মায়ের এক ধার দুধের দাম— কাটিয়া গায়ের চাম— পাপোস বানালেও ঋণের শোধ হবেনা, এমন দরদী ভবে কেউ হবেনা আমার মাগো… ‘দশমাস দশদিন তোর গর্ভে ধারন, কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন।’ মন্দ হোক আর ভালো হোক বাবা আমার বাবা! পৃথিবীতে বাবার মত আর আছে কে বা? এসব গান শুনে সকল সন্তানেরই মনেই তাদের মা-বাবার প্রতি চরম শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসে। এগুলো আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার কবি-সাহিত্যিক শিল্পীদের অভিব্যক্তি। তারা সুরে সুরে কথা সাহিত্যে আমাদের হৃদয়ের কথাগুলোই তুলে ধরেছেন। মা এবং বাবার ঋণ আসলেই শোধ করবার সাধ্য আমাদের নেই। মা কষ্ট করে সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখান। আর বাবা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করেন। কিভাবে সন্তানের ভালো হয় সে চিন্তায় মগ্ন থাকেন সারাক্ষণ। তার যেন ব্রত হয়ে দাঁড়ায় সন্তান ও সংসার কে সুখে রাখা। সন্তানের মুখ থেকে কথা বলা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, ইউনির্ভাসিটি, ভালো চাকরি, এমনকি সন্তানের জন্য ভালো জীবন সঙ্গী খুঁজে বের করার দ্বায়িত্ব যেনো বাবা মার। তারা জীবনের সমস্ত রক্তবিন্দু ঢেলে সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তারা তাদের জীবনের সকল অপরিপূর্ণতা বাস্তবায়ন করে তোলার চেষ্টা করেন সন্তানের মধ্য দিয়ে। হয়ত বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবার, কিন্তু সময়ের কষাঘাতে তিনি ডাক্তার হতে পারেননি! কিংবা মায়ের স্বপ্ন ছিল একজন অধ্যাপিকা হওয়ার, সময়ের যাতাকলে পিষ্ঠ হয়েছে তার আশা! বাবা মা তাদের সেই অসম্পুর্ণ স্বপ্নগুলোকে পরিপূর্ণতায় রুপ দিতে চান সন্তানদের মধ্যে। তারা বলেন আমি যা করতে পারিনি এখন তা করবে আমার সন্তান। আমার স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়ন ঘটাবো সন্তানের মধ্যে। বাবা মা যদি তার ছেলে মেয়ের মেধা অনুসারে তাকে পড়ায়, তাহলে কিন্তু সন্তান আশানুরুপ ফল লাভ করবে। সন্তান তার মেধাকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে। জোর করে কোনও বিষয়ে ভর্তি করে দেন না। আমাদের দেশে এখনও দেখা যায় বাচ্চারা খেতে না চাইলে জোর করে মেরে ধরে বাচ্চাকে গেলানো হয়! অথচ অভিভাবকের এই অতিরিক্ত ভালোবাসা সন্তানের জন্য ভালোর চেয়ে খারাপ করার আশঙ্কাই বেশি সৃষ্টি করে। বাবা মা কতো শখ করে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেন। ছেলের জন্য বউ! আর মেয়ের জন্য বর! বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের জন্য বাবা মায়ের অনেক দুঃশ্চিন্তা। আমাদের সমাজে অবশ্য মেয়েদেরকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়না। মেয়ে মানুষ বলে বলে মূল্যায়িত হয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে মেয়ে মানুষের কোনও নিরাপত্তা নেই। নিজের ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কর্মস্থল, রাস্তাঘাট, কোনও যানবাহনস্থলে এমনকি নিজের স্বামীর ঘরেও মেয়েদের কোনও নিরাপত্তা নেই। মেয়েরা জন্ম নিয়েছে পরগাছা হয়ে। বিয়ের আগে বাবার ঘাড়ে আর বিয়ের পরে স্বামীর ঘাড়ে পরগাছা। পরগাছা জীবন নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা বয়ে বেড়ানো। হায়রে নিয়তি! মেয়েদের বিয়ের পর নিজের বংশপদবী বাদ দিয়ে স্বামীর বংশপদবী বহন করাটা এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের ঘর ছেড়ে স্বামীর ঘরকে আপন করে নিতে হয়। স্বামীর সংসারে শ্বশুর, শ্বাশুড়ী, ননদ, ভাসুড় আরো অনেকের দ্বায়িত্ব কাধে নিতে হয়। সেসব খবর কিন্তু বউকেই রাখতে হয়। স্বামীরা তার শ্বশুড় শ্বাশুড়ী ওষুধ খাওয়ার খবর নেয়ার কথা দূরে থাক! তারা কেমন আছে সে খবরটা তারা ঠিকমত নেয় কি না তা তে আমার সন্দেহ আছে। মাঝে মাঝে করুনা হয় মেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার জন্য। মেয়ে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়াটা যেন অপরাধ! এ অপরাধে কেনো অপরাধী হলাম? মেয়ে বড় হলে বাবা মা যত্ন করে বিদেশ ফেরত পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চান। সবার কথা বলছি না, কিন্তু অনেকেই এমনটা করেন। আর এই অনেকের সংখ্যা বাংলাদেশে প্রায় ৭০ শতাংশ। বাবা তার মেয়ে নামক বোঝাটা বিদেশ ফেরত পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে চেষ্টা করেন। অভাব অনটনের বাইরে মেয়ের সুখ-স্বাচ্ছন্দ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারার কথা ভেবে স্বস্তি অনুভব করেন। বাবা মারা তার মেয়েদেরকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করিয়ে কন্যাদান করেন বিদেশ ফেরত কোনও পাত্রের হাতে। বাবা মা হয়ত জানতেও চায়না ছেলেটি দেখতে কেমন? বয়স কত? পড়ালেখা কদ্দুর? অথবা তার মেয়ের মনের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারবে কি না? মেয়েদের আবার মন কিসের? মেয়েমানুষ বলে কথা। বিদেশ ফেরত ছেলের টাকা আছে, টাকাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। বিদেশ ফেরত পাত্রের সে কি ডিমান্ড পাত্রী সুন্দরী হতে হবে, লম্বা হতে হবে, শিক্ষিত হতে হবে, ভার্জিন হতে হবে আরো কি বাহানা? আর বাবা মায়েরা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করার জন্য মেয়েদের সুপাত্রে কন্যাদান করেন। কিন্তু আসলেই কি বাবা মা তাদের মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছেন? তবে প্রবাসে এত কষ্টের পাহাড় দেখে আজ বাধ্য হচ্ছি তাদের জানান দিতে চোখ খোলো একবার, একবিংশ শতাব্দীতে আমরা। থেমে থাকার সময় নেই আর! বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা কোনও অংশেই ছোট কিংবা খাট নয়। তারা পুরুষের চেয়ে কোনও অংশেই খাটো নয়। মেয়েরা তার মেধা কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সব জায়গায় যায়গা করে নিয়েছে। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের মেধার জোড় বেশী চিকিৎসাবিদ্যা তাই বলে। ছেলেদের মস্তিষ্কের কেবল ডানভাগ কাজ করে! আর মেয়েদের মস্তিষ্কের ডানদিক বামদিক উভয়দিকই সমানভাবে কাজ করে। এই মেধাকে বাচানোর দায়িত্ব বাবা মায়ের। বাবা মা ভালোবাসার ফসলদের বাঁচানোর দ্বায়িত্ব কিন্তু বাবা মায়েরি। সন্তান ছেলে হোক আর মেয়ে হোক তার মেধা বিকাশের সুযোগ দেয়া উচিৎ। আমি অনেক পরিবার কে দেখেছি অনেক ছেলে সন্তান থাকার পরেও বাবা মাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। ঠিকমত দু বেলা দু মুঠো খাবার খেতে পারেনা, অথচ ছেলেদেরকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শিক্ষিত করে তুলেছে। আজ তারা মস্ত অফিসার। বিয়ে করে বাবা মাকে গেছে ভুলে। অথচ যে মেয়েকে পড়াশোনা করায়নি সে মেয়ে এ বাড়ী ও বাড়ী কাজ করে বৃদ্ধা বাবা মা কে খাওয়াচ্ছে। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি মেয়ে যদি মস্ত অফিসার হত বাবা মা কে ফেলে দিতনা। একটু ভেবে দেখ বাবা মা তোমরা কি ঠিক করছ ছেলে মেয়েদের মাঝে বিভেদ গড়ে? একবার ভেবে দেখ ক্ষতি কার বেশী হচ্ছে? বাবা মায়ের দেয়া সেই টাকাওয়ালা প্রবাসী স্বামীকে বিয়ে করে কতজন সুখে আছে আমি তা জানিনা। বিয়ের পর স্বামী প্রবাসে আর স্ত্রী নামক বস্তুটি স্বামীর অপেক্ষায় শ্বশূর শ্বাশুড়ীর সংসারে কলুর বলদ। স্ত্রী নামক বস্তুটি নিজের সুখ দুঃখের কথা বলতে ভূলে যায়, নিজের দুঃখের কথা বলতে না পেরে এক সময় সে হয়ে যায় রোগী। তখন তার ছুটতে হয় ডাক্তারের দুয়ারে দুয়ারে! হায়রে মেয়ে মানুষের জীবন। ডাক্তার আবিষ্কার করে স্ত্রীর আসলে কোনও রোগ নেই। স্বামীর সান্নিধ্য দরকার স্ত্রীর। বাবা মায়ের সংসার ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে খাঁপ খাইয়ে নেয়াটাও অনেক কঠিন। স্বামীরা তা কোনদিনই বোঝে না। বিয়ের আগেও বাবার ঘরে বিয়ের পরেও বাবার ঘরে। তার কোনও পরিবর্তন বুঝতে হয়না। কিন্তু একটা স্ত্রী’র জন্য আসলেই তা কঠিন। আর স্বামী তার সবচেয়ে কাছের হয়। বিয়ের ১ থেকে ২ মাস পরে প্রবাসে স্বামীদের চলে আসতে হয় বাধ্য হয়ে। আর সেটা এক নববধুর জন্য কত যে কষ্টকর, সেটা শুধু সেই বোঝে। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর গোনা। বছরের পর বছর স্বামীর জন্য প্রতীক্ষার প্রহর। স্ত্রীর অসুস্থতাও বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। এরপর স্বামী নামক রোবটটি ফিরে আসে তার নববধুর কাছে। সময়ের দৈনতার কাছে হার মানতে হয় স্বামীকেও। সময় হয়েছে চলে যাওয়ার। জীবন এবং জীবিকার টানে ছুটে আসতে হয় প্রবাসে। আবার শুরু হয় বিরহের দিনগোনা। এই জ্বালা আর প্রাণে সহেনা! এভাবেই চলতে থাকে। এরপর থেকে শুরু হতে থাকে পরকিয়া। যৌবনের তেজস্ক্রিয়তায় লিপ্ত হচ্ছে পরকিয়ায়। আর এই পরকিয়া পুড়িয়ে দিচ্ছে সাজানো সংসার। আর এই পরকিয়ার তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে একটি সমাজ একটি সংসার। দূষিত হচ্ছে সমাজ। এসবের জন্য