বন্ধু হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’–এর মাঝখানের একটি সত্তা, বলেছিলেন ফ্রেডরিখ নিৎসে। দুনিয়াজুড়ে কবি-লেখক-শিল্পীদের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে বিচিত্র কাহিনি। সেসব কাহিনির কোনোটা মনোহর, কোনোটা-বা শেষ হয়েছে তিক্ততায়। তবে সবকিছুর পরে বন্ধুত্ব প্রাণে পরশই দেয় বটে
‘শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়’—রবীন্দ্রনাথ শুধু বাণীতে সন্তুষ্ট থাকতে চাননি, প্রাণে তাঁর পরশও চেয়েছেন। একটা সময় ছিল সানন্দে, সগর্বে বন্ধুর কথা বলা যেত। তারপর কী যে হলো, বেশ জোর দিয়ে বন্ধুর দাবি যিনিই করুন, নারী বা পুরুষ—আমরা কিছুটা সন্দিহান হয়ে উঠি। একালের বন্ধুত্বের যে ব্যাখ্যাই থাক না কেন, সেকালের অন্তত ১০ জন শ্রেষ্ঠ মানুষ বন্ধুত্বের গুরুত্ব ও মহিমা প্রচার করেছেন এবং বলেছেন, হীনম্মন্য মানুষের জন্য বন্ধুত্ব নয়। তাঁরা হলেন হোমার, সোপোক্লেস, হেরোডোটাস, হিপ্পোক্র্যাটস, অ্যারিস্টোফেনস, ইউরিপিডেস, সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিড। সৃজনশীল মানুষের বন্ধুত্বের কাহিনি শতসহস্র বছরের দূরত্ব ডিঙিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়। রোমান লেখক প্লিনি দ্য এন্ডার (মূল নাম গাইয়াস প্লিনিয়াস সেকান্দার) তাঁর লেখকবন্ধুর জন্য আক্ষরিক অর্থেই জীবন দিয়েছেন। তাঁর জন্ম ২৩ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ২৫ আগস্ট ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। রোমান লেখক এবং প্লিনির নারী বন্ধু রেকটিনার একটি বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছে: বিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং লাভাক্ষরণ শুরু হয়েছে, রেকটিনা ও পম্পোনিয়াসকে উদ্ধার করতে হবে।
প্লিনি যখন তাঁদের উদ্ধার করতে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছান, বিসুবিয়াসের অগ্নিক্ষরণ শুরু হয়। তাঁর নৌকার মাঝিরা তাঁকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্লিনির মুখ থেকে বের হলো সেই ঐতিহাসিক জবাব, ‘ফরচুন ফ্যাভার্স দ্য ব্রেভ’। তীরে নেমে তিনি পম্পোনিয়াসকে আলিঙ্গন করলেন, কিন্তু কোথাও রেকটিনাকে পেলেন না। আবার অগ্ন্যুৎপাত শুরু হলো। তিন দিন পর আগ্নেয়গিরি শান্ত হলে দেখা গেল জমাট লাভার মাঝখানে প্লিনি দ্য এন্ডার বসে আছেন, এতটুকু ক্ষতও তাঁর দেহে নেই। কিন্তু তিনি নিষ্প্রাণ। বিসুবিয়াস পম্পেই ও হারকুলিয়াম নগর দুটিকে ধ্বংস করে দেয়। রেকটিনারও কোনো হদিস মেলেনি। কোনো সন্দহ নেই, প্লিনি দ্য এল্ডার এবং রেকটিনার বন্ধুত্ব ধ্রুপদ ধরনের। পরবর্তীকালের গবেষকেরা দুজনের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেননি। খ্রিষ্টজন্মের শতবর্ষ আগের বিখ্যাত লেখক মার্কাস