সরকারের রাজস্ব আয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির বিষয়টি দুঃখজনক। অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাগজে-কলমে যে আয় দেখাচ্ছে, প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক রয়েছে। এর পেছনে নাকি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের যে ঘাটতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, সেটি আড়াল করার প্রবণতা কাজ করেছে। এটি মোটেই কাম্য নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, জাতীয় বাজেট প্রণীত হয় মূলত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার ওপর ভিত্তি করে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় নিশ্চিত করা না গেলে সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক এবং এর ফলে বাজেট বাস্তবায়নের ভারসাম্য রক্ষায় বিরূপ প্রভাব পড়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অভ্যন্তরীণ আয় কমে গেলে ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়। এতে চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেমন নষ্ট হয়, তেমনি জনদুর্ভোগের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
কথায় আছে, হিসাবের কৈ, যাবে কই? রাজস্ব আয়ের প্রকৃত পরিমাণ নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) তথ্যের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক গরমিল। সন্দেহ নেই, বছর শেষে ব্যর্থতা ঢাকতে এনবিআর কাগজে-কলমে রাজস্ব আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর মানসিকতা থেকেই কমিশনারদের পাঠানো তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই সেসব আমলে নিচ্ছে। উল্লেখ্য, অনেক কমিশনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও বেশি রাজস্ব আয়ের কৃতিত্ব নেন। এক্ষেত্রেও তেমনটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে বা সিজিএ তথ্যের সঙ্গে এনবিআরের রাজস্ব আয়ের তথ্যে গরমিল পরিলক্ষিত হচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশাল অংকের ঘাটতি বিদ্যমান থাকার পরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আয় বেশি হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এজন্য রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর মতো কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এনবিআরের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধরনের ছলচাতুরি অনাকাক্সিক্ষত। ব্যর্থতা যদি থাকে, তবে এর সঠিক মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করে তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা থাকা উচিত। দুর্ভাগ্যজনক, এনবিআরের কার্যক্রমে তা মোটেই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং বলা চলে, রাজস্ব আদায় নিয়ে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। বস্তুত অপরিকল্পিতভাবে রাজস্ব আদায়, সমন্বয়ের অভাব এবং শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা এজন্য দায়ী- এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না।
রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে সফল হতে চাইলে দেশে করবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। করবান্ধব পরিবেশ ছাড়া কাক্সিক্ষত রাজস্ব আয় সম্ভব নয়। তাছাড়া যারা কর আদায়ের সঙ্গে যুক্ত, তাদের মধ্যে যাতে হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ না করে, সেদিকে খেয়াল রাখাও কর্তব্য। কোনো কারণে ক্ষোভ বা হতাশা থাকলে তা প্রশমনের ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারের আয়ের মূল উৎস রাজস্ব আয়। বর্তমানে বৈদেশিক সহায়তা বা ঋণ কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকারের রাজস্বনির্ভরতা অনেকটাই বেড়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আদায়ে এনবিআরের ব্যর্থতা সরকারের সমগ্র বাজেট পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিতে পারে। কাজেই কোনো ছলচাতুরি বা কৌশলের আশ্রয় না নিয়ে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে যত্নবান হবে- এটাই প্রত্যাশা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.