আমরা আসলে কাকে দোষারোপ করব? পরিস্থিতি না পরকিয়াকারীকে? বিয়ের পর শতকরা ৮০ ভাগ পুরুষ স্ত্রী কে নিয়ে আসেন প্রবাসে। তারপরও কি তারা সুখী? প্রবাসে আসার পর ঘটে আরেক সমস্যা। ভাষা না জানার সমস্যা, স্বামীকে পাশে না পাবার হতাশা। একবুক আশা নিয়ে একটি স্ত্রী তার স্বামীর কাছে আসে। তারপর কি হয়? জীবিকার টানে স্বামী নামক রোবটটিকে থাকতে হয় সারাদিন কাজে। স্ত্রী কে সময় দেওয়ার মত সময়ও তার হাতে থাকেনা। অনেক রাতে বাসায় এসে খেয়ে ঘুমাতে যায়। কারন ভোরে উঠে আবার দৌঁড়াতে হবে জীবিকার উদ্দেশে। স্ত্রী দেয়ার মতো সময় কই? এভাবে একের পর এক আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হতে থাকে স্ত্রীর স্বপ্ন। এখানে ভাষা না জানার কারনে দুঃখের কথা কাউকে বলতেও পারেনা। জমতে থাকে দুঃখের পাহাড়। রান্না আর টেলিভিশন দেখে সময় যেনও আর কাটতে চায়না। তখন ভাবতে থাকে দেশে ছিলাম বেশ ভালো ছিলাম। আবার শুরু হয় উত্তাপ দেশে চলে যাওয়ার! তখন স্বামী বলে এত টাকা পয়সা খরচ করে এখানে এনেছি কেন যাবা এখন? মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করো বউ সোনা! স্বামীর দুঃখের কথা চিন্তা করে স্ত্রী আর এ পথ মারায় না। শত কষ্ট মেনে নিয়ে স্বামীর সাথে থাকতে শুরু করে। আর স্বামী গোবেচারা বলে আমাদের একটা ঘরতো খালি আছে ভাড়া দিয়ে দেই? তাতে করে আর একটু পয়সা বাঁচে। তাতেও তারা ক্ষ্যান্ত নন, তাদের চাহিদার শেষ নেই বললেই চলে। দানব স্বামী কত রস করে বলে ওগো আর একটু কষ্ট করোনা? তুমি একটু কষ্ট করে রান্না করবে? দুই জনের জন্য রান্না আর ছয় জনের রান্না করা একই, পরিমানটা একটু বেশী দিতে হবে। আর তা বাবদ আরো কিছু ইনকাম হবে। হায়রে মেয়ে মানুষের জীবন! তারপর ঘরে আসে ব্যাচেলর আর তখন সেটাও মেনে নেয় বেচারী স্ত্রী। উন্নত মানের দাসী হিসেবে রুপান্তরিত হতে থাকে বউ নামক বস্তুটি। দিনের পর দিন স্ত্রী’র সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হতে থাকে। শুধু তাই নয় সেই ব্যাচেলরদের সাথে কথা বলাও পছন্দ করেনা স্বামীরা। স্বামীর অবর্তমানে কথা বলা যাবেনা। আর কোনও কারনবশত যদি কথা বলে তাহলে শুরু হয় সন্দেহের পর্ব। এরপর থেকে শুরু হতে থাকে মনোমালিন্য একসময় ডিভোর্স। আর এই সমস্ত মেয়েরা ডিভোর্সের পর হয়ে পরে অসহায়। এরকম অবস্থার জন্য আমরা আসলে কাকে দায়ী করব? এই সমাজ নাকি পরিবারকে? এরকম অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিৎ। আমাদের সমাজের উচিৎ তাদের পাশে এসে দাঁড়ানো। তাদেরকে কাছে টেনে ভুল ধরিয়ে দেয়া। এতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটবেনা। কারন তারা আমাদের সমাজের অবহেলা পেয়ে তারা শরণাপন্ন হচ্ছে ভীনদেশী সংস্কৃতির দিকে। ভালো থাকার বৃথা চেষ্টায় ভুলে যাচ্ছে ধর্মের কথা। নিজের দেশ এবং সমাজ কে উপস্থাপন করছে নোংরাভাবে যা আমাদের কাম্য নয়। [লেখক: ইতালির ভেনিস ইমিগ্রেশন অফিসে কর্মরত]
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.