সিসেরো বন্ধুত্ব নিয়ে তাঁর বিখ্যাত অভিসন্দর্ভ De Amicitia তাঁর বন্ধু টাইটাস পম্পিনাস এট্টিমাসকে উৎসর্গ করেন। টাইটাস ও সিসেরোর মধ্যে বহুসংখ্যক পত্রবিনিময় হয়েছে এবং তা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। সিসেরো দর্শন, আইন, রাষ্ট্রনীতি, প্রশাসন, সাহিত্য—প্রায় সব বিষয়েই লিখেছেন। বেন জনসন ও উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের চরিত্র হয়ে উঠেছেন মার্কাস সিসেরো। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও সিসেরোর পথ ধরে বন্ধুত্বের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকের বিশ্লেষণ করেছেন সেইন্ট অগাস্টাস (৩৪৫-৪৩০), সেইন্ট থোমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭৪), আল গাজ্জালি (১০৫৮-১১১১), ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬)।
ফ্রেডরিখ নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০) বলেছেন, বন্ধু হচ্ছে ‘আমি’ এবং ‘আমাকে’–এর মাঝখানের একটি সত্তা—সত্যিকার বন্ধুই হতে পারে শ্রেষ্ঠ শত্রু। নিৎসের থিসিস এগিয়ে দিয়েছেন জ্যাক দেরিদা, তাঁর অভিসন্দর্ভের নাম দ্য পলিটিকস অব ফ্রেন্ডশিপ, বন্ধুত্বের রাজনীতি। ‘ও মাই ফ্রেন্ড, দেয়ার ইজ নো ফ্রেন্ড’ এই বক্তব্য সামনে রেখে দেরিদা বন্ধুত্বের রাজনীতি বিশ্লেষণ করেছেন। বন্ধু কেন? খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে প্লেটো লিখিত ক্রাইসিস অব ফ্রেন্ডশিপ-এর খানিকটা উদ্ধৃতি বন্ধুত্বের ভেতরকাঠামো বুঝতে সাহায্য করবে। অসুস্থ মানুষ ও চিকিৎসক বন্ধু। তাই নয় কি? হ্যাঁ, অসুখের কারণে তিনি চিকিৎসকের বন্ধু, স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য।হ্যাঁ। অসুখ তাহলে খারাপ। অবশ্যই। আর স্বাস্থ্য? এটা কি মন্দ না ভালো, নাকি কোনোটাই নয়? ভালো। শরীর অসুস্থ হলে ওষুধ বন্ধু। যেহেতু স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে, স্বাস্থ্যের কারণে ওষুধ বন্ধুত্বের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তা সত্যিই। স্বাস্থ্য কি বন্ধু, না বন্ধু নয়? বন্ধু। আর অসুখ শত্রু? হ্যাঁ। যা ভালোও নয়, মন্দ নয়, তা ভালোর বন্ধু মন্দের কারণে…! স্পষ্টতই একজন বন্ধু বন্ধুত্বের জন্য বন্ধু, নতুবা শত্রু হয়ে পড়তে পারত। সুতরাং শত্রু ঠেকাতে বন্ধু। মার্টিন থ্যাঙ্কিসের একটি উপন্যাসের নাম দ্য এনিমিস এনিমি—শত্রুর শত্রু সুতরাং বন্ধু। দ্য এপিক অব নিলগামেশ-এ গিলগামেশ ও এনকিদুর বন্ধু, ওরেস্টেস ও পাইলেডস-এর বন্ধুত্ব, ভার্জিলের রচনা ‘ইউরিয়ালাস’ এবং নিসাসের বন্ধুত্ব—এসব নিয়েই তো সাহিত্যের সূচনা। সিসেরো বিশ্বাস করতেন বন্ধুত্বের মাহাত্ম্যে এবং মনে করতেন, বন্ধুত্ব যাদের মধ্যে, তাদের জন্য অপরিহার্য শর্ত সততা ও সত্যবাদিতা। জেনোফোন সুন্দরী