হজযাত্রী পরিবহনে বিপর্যয়ে বিমান * টিকিটে ঘুষ, ডলার রেট ও চেকইনের কারণে বিমানে অতিরিক্ত লাগছে ১৬ হাজার টাকা * শেষ মুহূর্তে থার্ড ক্যারিয়ার নামানোর পাঁয়তারা
বিমান ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর টিকিট বাণিজ্য আর অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ১০ হাজারেরও বেশি হজযাত্রীর যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিল ও যাত্রী কম হওয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখেও পড়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার মন্ত্রীর আশ্বাসের পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি।
টিকিটে ঘুষ, ডলার রেট ও চেকইনের কারণে বিমানের হজযাত্রীদের অতিরিক্ত ১৬ হাজার টাকা ব্যয় হওয়ায় বেশিরভাগ যাত্রীই সৌদি এয়ারলাইন্সে যেতে আগ্রহী। এ অবস্থায় জেদ্দা এয়ারপোর্টে বিমানের নতুন শ্লট (উড়োজাহাজ ওঠানামার অনুমতি) বরাদ্দ না পেলে কোনো অবস্থাতেই তারা সিডিউল অনুযায়ী হজযাত্রী পরিবহন করতে পারবে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে তৃতীয় কোনো এয়ারলাইন্সকে হজযাত্রী পরিবহনে সম্পৃক্ত করার বিষয়েও পাঁয়তারা শুরু করেছে বিমান। যাত্রী স্বল্পতার কারণে এ পর্যন্ত বিমান ১২টি ও সৌদি এয়ারকে ১টি ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এ বছর জেদ্দা সিভিল এভিয়েশন থেকে বিমান যে ১১২টি শ্লট পেয়েছে, তা দিয়েই ৫৫ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে ১২টি ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় জেদ্দার নতুন শ্লট বরাদ্দ না পাওয়া পর্যন্ত বিমানের হজযাত্রী পরিবহনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিমান ইতিমধ্যেই নতুন শ্লট বরাদ্দের জন্য জেদ্দা সিভিল এভিয়েশনে আবেদনও করেছে। কিন্তু জেদ্দা সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, যেহেতু হজ মৌসুমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জেদ্দা বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণ করে সে কারণে এই সময়ে তাদের পক্ষে শ্লট বেশি দেয়াও সম্ভব হবে না।
বিমান কর্তৃপক্ষ উপর্যুপরি ফ্লাইট বাতিল ও যাত্রী সংকটের কারণে গত সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এজন্য বিমানের অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কিছু হজ এজেন্সির কারসাজিকে দায়ী করছে। বিমান ও হজ এজেন্সির একাধিক সূত্র জানায়, এবার হজযাত্রী বুকিং এবং কখন কী সংখ্যক যাত্রী দরকার, তা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী হজ এজেন্সির সঙ্গে বোঝাপড়ার কাজটি বিমান দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেনি। হয়েছে টিকিট বাণিজ্য। তার ওপর শুরুতেই বিপত্তি হয়েছে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ নিয়ে। বিমান শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ধরেছে ৮০ টাকা ৫০ পয়সা। আর সৌদি এয়ারলাইন্স ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের দর অনুযায়ী ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। এর ফলে বিমানের টিকিটের দাম প্রায় চার হাজার টাকা বেড়ে যায়। এছাড়া সৌদি আরবে যাত্রীপ্রতি ৫০ ডলার সিটি চেকইন চার্জ সৌদি এয়ার নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিমানের সঙ্গে সৌদি এয়ারের টিকিট মূল্যের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় আট হাজার টাকা। এ কারণে শুরুতে বিমানে বুকিং দিয়েও অনেক হজ এজেন্সি যাত্রী পাঠিয়েছে সৌদি এয়ারে। এতে যাত্রীপ্রতি তাদের বাড়তি লাভ আট হাজার টাকা।
এই দুর্নীতির কারণে সৌদি এয়ারের সঙ্গে শুরুতে বিমানের টিকিটের ব্যবধান দাঁড়ায় ১৬ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে শুধু ঘুষের কারণেই ব্যবধান বেড়েছে ৮ হাজার টাকা। এছাড়া ডলারের রেট ও সৌদি আরবে লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়ের কারণে বিমানকে আরও ৮ হাজার টাকা বেশি দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় প্রথমদিকে হজ এজেন্সিগুলো বিমানের পরিবর্তে সৌদি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে হজযাত্রী পাঠানো শুরু করে। অনেকে বিমানে বুকিং দিয়েও যাত্রী পাঠিয়েছে সৌদি এয়ারে। ফলে একের পর এক বিমানের হজ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাভেল এজেন্সির মালিকদের অভিযোগ বিমানের কাছ থেকেই ২ হাজার টাকা বেশি দিয়ে টিকিট ক্রয় করতে হয়েছে তাদের। লাভের আশায় তারা ওই দামের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা বেশি ধরে বাজারে ছেড়েছে। তাদের বক্তব্য যেহেতু বিমান ও সৌদি এয়ার ছাড়া আর কারও পক্ষে হজের টিকিট বিক্রির উপায় নেই, সে কারণে তারাও শুরু থেকে কম দামে টিকিট ছাড়েনি বাজারে।
