নরসিংদী সদর, শিবপুর, পলাশ, মনোহরদী , রায়পুরা ও বেলাব উপজেলা এই ৬টি উপজেলা নিয়ে নরসিংদী জেলা। ১৯৭৮ সালে নরসিংদী মহকুমা এবং ১৯৮৪ সালে নরসিংদীকে একটি পূর্ণাঙ্গ জেলায় পরিণত করা হয়। দক্ষিন পূর্বাঞ্চল মেঘনা বিধৌত নিম্নভূমি, পশ্চিমাঞ্চল উচ্চ সমতল ভূমি, উত্তরাঞ্চলে ছোট ছোট পাহাড়, টিলা, টেক নয়নাভিরাম অরণ্য আবরণে আবৃত। এ জেলার উত্তরাঞ্চলে পাহাড়ি ভূমি বাংলাদেশের আদি ভুমির অন্তর্গত।
এ জেলার আদি ভূমিতে অবস্থিত বেলাব উপজেলার ‘ওয়ারী বটেশ্বর’ গ্রামে পরিত্যক্ত ভিটা ও অসমরাজার গড়’ আবিস্কৃত হয়েছে, যা নব্য প্রস্তর যুগীয় সভ্যতার নিদর্শন । ওয়ারীতে খৃষ্টপূর্বকালের ছাপাঙ্কিত পর্যাপ্ত রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। এসব মুদ্রা নরসিংদী অঞ্চলের আদি সভ্যতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার ‘জয়মঙ্গল’ নামে পাহাড়ী গ্রামে আবিস্কৃত হয়েছে গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রা। একই উপজেলার আশ্রাফপুরে আবিস্কৃত হয়েছে সপ্তম শতাব্দীর মহারাজা দেব খড়গের তাম্রলিপি এবং অষ্টধাতুর নির্মিত বৌদ্ধ নিবেদন স্ত্তপ। এই আশ্রাফপুরেই আবিস্কৃত হয়েছে গৌড়ের স্বাধীন নরপতি আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পুত্র সুলতান নাসির উদ্দিন নসরৎ শাহের রাজত্বকালে নির্মিত একটি অতি প্রাচীন মসজিদ। পলাশ উপজেলার পারুলিয়া গ্রামে আনুমানিক ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে দেওয়ান শরীফ ও তার স্ত্রী জয়নব বিবি নির্মিত মোগল স্থাপত্যরীতির একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। এ অঞ্চলের জনসাধারণের আধ্যাতিক ও নৈতিক জীবনে যাঁদের প্রভাব আলোকবর্তিকারূপে কাজ করেছে সে সব পীর আউলিয়াদের পবিত্র মাজার শরীফ রয়েছে। নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের অনতিদুরে পশ্চিমদিকে তরোয়া গ্রামে হযরত কাবুল শাহের মাজার, কুমরাদী গ্রামে হযরত শাহ মনসুরের মাজার, পাটুলী ইউনিয়নের হযরত শাহ ইরানী মাজার, ওয়ারী গ্রামে হযরত সোলায়মানের মাজার, এবং পারুলিয়া দেওয়ান সাহেবের মাজার বিশেষভাবে উলেখযোগ্য।
নরসিংদী জেলার একটি বিশেষ এবং উলেখযোগ্য ঐতিহ্য হচ্ছে তাঁত শিল্প। ‘প্রাচ্যের ম্যানচেষ্টার’ বলে খ্যাত শেখেরচর (বাবুরহাট) এ জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের তাঁত বস্ত্রের চাহিদার প্রায় সিংহভাগ পূরণ করছে এ জেলার তাঁত শিল্প। শিক্ষা-সাহিত্য, ও সংস্কৃতি জগতে যারা্ আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করে নরসিংদীকে ঐতিহ্যমন্ডিত করেছেন তাঁরা হলেন উপমহাদেশের প্রথম বাঙালি আই সি এস স্যার কে, জি, গুপ্ত, পবিত্র কোরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশ চনদ্র সেন। অন্যদের মাঝে যাঁরা চিরকস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁরা হচ্ছেন বিখ্যাত কবিয়াল হরিচরণ আচার্য, যিনি ‘কবিগুণাকর’’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, মৌলভী সেকান্দর আলী, কবি দ্বিজদাস, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল-আজাদ এ জেলার গর্ব। আব্দুল মোমেন খান(প্রাক্তন খাদ্য মন্ত্রী) আহমদুল কবির মনু মিয়া(সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ) প্রমূখ নরসিংদী জেলারই কৃতি সন্তান।
মহান মুক্তিযুদ্ধেও গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিতেও নরসিংদীর ঐতিহ্য রয়েছে। যাঁর বুকের তাজা রক্ত মুক্তি পাগল জনতার মিছিলকে বেগবান করে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে নিয়েছিল সেই উনসত্তরের গণ আন্দোলনের শহীদ ‘আসাদ’ এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ট ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান এ জেলারই সন্তান। কলা, কাঁকরোল, শশা, সিম,বেগুন ,ধান, পাট, আলু ও লটকন উৎপাদনে উলেখযোগ্য নরসিংদী বাংলাদেশের একটি অন্যতম কৃষি সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.