দেহপসারিণীর প্রতি সক্রেটিসের বন্ধুত্ববিষয়ক পরামর্শ লিখে রেখেছেন। থিওজেট নামের এই সুন্দরীকে সক্রেটিস ও তাঁর বন্ধুরা দেখতে পেলেন। থিওজেট যখন জানতে চাইলেন, তাঁরা তাঁর রূপ দেখলে আর গুণমুগ্ধ হলে তাঁর কী লাভ? সক্রেটিস বললেন, লাভ হচ্ছে বন্ধুপ্রাপ্তি। সক্রেটিস বললেন, তাঁকে একজন এজেন্ট নিয়োগ করতে হবে, যিনি তাঁর সান্নিধ্যপ্রার্থী ধনীদের আগমনের পথ করে দেবেন। থিওজেট তাঁর শরীরী সৌন্দর্য ও অন্তর দিয়ে তাঁদের কবজা করবেন। কিন্তু থিওজেট তখনই শুয়ে পড়তে রাজি হবেন না। খদ্দেরের আকাঙ্ক্ষা যখন তুঙ্গে, সঠিকভাবে দরাদরি করে তিনি তাঁকে তৃপ্তি দিতে সম্মত হবেন। থিওজেট প্রস্তাব করলেন, তাহলে সক্রেটিস, আপনিই আমার ব্যবসায়ে অংশীদার হোন। সক্রেটিস বলেছেন, যেভাবে তাঁর জ্ঞানপিপাসু শিষ্যরা নিয়মিত তাঁর কাছে ভিড় জমায়, থিওজেট যদি তা করতে রাজি থাকেন, তাহলে তিনি তাঁর বন্ধু ও ব্যবসায়ের অংশীদার হতে সম্মত থাকবেন। বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই দেহে এক মন! লেখকদের প্রত্যাশা একটু বেশিই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখক ও শিল্পীদের বন্ধুত্বের কিছু খতিয়ান বক্স আকারে এ লেখার সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু লেখক–শিল্পীদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দেওয়া যাক: আরও যত বন্ধুত্ব বিট প্রজন্মের দুই প্রধান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ও জ্যাক ক্যারুয়াকের সখ্য বন্ধুত্বের বাঁধাধরা সীমানা যেন ডিঙিয়ে গেছে। জ্যাক ক্যারুয়াকের অকালমৃত্যু ব্যথিত করে গিনসবার্গকে। তাঁদের সমলিঙ্গ সম্পর্ক একসময় রগরগে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল সাহিত্যবিশ্বে। এ ছাড়া আরও যেসব শিল্পী-সাহিত্যিকের জোড় বন্ধুত্বের সৌরভ ছড়িয়ে সাহিত্যাঙ্গনকে মাতিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শার্লট ব্রন্টি ও এলিজাবেথ গাসকেল; জে আর আর টেলেকিচ এবং সিএস লিউইস; রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন ও লুইমা মে অলকট; হারমান মেলভিল এবং ন্যাথানেল হথর্ন; ক্রিস্টোফার আইশারহুড ও ডব্লিউ এইচ আডন; গুন্টার গ্রাস এবং জন আরভিং; রালফ ওয়াল্ডো এমার্সন ও হেনরি ডেভিড থোরিও; আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং স্কট ফিউজেরাল্ড; মার্টিন এমিস ও ক্রিস্টোফার হিচেন; টি এস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ; টনি মরিসন এবং অ্যাজিলা ডেভিস; পল ভ্যালেরি ও আঁতুর ব্যাঁবো; হেনরি মিলার এবং লরেন্স ভারেল; ভ্লাদিমির নবোকভ, এডমুন্ড উইলসন নরম্যান নেইমার ও জ্যাক অ্যাবট, ভিক্টর হুগোর সঙ্গে পিয়ানোবাদক ফ্রানৎস লিজ, ফ্রানৎস কাফকা ও ম্যাক্সেব্রড (৭৫ বছরের বন্ধুত্ব!)—কত নাম লেখা যাবে এভাবে!
