসা বাণিজ্য হবে, তত বেশি আয় হবে। আয়কর বা আয় বাড়ানোর কথা বলে ব্যবসাকে থামিয়ে দিলে তো রেভিনিউ পাওয়া যাবে না। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। পুঁজিবাজার সুস্থ আছে মনে করে আরো বেশি করে কর আরোপ করলে এ থেকে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আমি মনে করি সরকারের কর আহরণের পদ্ধতিটা এমন হওয়া উচিত যে, কীভাবে কর পাব তা না ভেবে কীভাবে আরো কর বাড়বে –সেদিকে নজর দেওয়া। সেজন্য সুবিধা বাড়াতে হবে। তাহলেই কর বাড়বে। খেয়াল রাখা দরকার, বেশি কর আহরণ করতে গিয়ে ব্যবসা যেন সংকুচিত হয়ে না পড়ে। সেজন্য ব্যবসায়ীকে উৎসাহিত করে তুলতে হবে।
আমাদের যে অর্থবিলটি পাস হয় তা মূলত গত অর্থবছরের ওপরে ভিত্তি করে করা হয়। গত অর্থবছরে তো আমি জানতাম না যে চলতি বছর কেমন হবে। আগে জানা গেলে কিন্তু আগে থেকে ধারণা রাখা যায় যে এবার করের হার কেমন হবে।
আমাদের কর নির্ধারণ নীতির একটি সংস্কারযোগ্য ব্যাপার সেটা হচ্ছে যখন অর্থবিলটা দিয়ে নতুন প্রবিধান চালু করছি সেটা করছি আয় করের ক্ষেত্রে গত অর্থবছরের ওপরে। কারণ আপনি সামনে রিটার্ন দেবেন আমি যে নতুন কর আরোপ করলাম সেটার ভিত্তিতে। এটা কিন্তু আগের থেকে জানানো হয়নি। ভ্যাটের বেলায় এটা হয় না। কিন্তু আয়করের ক্ষেত্রে কিন্তু অতীতের নীতির ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে। এখানে সংস্কার প্রয়োজন। এটা না হলে প্রস্তুতি ঠিক মতো হয় না।
সঠিক আইন বা নিদের্শনা না হলে উদ্দেশ্য ঠিক থাকলেও তা বাস্তবায়ন হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত বছর ব্রোকারেজ হাউসের থ্রু দিয়ে ডিভিডেন্ড কাটার কথা বলা হয়েছিল। সেটা ঠিক যথার্থ ছিল না। পরে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
এজন্য এনবিআরের একটি ভালো রিসার্স সেল প্রয়োজন। নীতি প্রয়োগের আগে আরো গবেষণা দরকার। নামে মাত্র গবেষণা হয় এখন, কিন্তু তেমন কোনো কিছু হচ্ছে না। এটা একটা প্রায়োগিক গবেষণা দরকার।
যেমন বাড়িভাড়ার ব্যাপারে বলা হলো ভাড়া ২৫ হাজার টাকার বেশি হলে তাকে ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু এখানে ভালো হোমওয়ার্ক করা হয়নি। কারণ ধরেন বাড়ি ভাড়া ২৩ হাজার ও দুই হাজার- এভাবে ভেঙ্গে দেওয়া হলে কি করা হবে? সেটার কথা ভাবা হয়নি। ব্যাংক হিসাব খুললেই ঠিক মতো কর দেওয়া হবে কি না সে ব্যাপারে কিন্তু ভাবা দরকার ছিল।
প্রশ্ন : ডাবল ও ট্রিপল ট্যাক্সেসেশন নিয়ে কিছু বলেন।
মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন : প্রথমে আমি এনবিআরের রিসার্স সেল নিয়ে কিছু বলব। রিসার্স সেল দরকার। কিন্তু কাদের দিয়ে এটা করা হবে? এনবিআরের ভিতরের লোকদের দিয়ে যদি এটা করা হয় তবে পরিস্থিতি যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। এ জন্য এনবিআরের ভিরের লোকজন ও যাঁরা এখান থেকে অবসরে গেছেন –এদের মধ্যে থেকে কিছু নিতে হবে এবং যারা পাবলিক সেক্টরে কাজ করছে, যারা অভিজ্ঞ তাদের রাখতে হবে। তাহলে ভালো কিছু হতে পারে।
কর আনতে জোর করা যাবে না। মোটিভেট করে আনতে হবে। গ্রাহকবান্ধব হতে হবে এনবিআর কর্মকর্তাদের। এ জন্য দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.