এবার পানির দরে কোরবানির চামড়া কিনে নিতে চায় একশ্রেণির সিন্ডিকেট। এজন্য দেশীয় বাজারে চামড়ার দর ফেলতে নানা রকম পাঁয়তারা শুরু করেছে তারা।
সরকারকে ভুল তথ্য দিয়ে প্রভাবিত করারও চেষ্টা চলছে, যাতে বর্গফুটপ্রতি দর গত বছরের চেয়েও কম নির্ধারণ হয়। অথবা যাতে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ থেকেই সরকার সরে আসে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, প্রতি বছর কোরবানিতে প্রায় ৭০ লাখ পিস চামড়ার বেচাকেনা হয়। সারা বছর চামড়ার ভালো দর থাকলেও কোরবানির মৌসুমে এর ব্যত্যয় ঘটে। এ সময় সারা দেশে চামড়ার সরবরাহ বেশি হওয়ায় সিন্ডিকেট করে পরিকল্পিতভাবে দর কমিয়ে দেয় চামড়ার বড় তিনটি সংগঠন। সিন্ডিকেট সদস্যরা কারখানা, রেস্টুরেন্ট, বাসাবাড়ি কিংবা অ্যাসোসিয়েশন অফিসে গোপন বৈঠকও করে। সেসব বৈঠকেই চামড়ার দর ফেলার রূপরেখা ঠিক করা হয়।
গত বছর ব্যবসায়ীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দর ঢাকায় ৫০-৫৫ টাকা ও ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা নির্ধারণ হয়েছিল। এছাড়া প্রতি বর্গফুট মহিষের লবণযুক্ত চামড়ার দর ধরা হয়েছিল ৩৫-৪০ টাকা। আর দেশজুড়ে খাসির প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়া ২০-২২ টাকা ও বকরির চামড়া ১৫-১৭ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয়।
আর কিছুদিন বাদেই কোরবানির ঈদ। এর মধ্যেই সিন্ডিকেট সদস্যদের অনেকে বলছেন, এবার তারা চামড়া কিনবেন না। কিনলেও তা হবে পরিমাণে খুব কম। সাধারণ চামড়া ব্যবসায়ীরা এ ধরনের প্রচারণায় গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করছেন।
তাদের মতে, দর ফেলার উদ্দেশ্যেই এমনটি বলা হচ্ছে। দেখা যাবে, সিন্ডিকেট আড়ালে থাকলেও তারা দালাল-ফড়িয়া দিয়ে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে পানির দরে চামড়া কিনে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, সরকার কাউকে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট করতে দেবে না। কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তিনি জানান, আগেই চামড়ার মূল্য বেঁধে দেয়া হবে। ঈদের দিন থেকেই চামড়ার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করবে আইনশৃংখলা বাহিনী। সীমান্তেও কড়া নজরদারি থাকবে।
দর কমাতে ইতিমধ্যে একমত হয়েছে কথিত চামড়া সংশ্লিষ্ট তিন সংগঠন। তারা এক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার দরকে। বলছেন, গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার দরে অস্থিরতা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের চামড়ার বড় দুই বাজারের একটি হচ্ছে ইউরোপ, অপরটি চীন। এ সময় ইউরোপের ২৮টি দেশে ৪০ শতাংশ এবং চীনের বাজারে ৩০-৩৫ শতাংশের বেশি দরপতন ঘটেছে। কমে গেছে এসব বাজারের বড় বড় ব্র্যান্ড বায়ারদের কার্যাদেশও। ফলে গত বছর কোরবানিতে কেনা চামড়ার ৪৫ শতাংশ মজুদ এখনও পড়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুনভাবে চামড়া কিনে ঝুঁকির মুখে পড়তে চান না তারা।
অন্যদিকে ট্যানারি মালিকসহ বড় বেপারিদের কাছে সাধারণ চামড়া ব্যবসায়ীদের পাওনা কোটি কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে। সারা দেশে এর পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এ টাকা ঈদের আগে পরিশোধের সম্ভাবনা নেই। পুরনো হিসাব-নিকাশকেও এবার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে সিন্ডিকেট।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ ঠিক নয়। চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিই খারাপ। দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। এছাড়া ট্যানারি স্থানান্তরের ইস্যুটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এখানে প্রয়োজনীয় ব্যাংকঋণও মিলছে না। সাভারে বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। ফলে সদস্যরা এখন মূলধন সংকটে পড়েছে। সবকিছু বিবেচনা করেই এবার চামড়া কেনাবেচা হবে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, দেশে বিপুল মজুদ রয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোতে চাহিদা কমে গেছে। চীনেও একই অবস্থা। এসব বাজারে বড় দরপতন ঘটেছে। সে পরিস্থিতি মাথায় রেখেই আমাদের ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি আরও দাবি করেন, গত বছর ২ ডলার মূল্যের চামড়া এখন সোয়া ডলারে নেমে এসেছে। এছাড়া পাউন্ডপ্রতি চামড়ার মূল্যও কমেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা মেট্রোপলিটনের উপদেষ্টা মো. রবিউল আলম যুগান্তরকে বলেন, কোরবানি এলেই এ অপতৎপরতা শুরু হয়। এতে দেশের মূল্যবান চামড়া সম্পদের বড় ক্ষতি হবে। দেশের বাজারে এ অস্থিরতার সুযোগ নেবে বায়াররাও।
তিনি বলেন, অবশ্যই দাম বেঁধে দিতে হবে। এর সঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি থাকতে হবে। আবার ভারতের চেয়ে দেশের মূল্য বেশি থাকতে হবে। নতুবা চামড়া পাচারও ঠেকানো যাবে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.