অন্যদিকে ভালো বন্ধু বিষাক্ত-টক্সিক ফ্রেন্ড হয়ে গেছে এমন নজিরেরও ঘাটতি নেই। যেমন ঘটেছে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও মারিও ভার্গাস য়োসার বেলায়। বন্ধুত্বের দুটি ধ্রুপিদ তত্ত্ব আছে। তত্ত্ব দুটি হলো—উপযোগিতাভিত্তিক ও আনন্দভিত্তিক। শেষ পর্যন্ত দুটোরই মিশেল দরকার। বন্ধুত্ব নিয়ে ঈষৎ লঘু একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই লেখাটি, ‘বন্ধুরা হচ্ছে অন্তর্বাসের মতো, আপনার হৃদয়ের যেমন কাছে, তেমনি চাপ দিয়ে ধরেও রাখে’। বন্ধুত্ব নিয়ে অপরূপ এই উদ্ধৃতিটি কার, সেটি অজানা। তবে উদ্ধৃতিটি যেন প্রকাশ করে বন্ধুত্বের মূল কথাটুকুই।
বাংলা সাহিত্যে বন্ধুত্ব বাংলা সাহিত্যেও মাইকেল-বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব নিয়ে রয়েছে অনেক কাণ্ড-কীর্তি। একদা কলকাতা মাতিয়ে রেখেছিল এই দুই কবির বন্ধুত্ব। লেখক-শিল্পীদের বন্ধুত্বের নানা কাহিনি আছে বাংলাদেশেও। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে সৈয়দ শামসুল হক-কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব টিকে ছিল দীর্ঘদিন। আবার ষাটের দশকে এসে আবুল হাসান-নির্মলেন্দু গুেণ-মহাদেব সাহা—এই তিন কবির উন্মাতাল বন্ধুত্বময় জীবনের বিচিত্র কাহিনি কতই না মনকাড়া! এভাবেও বলা যায়, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্য–সংস্কৃতি যেভাবে গড়ে উঠেছে, এর পেছনে লেখক-লেখক ও লেখক-শিল্পীদের বন্ধুত্বের অবদান কম নয়।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও গারট্রুড স্টেইন তরুণ হেমিংওয়ের ভাষায় যে প্যারিস সব সময়ই ‘আ মুভেবন ফিস্ট’, ১৯২০-এর দশকে সেই প্যারিসে গারট্রুড স্টেইন হলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’। অর্থসাহায্য থেকে শুরু করে হেমিংওয়ে দম্পতিকে প্রবাসজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য তিনি সাগ্রহে এগিয়ে এসেছেন, প্যারিসের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী মহলে তাঁকে পরিচিত করিয়েছেন। প্যারিসে লেখালেখির জগতে কেমন করে এগোতে হবে এবং এমনকি কেমন হতে হবে যৌনজীবন, হেমিংওয়েকে দিয়েছেন সে তালিমও। ১৯২৪-এ হেমিংওয়ে যখন হ্যাডলেকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন, তিনি গারট্রুড ও তাঁর নারীসঙ্গী এলিস টোকলাসকে তাঁর ‘গডপ্যারেন্টস’ হতে বললে তাঁরা সানন্দে রাজি হন এবং নবদম্পতির প্রতি তাঁদের সব দায়িত্ব পালন করেন। লেসবিয়ান গারট্রুড স্টেইন ছিলেন প্যারিসের সবচেয়ে পরিচিত বিত্তশালী নারী। হেমিংওয়ে গারট্রুডের লেসবিয়ান সম্পর্ককে খোঁচা দিয়ে লিখলেন, এলিসের স্বামী হচ্ছে গারট্রুড। হেমিংওয়ে তাঁর মেন্টরদের অনেকের প্রতিই সুবিচার করেননি। তেমনি অবিচারের স্বীকার হয়েছেন গারট্রুড। পরে গারট্রুডকে তাঁর মনে হয়েছে ‘বোরিং’।