মতিঝিল সেলস অফিসের একটি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এ বছর হজের টিকিট বিক্রিতে বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, টিকিটপ্রতি ২ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে এই সিন্ডিকেট অধিকাংশ হজের টিকিট বিক্রি করেছে। ৩০টি ট্রাভেল ও হজ এজেন্টের কাছে তারা এই টিকিট তুলে দিয়েছে। ট্রাভেল এজেন্টরা আরও ৫ হাজার টাকা বেশি যোগ করে বাজারে টিকিটের দাম হাঁকাচ্ছে। তাই হজযাত্রীদের বিমানের টিকিট ক্রয় করতে হয় ৭ হাজার টাকা বেশি অর্থাৎ ১ লাখ ২৮ হাজার ২৩১ টাকায়। অপরদিকে বিমান শুরুতে ডলারের বিনিময় হার ধরেছিল ৮০ টাকা ৫০ পয়সা। আর সৌদি এয়ারলাইন্স ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের দর অনুযায়ী ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। এ খাতে বিমানের টিকিটের দাম প্রায় চার হাজার টাকা বেড়ে যায়। এছাড়া সৌদি আরবে যাত্রীপ্রতি ৫০ ডলার সিটি চেকইন চার্জ সৌদি এয়ার নিচ্ছে না। এর ফলে সৌদি এয়ারের সঙ্গে বিমানের টিকিট মূল্যের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় আট হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ঘুষসহ বিমানের টিকিট মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। আর সৌদি এয়ারলাইন্স টিকিট বিক্রি করেছে ১ লাখ ২১ হাজার ২৩৪ টাকায়। দুই এয়ারলাইন্সের সঙ্গে ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ১৬ হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, বিমানের অদক্ষতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু এজেন্সি সিন্ডিকেট করে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যাতে শেষ মুহূর্তে আটকে পড়া যাত্রী পরিবহনের জন্য তৃতীয় কোনো এয়ারলাইন্সকে যুক্ত করা হয়। কারণ তাতে এজেন্সিগুলোর ব্যবসা আরও বাড়বে। একই সঙ্গে এরা অতিরিক্ত আরও ১০ হাজার হাজী পাঠানোর কোটা আদায়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, থার্ড ক্যারিয়ার নামাতে পারলে হজ এজেন্সিগুলো গড়ে ৭০ হাজার টাকায় হজযাত্রী পাঠাতে পারবে। এতে তাদের টিকিটপ্রতি লাভ হবে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হাবের সভাপতি ইব্রাহিম বাহার বলেন, ডলারের বিনিময় হার ও সিটি চেকইন চার্জের কারণে অনেকে সৌদি এয়ারলাইন্সে যাচ্ছেন। আবার অনেক হজযাত্রী বাড়িভাড়ার কাজ এখনও শেষ করতে পারেননি। অনেকে ভিসা পাননি। সব মিলিয়ে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। তারা আশা করছেন, কয়েক দিনের মধ্যে বিমানের যাত্রী সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানায়, চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ৭৫৮ জন হজে যাবেন। এর অর্ধেক বিমান ও অর্ধেক সৌদি এয়ারলাইন্স বহন করবে। সে অনুযায়ী, বিমান ৫২ হাজার যাত্রী বহনের জন্য আসন-সক্ষমতা তৈরি ও প্রয়োজনীয় স্লট (সৌদি আরবে ফ্লাইট অবতরণের অনুমতি লাগে, একটা স্লটের বিপরীতে একটা অবতরণ) বরাদ্দ পেয়েছে।
বিমান বলছে, ১২টি ফ্লাইট বাতিলের কারণে পাঁচ হাজার যাত্রী পরিবহনে ‘ক্যাপাসিটি’ খোয়া গেছে। অবস্থার আশু উন্নতি না হলে হজ পরিবহনে পরবর্তী পর্যায়ে মারাত্মক সংকট তৈরি হতে পারে। এ অবস্থায় বিমান কর্তৃপক্ষ এক বিজ্ঞপ্তিতে সব হজ এজেন্সিকে আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের আসন নিশ্চিতপূর্বক টিকিট সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, আজ থেকে আর কোনো বিপর্যয় হবে না। বিমানের কোনো ফ্লাইটও বাতিল করা হবে না। একই সঙ্গে ফ্লাইটে কোনো সিটও খালি যাবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয় বলেছে, হজযাত্রী পরিবহনে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলে তার দায়-দায়িত্ব হজ এজেন্সিকে নিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন বলেছেন, ভিসাপ্রাপ্ত হজযাত্রীদের তালিকা ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সিগুলোতে অবিলম্বে বিমানের টিকিট সংগ্রহ করে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে পাঠানোর অনুরোধ জানান।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.