লর্ড বায়রন ও মেরি শেলি বায়রনের সাবেক মিসট্রেস ক্লেয়ার ক্লেয়ারমন্ট শেলির সৎবোন। ক্লেয়ার শেলি ও তাঁর স্বামী পার্সিকে রাজি করিয়ে ফেললেন তাঁরা সুইজারল্যান্ডে বায়রনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। যথারীতি তাঁরা সুইজারল্যান্ডে হাজির। ঝোড়ো রাত। তাঁরা ভূতের গল্প করে সময় কাটালেন। বায়রন এই তিনজন বিশেষ অতিথি ও তাঁর লেখক-বন্ধুদের বললেন, তাঁদের প্রত্যেককে যাঁর যাঁর ভৌতিক গল্পটি লিখতে হবে। মেরি শেলি একটি স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্ন নিয়ে জেগে উঠে লিখে ফেললেন শতাব্দীর সেরা ধ্রুপদ উপন্যাস ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। বায়রন ও শেলি পরিবারের বন্ধুত্ব অটুট ছিল আমৃত্যু। চার্লস ডিকেন্স ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন তাঁদের বন্ধুত্ব টেকসই হয়নি। গোড়াতে চার্লস ডিকেন্স ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন পরস্পরের দারুণ ভক্ত। ডিকেন্স অ্যান্ডারসনের পরির গল্প পড়েন আর মুগ্ধ হন। ডিকেন্সের আ ক্রিসমাস ব্যারোল হ্যান্সকে অভিভূত করে। দুজনের প্রথম দেখা ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে। তারপর কেটে যায় নয় বছর। ডিকেন্স বন্ধুকে লেখেন: নয় বছরে ভেবো না তুমি ইংরেজদের মন থেকে হারিয়ে গেছ। তোমার অবস্থান তাদের অন্তরে আরও পোক্ত হয়েছে। এসেই একবার দেখে যাও। সরল বিশ্বাসে হ্যান্স চলে এলেন। ডিকেন্সের বাড়িতে তাঁর জন্য বরাদ্দ কক্ষটিতে থাকলেন। থিয়েটারে গিয়ে ডিকেন্সের অভিনয় করা নাটক দেখে চোখের পানি মুছলেন। তবে দ্বিতীয় দিনই ঘুম থেকে উঠে তাঁর দাড়ি কামিয়ে দেওয়ার মতো কাউকে না পেয়ে অসন্তুষ্ট হলেন তিনি। ডিকেন্সের বড় ছেলেকে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি আনিয়ে শহর থেকে শেভ করে এলেন। ডিকেন্স ও হ্যান্সের বেড়ে ওঠা এবং সাংস্কৃতিক পরিচিতি ভিন্ন ধরনের হওয়ায় প্রতিদিনই জমা হতে থাকল অসন্তোষ। ওদিকে দুই সপ্তাহের জন্য এসে হ্যান্স রয়ে গেলেন পাঁচ সপ্তাহ। যেদিন তিনি বিদায় হচ্ছেন, দেখলেন, দরজায় একটি কাগজ সেঁটে ডিকেন্স লিখে রেখেছেন: এই কক্ষে হ্যান্স পাঁচ সপ্তাহ ছিলেন। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে কয়েক যুগ।
হ্যান্স ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। নরওয়েতে ফিরে গিয়ে চিঠি লিখলেন, কিন্তু ডিকেন্স কোনো জবাবই দিলেন না। দুজন শক্তিশালী ও বিশ্বখ্যাত লেখকের বন্ধুত্বের অবসান ঘটল।
ট্রুম্যান ক্যাপোট ও হারপার লি শিশুবয়সে ট্রুম্যান তাঁর কাজিনদের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন, খেলতেন, হইচই করতেন। সেখানেই খেলার সাথিদের একজন হারপার লি। কাজিনদের বাড়ির পাশেই তাঁদের বাসস্থান। ট্রুম্যান ক্যাপোট তখন বিখ্যাত লেখক। এর মধ্যে বের হলো হারপার লির অসাধারণ জনপ্রিয় উপন্যাস টু কিল আ মকিং বার্ড। যাঁরা দুজনকেই চেনেন, তাঁরা রটিয়ে দিলেন, বইটি আসলে ট্রুম্যানের লেখা। কেউ বললেন, তা নয়, ট্রুম্যান ভালোভাবে সম্পাদনা করেছেন। হারপার লি তেমন কিছু বললেন না এবং মকিং বার্ড-এর পর তাঁর আর কোনো উপন্যাস প্রকাশিত হলো না। বার্ধক্যেও দুজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সাক্ষী ছিলেন অনেকেই। সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হলো অনেক পরে। নিজের খালাকে লেখা ট্রুম্যানের একটি চিঠি অনেক বছর পর ছাপা হলো কাগজে। চিঠিটি টু কিল আ মকিং বার্ড প্রকাশের আগে লেখা। তিনি লিখেছেন, উপন্যাসটি পড়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি আরও লিখলেন, হারপার লি আসলেই একজন শক্তিশালী লেখক।
পাবলো পিকাসো ও গিওম আপোলিনেয়ার তাঁরা ছিলেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফরাসি শিল্পী পাবলো পিকাসো ও কবি গিওম আপোলিনেয়ার। তাঁদের প্রথম দেখা ১৯০৫ সালে। স্বল্পায়ু গিওমের মৃত্যু হয় ১৯১৮ সালে, কিন্তু পিকাসো পেয়েছেন দীর্ঘ জীবন। পিকাসো গিওমের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন, তাঁর প্রতিকৃতি করেছেন। একই সঙ্গে পিকাসো ও গিওম একটি চিঠি পড়ছেন—এমন একটি ছবি এঁকেছেন তিনি ১৯২১ সালে। সারা জীবন বারবার তিনি মনে করেছেন বন্ধু গিওমের কথা। ১৯১০-এর দশকে গিওম ছিলেন প্যারিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্র ও কাব্যসমালোচক। পিকাসোকে আরও বড় করে তুলে ধরতে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। একবারই শুধু ঝামেলায় ফেলে দিয়েছিলেন পিকাসোকে। ২১ আগস্ট ১৯১১। ল্যুভ মিউজিয়াম থেকে চুরি হয়ে যায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘মোনালিসা’। পরদিন শিল্পী লুই বেরুদ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখলেন, পাঁচ বছর ধরে ‘মোনালিসা’ যেখানে শোভা পাচ্ছিল, সেখানে দেয়ালে কেবল চারটি পেরেক, শিল্পজগতের সবচেয়ে আলোচিত এই নারী নেই। প্রথমে মনে করা হলো, ল্যুভের কোনো বিজ্ঞাপনী প্রয়োজনে ছবি তুলতে হয়তো ‘মোনালিসা’কে অন্য কোথাও সরানো হয়েছে; কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমন কিছু ঘটেনি বলে জানালেন। অর্থাৎ ‘মোনালিসা’ চুরি হয়ে গেছে। গোটা সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ল্যুভ মিউজিয়াম। গিওম আপোলিনেয়ার একবার ল্যুভ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। সুতরাং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করল, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুরল জেলে। গিওম পুলিশি প্রশ্নের মুখোমুখি শিল্পী পাবলো পিকাসোর নাম বলে দিলেন। গ্রেপ্তার হলেন তিনিও। অবশ্য চুরির সঙ্গে তাঁদের কারোরই কোনো যোগসূত্র না পাওয়ায় একসময় ছেড়ে দেওয়া হয় দুজনকেই। উদ্ধারকৃত ‘মোনালিসা’ ৪ জানুয়ারি ১৯১৪ ল্যুভে ফিরে আসে। গিওমের মৃত্যুর ৩০ বছর পূর্তিতে পিকাসো আবার তাঁকে স্মৃতি থেকে এঁকে ছিলেন। গিওমকে এঁকেছেন অঁরি রুশো, মাতিসে, মার্ক শাগাল, মিখাইল লারিনোভ, জুয়ান গ্রিস, জ্যা ম্যাটজিঞ্জার, মার্সেল জর্জিও চিরিকো এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু পিকাসো তো বটেই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.